শুধুই কি প্রার্থী তালিকা 'ফাঁস'? প্রশান্তকিশোর-মমতার তিক্ততার আসল কারণটা কী?

জল্পনা চলছিল অনেকদিন ধরেই, অবশেষে সমস্ত সম্পর্কে ইতি টেনে তৃণমূলের সঙ্গে সমস্ত গাঁটছড়া ছিন্ন করলেন ভারতের অন্যতম তারকা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা একটি ছোট্ট টেক্সট মেসেজে পিকে লিখলেন, "আমি পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় এবং উড়িষ্যায় তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করতে চাই না।" উত্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কোন রাখঢাক না করেই তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন। কিন্তু, প্রশ্নটা অন্যত্র, যে প্রশান্তকিশোর এবং আইপ্যাকের সহায়তায় বিজেপিকে রুখে দিয়ে ২০২১ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল তৃণমূল, তার সঙ্গে এত তিক্ততার কারণটা কী?

এর কারণটা খুঁজতে হলে যেতে হবে মাস কয়েক আগে, ২০২১ এর ডিসেম্বরে। কলকাতা পুরসভার নির্বাচনের জন্য সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করছিল, সেই সময় প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাক ১৪৪ ওয়ার্ডের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় প্রার্থী বদল করে নতুন মুখ আনার পক্ষে সওয়াল করে। তখন থেকেই শুরু হয় তৃণমূল কোর কমিটি এবং প্রশান্ত কিশোরের মতবিরোধ। আইপ্যাকের সুপারিশ খৰআ প্রার্থীদের একেবারেই না-পসন্দ ছিল মমতার। এলাকার পুরনো নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন মুখদের সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বাসভাজন নেতাদের সরিয়ে নতুন মুখেদের সামনে আনার সিদ্ধান্ত আইপ্যাকের প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোহভঙ্গ করে। 

পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে চলা পুরসভা নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকার বিরোধিতা করে আইপ্যাক। জানা যায়, আইপ্যাকের তরফ থেকে তৃণমূলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাও প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছিল, যা তৃণমূলের একাধিক বুথস্তরীয় নেতাদের নাপসন্দ হয়েছিল। দক্ষিণবঙ্গের বেশকিছু জেলায় যেখানে তৃণমূলের ঘাঁটি বেশ শক্ত, সেখানেও বহু তৃণমূল নেতারা এই প্রার্থীতালিকার বিরোধিতা করেন। দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় একাধিক পার্টি অফিস ভাঙচুর করা হয়, পার্টি অফিসে লুটপাট চলে, অনেক তৃণমূল নেতা রাতারাতি ফের তাদের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বিরোধী দলেও যোগদান করেন। 

ড্যামেজ কন্ট্রোলে মাঠে নামেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। ঘোষণা করেন, এই প্রার্থী তালিকা কোনো ভাবেই বৈধ নয়। আইপ্যাক সংস্থাকে তাদের কাজের পরিসর বুঝিয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতারা সরাসরি জানিয়ে দেন, আইপ্যাক সংস্থা শুধুমাত্র তৃণমূলকে পরামর্শ দিতে পারে, এই পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ তৃণমূলের সিদ্ধান্ত থাকবে। যদিও এই প্রথম নয়, এর আগেও প্রশান্ত কিশোরের সংস্থার বিরুদ্ধে একাধিকবার মুখ খুলতে শোনা গিয়েছে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। 

তবে এবারের পৌরসভা নির্বাচন পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর হাতে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে এসেছিলেন বিধানসভা নির্বাচনের ভোট কৌশলী হিসেবে। দলের একেবারে নিচুতলার স্তর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসকে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোর এতটাই ভাল ভাবে মিশে গিয়েছিলেন যে, বিজেপির বি রোধী যে কোনও বক্তৃতাতে তাঁর নাম উল্লেখযোগ্য ভাবে উঠে আসতে শুরু করে। দলের পুরোনো নেতাদের মধ্যে অনেকের বিরাগভাজন হলেও প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন মমতা এবং অভিষেক।

দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই পুরো পশ্চিমবঙ্গ চষে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন প্রশান্ত কিশোর। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে শুদ্ধিকরণ শুরু হয় তৃণমূল কংগ্রেসের। বহু পরিচিত মুখকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তার জায়গায় আসে নতুন মুখ। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রশান্ত কিশোর সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, বিজেপি ১০০ আসন পার করতে পারবে না। প্রবল বিজেপি ঝড়ের মধ্যেও তৃণমূলের আশা জিইয়ে রেখে ছিলেন এই পিকে। নির্বাচনের আগে আগে প্রশান্ত কিশোর নিয়ে আসেন এক নতুন স্লোগান, যা ফিরতে থাকে বাংলার জনগণের মুখে মুখে। 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়' শ্লোগানের মাধ্যমে বাঙ্গালীদের মনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'বাংলার মেয়ে' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেন তিনি। 

তৃণমূলের বহিরাগত তত্ত্বের পিছনেও প্রশান্ত কিশোরের হাতে ছিল বলে বিশ্বাস অনেকের। এমনকী 'খেলা হবে' সহ জনপ্রিয় একাধিক স্লোগানের জনপ্রিয়তার পিছনেও নাকি অনেকটাই কাজ করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তৃণমূলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকাও তৈরি হয় একেবারে নেতাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ-র পরেই। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কৌশল তৈরি থেকে শুরু করে প্রার্থী বাছাই, সব ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর সংস্থা আইপ্যাক । বিধানসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরের প্রায় প্রত্যেকটি কৌশল গ্রহণও করেছিল তৃণমূল, যার সুফলও পাওয়া যায় হাতেনাতেই। 

তৃতীয়বারের জন্য বাংলার মসনদে বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশান্ত কিশোরও নিজের চ্যালেঞ্জ জিতে যান বিজেপিকে ৭৭ আসনে আটকে দিয়ে। কিন্তু তারপর থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। আসলে, এই চিড় ধরার কাজ শুরু হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই। সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসে প্রশান্ত কিশোরের আইপ্যাকের বৃদ্ধি পাওয়া প্রভাব অনেক বর্ষীয়ান নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। অনেকে আবার 'টিকিট পাবেন না', এই ভয়ে বিজেপিতে পর্যন্ত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, এই সব বিষয় বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ফলাফলের উপরে তেমন ভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। 

আরও পড়ুন-মোদির নিউ ইন্ডিয়া বনাম রাহুল গান্ধী, ম্যাচের ফলাফল?

প্রশান্ত কিশোরের জন্য পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফল আকর্ষণীয় হলেও তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রশান্ত কিশোরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অনেক তৃণমূল নেতার মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায়, তৃণমূল কংগ্রেস এই নির্বাচনে জয়লাভ করেছে শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব এবং তার ক্ষমতার জোরে, প্রশান্ত কিশোরের এই নির্বাচনে তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর প্রশান্ত কিশোর আনুষ্ঠানিকভাবে আইপ্যাক ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এখনো রয়েছে। সরকারি একাধিক জায়গাতে তাঁর উপস্থিতিও তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু, এই বিষয়টাই তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে হয়ে উঠেছে চক্ষুশূল।

তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও একাধিকবার প্রশান্ত কিশোর এবং আইপ্যকের অতি-সক্রিয়তায় বিরক্ত হয়েছেন কখনওসখনও। উচ্চপদস্থ আমলাদের কাছেও প্রশান্ত কিশোরের অ্যান্ড কোম্পানির তেমন একটা সুনাম নেই। বিশেষত, জেলা স্তরে প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শগুলি অনেকেই খুব একটা ভালো ভাবে গ্রহণ করেননি বলে শোনা যায়। আর এই বিষয়টির প্রথম প্রমাণ মেলে, কলকাতা এবং বিধাননগরের পুরসভা এবং পুরনিগমের ভোটের প্রার্থী বাছাইয়ের সময়। প্রশান্ত কিশোরের সংস্থার কর্মীরা তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অনুযোগ করেন, কলকাতার প্রার্থী ঠিক করার সময়ে তাঁদের সুপারিশ নাকি মানা হচ্ছে না। তবে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের এই অনুযোগে বিশেষ আমল দিলেন না। বরং তারা সরাসরি জানিয়ে দিলেন, বাংলাকে বুঝতে অন্য কারোর পরামর্শের তাদের প্রয়োজন নেই। তখন থেকেই কার্যত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল এবং প্রশান্ত কিশোরের অবস্থান।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ কিছু আমলা এর আগেও মমতাকে বারংবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রশান্ত কিশোরের অতিসক্রিয়তা রাজ্যের জন্য খুব একটা ভালো বিষয় না, যা খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও আরো একবার ভাবতে বাধ্য করেছে। তাই, গাঁটছড়া যে খুব তাড়াতাড়িই ছিন্ন হতে চলেছে এটা আভাস করা গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। একজন পেশাদার রাজনৈতিক কৌশলীর থেকে যে দলের বিশ্বস্ত কর্মী এবং আমলাদের উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরসা বেশি থাকবে সেটা বলাই বাহুল্য। তাই যা হবার সেটাই হলো।

তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ না, মেঘালয় এবং গোয়াতেও প্রশান্ত কিশোরের কাজের পদ্ধতি নিয়ে বিরক্ত ছিলেন মমতা নিজেই। মেঘালয় এবং গোয়ায় কংগ্রেস থেকে নেতাদের তৃণমূল কংগ্রেসে নিয়ে আসার সমস্ত কৃতিত্ব পিকের টিমকেই দেওয়া হচ্ছিল। অথচ তাঁর তৈরি করা কৌশল অবলম্বনে লড়াই করেই ত্রিপুরার সাম্প্রতিক পুরভোটে জঘন্য পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিল তৃণমূল। সারা রাজ্যে ২২২টি পুরসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস জয়লাভ করেছিল মাত্র একটিতে, যেটা খারাপ বললেও হয়তো কম বলা হবে। গোয়াতেও প্রশান্ত কিশোর এবং তার টিমের তৈরি করা কৌশল খুব একটা ভালো কাজ করছে না তৃণমূলের জন্য। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা, প্রশান্ত কিশোরের টিমের তৈরি করা প্রোজেকশন অনুযায়ী যদি তৃণমূল চলে, তাহলে গোয়াতেও তৃণমূল কংগ্রেস পরাজয়ের সম্মুখীন হতে পারে। 

তার মধ্যেই আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অগোচরে তৃণমূলের অফিশিয়াল পেজে প্রকাশিত হয়ে যাওয়া সেই প্রার্থী তালিকা, যার জন্য প্রশান্ত কিশোরের সংস্থাকেই দায়ী বলে মনে করছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। জানা যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজেও নাকি সেই একই মত পোষণ করছেন। বিষয়টি এতদূর পর্যন্ত চলে আসে, যে দু'দিন আগে পিকে একটি মেসেজ করে মমতাকে জানান, বাংলা, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে তারা কাজ করতে চান না। এই মেসেজে গোয়া রাজ্যের কথা উল্লেখ করা হয়নি, কারণ আগামী ১০ মার্চ গোয়ায় সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের দিন পর্যন্তই তৃণমূলের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের সম্পর্ক গোয়ায়। 

কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আর আইপ্যাকের সঙ্গে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রচেষ্টা করলেন না। সাদরে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশান্ত কিশোরকে বিদায় দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দলের ঘনিষ্ঠ কর্মীদের ফোন করে জানিয়ে দিলেন, প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক কার্যত শেষ। প্রশান্ত কিশোরকে ছাড়াই তৃণমূল এগোতে পারবে। আগামী ভবিষ্যতেও প্রশান্ত কিশোরকে কোন কাজে তিনি গ্রহণ করবেন না বলে স্পষ্ট জানালেন মমতা। কিন্তু, প্রশান্ত কিশোরকে সরিয়ে দেওয়ায় সত্যিই কি কোনো প্রভাব পড়বে না তৃণমূলের উপর? প্রশান্ত কিশোর যদি না থাকেন তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় দল হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হবে? প্রশান্ত কিশোরের ভবিষ্যতই বা কি হবে? একাধিক প্রশ্ন রইল জমা, যার উত্তর জানার জন্য সময়ের কাছে অপেক্ষা তো করতেই হবে।

More Articles