অক্সফোর্ডে ৪৩ মিনিটের বক্তব্যে কোথায় গোলালেন, কোথায় ছক্কা হাঁকালেন মমতা?

Mamata Banerjee Oxford University: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েই বলেছেন, অক্সফোর্ডে বক্তব্য পেশের জন্য আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি নেননি তিনি।

গত ২৭ মার্চ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কেলগ কলেজে ‘সামাজিক উন্নয়ন- বালিকা, শিশু এবং নারীর ক্ষমতায়ন’ নিয়ে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। অক্সফোর্ডের মতো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখা অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁর বক্তব্য চলাকালীন আরজি কর হাসপাতালে দুর্নীতি ও ধর্ষণ-হত্যা থেকে শুরু করে শিল্পের বিনিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলেন কিছু বিক্ষোভকারী। স্বাভাবিকভাবেই তাল কাটে। তবে লাগাম ধরে নেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনী প্রচারে বা জনসভায় যেভাবে বক্তব্য রাখেন, খানিক সেই ছন্দেই এগিয়ে যান। প্রশ্ন হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রস্তুতি ছিল কেমন? কেন অক্সফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের ডাকে সাড়া দেওয়ার পরেও বক্তব্যে পরিসংখ্যান গুলিয়ে যায় তাঁর, কেন চকোলেট খাওয়াব-মিষ্টি খাওয়াব জাতীয় চটুল রাজনৈতিক মন্তব্য করেই পরিস্থিতি সামলাতে হলো তাঁকে?

প্রতিবাদকারীরা আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যা এবং দুর্নীতির প্রশ্ন উত্থাপন করলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতার মাঝখানেই বিক্ষুব্ধদের উত্তর দিতে শুরু করেন। "আপনারা জানেন মামলাটি বিচারাধীন এবং কেন্দ্রীয় সরকার মামলাটি হাতে নিয়েছে। এটা আমাদের হাতে নেই। দয়া করে এখানে রাজনীতি করবেন না, এই মঞ্চ রাজনীতির জন্য নয়। আপনারা এখানে নয়, আমার রাজ্যে রাজনীতি করতে পারেন এবং আপনারাই তো ক্রাউড ফান্ডিং বিষয়ে সবচেয়ে ভালো জানেন,” বলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন- অক্সফোর্ডে ধুন্ধুমার! বিক্ষোভকারীদের টানা প্রশ্ন, কী উত্তর ফেরালেন মমতা?

 

বক্তব্যের মাঝে হট্টগোল চলতে থাকলে, মুখ্যমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের "বাম, অতি-বাম এবং সাম্প্রদায়িক বন্ধু" হিসাবে চিহ্নিত করেন। বলেন, "আপনারা যদি এটিকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চ করতে চান, তাহলে বাংলায় যান। সাম্প্রদায়িক লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে, আপনাদের রাজনৈতিক দলটিকে আরও শক্তিশালী হতে বলুন।" বিক্ষোভকারীদের জবাব দিতে গিয়ে বাম আমলের একটি ছবি তিনি তুলে ধরেন। আহত এবং মাথায় ব্যান্ডেজ— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই পরিচিত ছবিটি দেখিয়ে প্রতিবাদকারীদের বলেন, "আমি আপনাকে উত্তর দেব, আগে আমার ছবি দেখুন, কীভাবে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আপনার আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। আপনি আমাকে অপমান করছেন না, আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান করছেন। এই লোকেরা সর্বত্র এটি করে। আমি যেখানেই যাই তারা এসব করে।” রাজনীতির মঞ্চ না করে তোলার আহ্বান জানানোর পরেই কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বিরোধিতার পুরনো চিত্র অক্সফোর্ডের মঞ্চ থেকে তুলে ধরলেন? তাঁর বক্তব্যের বিষয়ের সঙ্গে এই ছবির কোনও সম্পর্ক ছিল কি? ছবিটি কেনই বা সঙ্গে রেখেছিলেন মমতা? প্রশ্ন উঠছে।

বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘সামাজিক উন্নয়ন- বালিকা, শিশু এবং নারীর ক্ষমতায়ন’। তৃণমূল সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্প এবং মহিলাদের উন্নতি বিষয়ে কথা বলেছেন মমতা। বলেছেন, "আমরা ৯৭টি সামাজিক ক্ষেত্রের প্রকল্প পরিচালনা করছি এবং শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে, কলকাতা এখন দেশের কর্মসংস্থানের গন্তব্য। বলেছেন, শিক্ষাকে বাংলা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। বলেছেন, "আমরা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত কন্যাশ্রী বৃত্তি দেওয়া শুরু করেছি। এক মিলিয়ন পড়ুয়া এখন বৃত্তি পায় এবং স্কুলছুট হওয়ার হার এখন প্রায় শূন্য।"

মমতার দাবি, "আমাদের রাজ্যে, আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তখন প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি ৬০ শতাংশের উপরে ছিল। এখন তা ৯৯.৫ শতাংশ এবং এক বছরের মধ্যে তা ১০০ শতাংশ হয়ে যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বাড়ানোর জন্য আমরা অনেক মা ও শিশু কেন্দ্র এবং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি করেছি।” তৃণমূল কংগ্রেস প্রধান বলেছেন, "আমরা কোভিডের পরে একটি অনন্য উদ্যোগ শুরু করেছি, 'লক্ষ্মীর ভান্ডার' যা এখন আমাদের দেশের প্রতিটি রাজ্য অনুসরণ করছে।"

 

নিজের বক্তব্যে তাঁর শৈশব, বাবাকে হারানো, রেলমন্ত্রী, কয়লা মন্ত্রী, নারী-শিশুকল্যাণ মন্ত্রী হওয়া সবই বলেছেন তিনি। কতবার সাংসদ, বিধায়ক হয়েছেন তারও খতিয়ান দিয়েছেন। বলেছেন রজ্যের ৩৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ সংখ্যালঘু। নিজেই উল্লেখ করেছেন তাঁর সরকারের 'ক্যাচ লাইন' মা মাটি মানুষ! আর বারেবারে বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় থেকে কী কী ভেবেছেন। 'তিনি' কে? মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তাঁর দল সরকার চালায়। তিনি এই সরকারের মুখ ঠিকই, কিন্তু সরকারের মুখ হয়ে 'আমিত্ব'-কে প্রাধান্য দেওয়া যায় না। মমতা নিজেই বলছেন, "আমি কন্যাশ্রী শুরু করেছি।" তিনি একা সরকার ছাড়া কন্যাশ্রী বা কোনও প্রকল্পই যে শুরু করতে পারেন না, সেই সাধারণ তথ্যটি মুখ্যমন্ত্রী হামেশাই বিস্মৃত হন। কিন্তু কেন? ভারতের রাজনীতিতে নেতার মুখ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই নেতা যদি সরকারের বাকি সকলের ভূমিকা অস্বীকার করে কেবল একজনকেই বা বলা ভালো নিজেকেই প্রাধান্য দিতে থাকে তাহলে সেই নেতার গোষ্ঠীচেতনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

আরও পড়ুন- অক্সফোর্ড বিক্ষোভের নেপথ্যে এসএফআই? তাহলে হিন্দুদের রক্ষার প্রশ্ন তুললেন কে?

মমতা তাঁর বক্তব্যে একবার বলেছেন বাংলায় স্কুলছুটের হার ২ শতাংশ। একবার বলছেন স্কুলছুটের হার 'মাইনাস'! কেন্দ্রের তথ্য বলছে, মাধ্যমিক স্তরে এই বাংলাতেই ১৭.৮৫ শতাংশ পড়ুয়া স্কুলছুট হয়েছে। মমতা একবার বলছেন ২৩ লক্ষ মিলিয়ন অর্থের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। একবার বলছেন ১৯ কোটি, একবার বলছেন ১৯ লক্ষ! তারপর বলছেন ১৯ লক্ষ কোটি! কেন পরিসংখ্যান এত গুলিয়ে যাচ্ছে তাঁর? টাটা বাংলা থেকে কেন পালিয়ে গেল প্রশ্ন উঠতেই মুখ্যমন্ত্রী বলছেন টাটা কগনিজেন্টের কথা! ভারী শিল্প আর তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে গুলিয়ে দিলেন কেন মুখ্যমন্ত্রী?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়েই বলেছেন, অক্সফোর্ডে বক্তব্য পেশের জন্য আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি নেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, "আজ বক্তৃতার জন্য আলাদা করে পড়াশোনা করিনি। জীবনের পথচলা থেকেই তৈরি আমি। আর কানে কানে আমায় কিছু বললেও সে তথ্য মুখস্থ হয়ে যায়। মুখ্যসচিবকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ। কিন্তু সব খবর রাখি। সবসময় প্রস্তুত।" কিন্তু জনসমাবেশে বক্তব্য, আর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য তো একই নয়। নিজের বাংলা এবং নিজের সরকারের কথা বলতে গিয়ে বক্তব্য আরেকটু কি গুছিয়ে নিতে পারতেন না মমতা? তাঁর সহকারীরা কি এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সাহায্য করলেন না? না কি সাহায্য চানই না মমতা কারণ তিনি "জীবনের পথচলা থেকে তৈরি"! আর তাঁর সরকার?

More Articles