কেন মাসুদ আজহার পরিবারের মৃত্যু ভারতের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?
JeM Chief Masood Azhar: আজহাররা কখনও কথাবার্তা, সমঝোতায় আসতে চায়নি, তারা কোনও আদর্শের পতাকাবাহক নয়, কোনও প্রতিরোধের মসিহা নয়, ভারতরাষ্ট্রের প্রতিটি বাসিন্দাই তাদের টার্গেট
সুপরিকল্পিত সুসম্পাদিত প্রত্যাঘাত। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের অপারেশন সিঁদুরকে এভাবেই বর্ণনা করা চলে। ভোর হতে না হতেই দু'দেশের মানুষের ঘুম ভেঙেছে সেই খবরে আর যুদ্ধের আশঙ্কায়। বেলা গড়াতেই আমরা জানলাম এই হামলায় মাসুদ আজহারের পরিবারের মৃত্যুর খবর। ভারতীয় মিডিয়ায় তো খবরটি করেইছে, এই খবর প্রচারিত হয়েছে বিবিসিতেও। বালাকোট প্রত্যাঘাতকে যেমন 'উড়িয়ে' দেওয়া হয়েছিল, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও প্রমাণ নিয়ে সংশয়ে ছিল, তেমন উড়িয়ে দেওয়া যাবে না এই অপারেশনকে। ইতোমধ্যে সামনে এসে গিয়েছে যে জঙ্গিঘাঁটিগুলি ধ্বংস হয়েছে তার ম্যাপ এবং স্ন্যাপ। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, এটা আসলে প্রত্যাঘাত। সংযত প্রত্যাঘাত। ভারত কোনও সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ করেনি, কোনও সাধারণ মানুষের জীবন নিতে চায়নি, নিশানা করেছে বহালপুর, মুরিদকে, সিয়ালকোট এবং কোটলি। নিশানা করেছে গুলপুর, ভীমবের চাক, আমরুতে। পহেলগাঁও হামলা যেমন সর্বার্থে ব্যতিক্রম ছিল, এই প্রত্যাঘাতও তাই। নিখুঁত প্রযুক্তি, গোয়েন্দা ইনপুটে বলীয়ান ভারতীয় সেনা সীমান্তে গুলি বিনিময় করেনি, কোনওভাবেই সাধারণ মানুষের প্রাণ নিতে চায়নি। লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের শিকড়। আর সেই কারণেই বেছে নেওয়া বাহাওয়ালপুরে জৈশের ঘাঁটি, যে হামলায় মাসুদ আজহারের পরিবারের দশজন সদস্য নিহত হয়েছে বলে খবর। সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর, সে যে দেশেরই হোক না কেন, বেদনাদায়ক। কিন্তু আজহার পরিবারের ইন্তেকাল এই সারণিতে ফেলে দেখা যাবে না। তার তাৎপর্য ব্যপক, গভীর। ভারতের তিন দশকের দেনাপাওনা জড়িয়ে আছে আজহার পরিবারের সঙ্গে। সেই তিন দশকের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, কেন মাসুদ আজহারকে টার্গেট করল ভারত, কে এই মাসুদ আজাহার, কী তার প্রাপ্য?
১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরে জন্ম মাসুদ আজহারের। ১১ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। আল্লাহ বখশ শব্বির একজন দেওবন্দি মৌলবি এবং স্কুলশিক্ষক। তরুণ বয়সে আজহার করাচির জামিয়া বিনোরিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে, সেখানেই জিহাদি মতাদর্শের তার হাতেঘড়ি। ১৯৯০-এর দশকে মাসুদ আজাহার হরকত-উল-আনসার নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হয় এবং সৌদি আরব, জাম্বিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ব্রিটেনে জেহাদের প্রচার শুরু করে। তার কাজ ছিল মুসলিম যুবকদের জেহাদে হাতেখড়ি দেওয়া এবং ফান্ড কালেকশন।
আরও পড়ুন- সিঁদুরে ধ্বংস জৈশ প্রতিষ্ঠাতার পরিবার! মুছে গেল মাসুদ আজাহারের নামও?
১৯৯৪ সালে আজহার একটি জাল পর্তুগিজ পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। তবে, ১৯৯৯ সালে কান্দাহারে ইন্ডিয়ান এয়ারলায়েন্সের আইসি-৮১৪ বিমান অপহরণ করে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয় ভারত সরকারকে। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর, বিকাল ৪টে নাগাদ ১৭৯ জন যাত্রী, ১১ জন বিমান ক্রু নিয়ে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে আইসি ৮১৪। বিমান ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করলে যাত্রীদের জলখাবার দেওয়া শুরু করেন বিমানকর্মীরা। ৫টা নাগাদ হঠাৎ যাত্রীদের পাঁচজন আসন থেকে উঠে রিভলভার এবং গ্রেনেড হাতে নিয়ে চিৎকার শুরু করে। ঢুকে পড়ে ককপিটে। ক্যাপ্টেনের আসনের সামনে থেকেই ঘোষণা করে যে, বিমানটিকে ছিনতাই করা হয়েছে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মতে, পাঁচ জঙ্গিকেই পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাঁরা ছিলেন— ইব্রাহিম আতহার, আখতার সঈদ, সানি আহমেদ কাজি, জহুর মিস্ত্রি এবং শাকির। আর এই অপহরণের পিছনে ছিল আজহারের ভাই ইব্রাহিম আথার এবং ভাই আব্দুল রউফ আসগর। ভারতীয় নাগরিকদের প্রাণ বাঁচাতে সেদিন ছেড়ে দিতে হয় আজহারকে। মুক্তির পর আজহার পাকিস্তানে ফিরে জৈশ-ই-মহম্মদ প্রতিষ্ঠা করে যে জঙ্গিগোষ্ঠী দিনের পর দিন ভারতকে রক্তাক্ত করেছে।
জৈশ পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে একটি বিশাল কমপ্লেক্স থেকে পরিচালিত হয়, এই কমপ্লেক্সের ভিতর উম্ম-উল-কুরা মসজিদ এবং মাদ্রাসা রয়েছে। আজহারের পরিবার এই সংগঠনটিকে পরিচালনা করে। তার ভাই আব্দুল রউফ আসগর প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করে এবং অন্যান্য আত্মীয়রাও বিভিন্ন ভূমিকায় জড়িত। জৈশ-আল-কায়েদা এবং তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জৈশকে সময়ে সময়ে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসছে। রাষ্ট্রীয় মদত ছাড়া সুশৃঙ্খলিতভাবে প্রশিক্ষণ, তহবিল সংগ্রহ এবং হামলার পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মেশিনগান, অ্যাসল্ট রাইফেল, মর্টার, গ্রেনেড এবং ইম্প্রোভাইজড বিস্ফোরক ডিভাইস জোগাড় করা। লড়াইটা যে আসলে যে জৈশ বা লস্করের মতো সংগঠনের সঙ্গে, কাশ্মীরে হামলা চালানো টিআরএফ যে এই সংগঠনগুলিরই ছায়া তা বোঝা দুঃসাধ্য নয়। ভারত চাইছিল এই সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর ভেঙে দিতে কারণ গত দু'দশক এই এপিসেন্টার থেকেই থেকেই পরিচালিত হয়েছে ভারতবিরোধী নাশকতা। নাশকতার একটা তালিকা তুলে ধরা যাক:
১ অক্টোবর, ২০০১, জৈশের একজন সন্ত্রাসী শ্রীনগরে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার সামনে একটি বিস্ফোরক-ভর্তি গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় ৩৮ জন নিহত এবং ৮০ জনের বেশি আহত হন। এটি ছিল জৈশের প্রথম বড় হামলা।
১৩ ডিসেম্বর, ২০০১, জৈশ এবং লস্কর-ই-তৈবার সন্ত্রাসীরা নয়াদিল্লিতে ভারতীয় সংসদে হামলা চালায়। পাঁচজন সন্ত্রাসী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ট্যাগ লাগানো গাড়ি নিয়ে সংসদে প্রবেশ করে এবং এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এই হামলায় পাঁচজন সন্ত্রাসী নিহত হয়, ছ'জন দিল্লি পুলিশ কর্মী, দুইজন সংসদ নিরাপত্তা কর্মী এবং একজন মালি নিহত হন।
২ জানুয়ারি, ২০১৬, চারজন জৈশ সন্ত্রাসী পঞ্জাবের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় কালাশনিকভ রাইফেল এবং গ্রেনেড নিয়ে ঘাঁটিতে প্রবেশ করে এবং সাতজন ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যা করে। জৈশ এই হামলার দায় স্বীকার করে।
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, জৈশের চারজন সন্ত্রাসী জম্মু ও কাশ্মীরের উড়িতে ভারতীয় সেনা ব্রিগেডের সদর দপ্তরে হামলা চালায়। তারা তিন মিনিটে ১৭টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং ১৭ জন সেনা সদস্যকে হত্যা করে। এই হামলার জবাবে ভারত পাকিস্তানে সার্জিকাল স্ট্রাইক চালায়।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একজন জৈশ আত্মঘাতী বোমারু ৭৮টি গাড়ির একটি সিআরপিএফ কনভয়ে বিস্ফোরক-ভর্তি গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় ৪৪ জন সিআরপিএফ কর্মী এবং হামলাকারী নিহত হন। জৈশ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এই ঘটনার পর ভারত পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ায় বালাকোটে বিমান হামলা চালায়।
এছাড়া, জৈশ ২০১৪-১৫ সালে কাঠুয়া, সাম্বা, হান্দওয়ারা এবং পুলওয়ামায় পুলিশ স্টেশন এবং সেনা শিবিরে হামলা চালিয়েছে। ২০১৬ সালে নাগরোটায় সেনা ঘাঁটিতে হামলায় চারজন সেনা সদস্য নিহত হন।
আরও পড়ুন-বিশ্বাসঘাতকতার সাত দশক! কেন বালুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?
কিন্তু এবারের পহলগাঁওতে আক্রমণের ধরনধারণ ছিল একদম আলাদা। সন্ত্রাসীরা চাইছিল ভারতের সেকুলার স্পিরিটকে ভেঙে দিতে। চাইছিল সরকারের প্রতি জনতার তীব্র বীতস্পৃহা তৈরি করতে। মানুষে মানুষে অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করতে। সবচেয়ে বড় কথা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে, ১০০ কোটি মানুষের সঙ্গে কাশ্মীরের দূরত্ব তৈরি করতে। ফলে ভারতীয় সেনা গোয়েন্দাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রত্যাঘাতের কৌশল স্থির করা। ২৫ জন ভারতীয় এবং একজন নেপালি নাগরিকের মৃত্যুর জবাবে আরও কিছু নাগরিকের প্রাণ নেওয়া নৈতিকভাবে খুব সদর্থক কাজ হতো না। প্রয়োজন ছিল যেখানে সন্ত্রাসের জন্ম সেই শিকড়টাকে উপড়ে ফেলা, অন্তত শিকড় ধরে টান মারা।
জৈশ বিবৃতি বলে যে উর্দু ভাষায় লেখা কাগজটি প্রচারিত হচ্ছে তা বলছে, এই হামলায় মাসুদ আজহারের দিদি, জামাইবাবু, ভাইপো-সহ পরিবারের দশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। জৈশের চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীও মারা গিয়েছে। পাশাপাশি, মনে রাখব আজহারের এক আত্মীয় এজাজ আবিদ গত এপ্রিলে পেশোয়ারে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হাতে খুন হয়। ২০২৩ সালে পাকিস্তানের শিয়ালকোটে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতী গুলি করে খুন করে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মহম্মদের সদস্য শাহিদ লতিফকে। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম ছিল লতিফের।
আজাহার কি জীবিত? আমরা এখনও জানি না। আমরা জানি, এই অপারেশন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বড়সড় পদক্ষেপ। আজহাররা কখনও কথাবার্তা, সমঝোতায় আসতে চায়নি, তারা কোনও আদর্শের পতাকাবাহক নয়, কোনও প্রতিরোধের মসিহা নয়, ভারতরাষ্ট্রের প্রতিটি বাসিন্দাই তাদের টার্গেট, এই রাষ্ট্রের বয়ন-বুনিয়াদ ভাঙাই তাদের প্রতিজ্ঞা। এবং মনে রাখতে হবে এ কাজে জড়িয়েছিল গোটা আজহার পরিবার। তারা সাধারণ নিরীহ নিরাপরাধ পাকিস্তানি নয়। তিন দশক তারা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। আর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই জৈশকে আর্থিক এবং সামরিক সহায়তা প্রদান করে এসছে। অপারেশন সিঁদুর আইসিস-কেও বার্তা। বার্তা এই যে যে কোনও মুহূর্তে উড়তে পারে আইএসআই-ঘাঁটিও। সেই সামর্থ্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর আছে।
সাধারণ ভারতীয়রা যুদ্ধ চায় না। বুদ্ধিমান মাত্রই জানেন, যুদ্ধ বিপদে ঠেলে দেয় গরিব মানুষকে, সীমান্তবর্তী বহু অসহায়কে। কিন্তু ভারত সন্ত্রাসদমন চায় আত্মরক্ষার্থে। মাসুদ আজাহারকে চাই জীবিত অথবা মৃত। আজাহারদের উস্কানি আর অর্থ দেয় যে আসীম মুনিররা, চাই তাদেরও।