স্কুলের বইয়ে ইন্ডিয়া বদলে ভারত! বিজেপির সুরেই কথা বলে এনসিইআরটির কী লাভ?

INDIA VS Bharat in NCERT Syllabus : পারসিয়ানরা ‘স’ উচ্চারণ না করে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। তাই ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’তে রূপান্তরিত হয়ে যায় শব্দটি কিন্তু অর্থ একই থেকে যায়, নদী।

স্কুলপাঠ্য থেকে এবার ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘ভারত’ করার প্রস্তাব দিল এনসিইআরটি অর্থাৎ (ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ এডুকেশানাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং)। সেই নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। অবশ্য এই প্রস্তাব নতুন তো নয়, এই প্রস্তাব এসেছে ২০২২ সালে তাঁদের সমাজ ও বিজ্ঞান কমিটির পক্ষ থেকে। ঘটনাচক্রে এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরেই আবার নতুন করে চর্চায় আসে বিষয়টি। স্কুল পাঠ্যক্রমের সংশোধনের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার মাথায় বসানো হয়েছিল সঙ্ঘ পরিবার ঘনিষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সি আই আইজ্যাককে। ইতিহাসবিদ আইজ্যাকের বক্তব্য, বিষ্ণু পুরাণে, ‘ভারত’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, কালিদাসও ‘ভারত’ নামটি ব্যবহার করেছিলেন। এটি অত্যন্ত প্রাচীন নাম। ‘ইন্ডিয়া’ নামটি তুর্কি, আফগান এবং গ্রিকদের আক্রমণের পরে দেওয়া। তাই ‘ভারত’ নামটির সঙ্গেই পরিচিত হোক, আগামী প্রজন্ম। তাই স্কুলপাঠ্যতে আগামীতে ‘ভারত’ শব্দ দিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ নামটিকে পরিবর্তন করা হোক। এনসিইআরটির বিরুদ্ধে আগেও এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ এসেছে যে তাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রটিকে গেরুয়াকরণ করার জন্য রাজনৈতিক অনুঘটকের কাজ করছেন। এবারের সুপারিশে তা সম্ভবত আরও স্পষ্ট হলো।

কেন এই সুপারিশ করল এনসিইআরটি?

এর পিছনে কি কোনও রাজনীতি আছে? অবশ্যই আছে এবং তা যদি আমরা অগ্রাহ্য করি তাহলে ভুল হবে। আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে ২৮টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই জোটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইন্ডিয়া জোট’ বা INDIA ALLIANCE। তারপর থেকেই শাসক দল উঠে পড়ে লেগেছে এটা প্রমাণ করতে যে, ‘ভারত’ শব্দটিই আদি, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ঔপনিবেশিক। এখন তো বেশিরভাগ মানুষই বিদ্যার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়কে মেনে নিয়েছেন। সুতরাং সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যই অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি করছে। সেই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু পড়ুয়ার মুখেই এখন শোনা যাচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’ নামটি নাকি ব্রিটিশদের দেওয়া। তাই তার পরিবর্তে ‘ভারত’ বলতে অসুবিধা কোথায়? যেন আরেক লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। হয় আপনি ‘ইন্ডিয়া’-র পক্ষে, নয় আপনি ‘ভারত’-এর পক্ষে। যেন ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ।

আরও পড়ুন- ‘ইন্ডিয়া’ বদলে ‘ভারত’! কেন দেশের নাম বদলাতে মরিয়া বিজেপি?

যদিও ঘটনাচক্রে, আজকের প্রধানমন্ত্রীর শাসনকালে ইন্ডিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে ভারতের মানুষের একটা দূরত্ব বৃদ্ধি হয়েছে, তবুও তাঁরা এখনও প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেননি। কোভিডের লকডাউনের সময়ে, ইন্ডিয়ার মানুষরা যখন মুখে মুখোশ এঁটে দুয়ার তুলে দিয়েছিলেন, তখন ভারতের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারও আগে, যখন আজকের মহম্মদ বিন তুঘলক নোটবন্দি ঘোষণা করেছিলেন, তখনও কিন্তু ভারতের বাসিন্দারাই নোট বদল করতে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। আজকের ভারতের উত্তর পূর্বের একটি ছোট রাজ্য মণিপুর যখন জাতিগত দাঙ্গায় জ্বলছে, যখন ৪ মাস ধরে সেখানে ইন্টারনেট বন্ধ, যখন সেখানকার মহিলাদের নগ্ন করে হাঁটানোর ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়াচ্ছে, তখন ইন্ডিয়ার বাসিন্দাদের সত্যিই কি কিছু এসে যাচ্ছে?

যখন মুজফফরপুরে, একজন হিন্দু প্রধানশিক্ষিকা তাঁর ক্লাসের সংখ্যাগুরু ছাত্রদের দিয়ে এক সংখ্যালঘু ছাত্রকে মার খাওয়াচ্ছেন, তখনও কি তা ইন্ডিয়ার বাসিন্দাদের স্পর্শ করছে? যখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে এই ভারতেরই নাগরিক সংখ্যালঘু মুসলমানদের পিটিয়ে মারার খবর আসছে, তখনও কি ইন্ডিয়ার সংখ্যাগুরুদের বিন্দুমাত্র রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে? আসলে আজকের শাসক, আজকে দেশের যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি নিজেই সচেতনভাবে এই ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’-এর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। আজকে তাই তিনি আবার নিজেকে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে দেখাতে চাইছেন। তাঁর দলের সমস্ত নেতা মন্ত্রী সেই হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় মারফত এই বার্তা দিচ্ছেন, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ব্রিটিশদের দেওয়া।

ইতিহাস কী বলে?

গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে এবং মেগাস্থিনিস খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে, তাঁর ইন্ডিকা গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছিলেন। এই নামটা এসেছে ইন্দাস নদী থেকে, যাকে ইন্দো এরিয়ানরা সিন্ধু নদী বলে ডাকতেন। এই 'সিন্ধু’ শব্দটিও এসেছে ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত মানুষদের কাছ থেকে, যাঁরা এই দেশে এসেছিলেন এবং যাঁদের আমরা ‘ইন্দো এরিয়ান’ বলে অভিহিত করে থাকি। তাঁদের ভাষায় এই 'সিন্ধু’ শব্দটির অর্থ ছিল নদী। পারসিয়ানরা ‘স’ উচ্চারণ না করে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। তাই ‘সিন্ধু’ থেকে ‘হিন্দু’তে রূপান্তরিত হয়ে যায় শব্দটি কিন্তু অর্থ একই থেকে যায়, নদী। আজকে যারা ধর্ম হিসেবে ‘হিন্দু’ বলে থাকেন, তাঁদের কাছে এই ইতিহাসের কোনও মূল্য হয়তো নেই কিন্তু ইতিহাসবিদদের কাছে নিশ্চিত আছে।

ওই নদীর পূর্ব দিকের অংশটিকে সিন্ধু বা হিন্দু বলা হতো যার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগাযোগ নেই। পারসিয়ানদের থেকে এই শব্দটি গ্রিকদের কাছে পৌঁছয়। গ্রিকরা তখন কিন্তু শুধু গ্রিসে থাকতেন না। তাঁরা অ্যানাটোলিয়া অর্থাৎ আজকের সময়ের তুরস্কেও বাস করতেন এবং ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের অনেক জায়গাতেই তাঁরা বসবাস করতেন। অ্যানাটোলিয়া ভাষায়, ‘হ’ নিঃশব্দ থাকার ফলে আসে ‘ইন্দোস’, সেখান থেকে ‘ইন্ডিয়া’। এই ইতিহাস বহু বছরের, এত কিছু পড়ার ধৈর্য্য হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেই। যদি এতটুকুও সচেতনতা থাকত, তাহলে তাঁরা এই নাম বদলের বিরোধিতা করতেন।

আরও পড়ুন- ভারত বনাম ইন্ডিয়া: প্রথম নয়, আগেও যেভাবে পাল্টে ফেলা হয়েছে এই সব রাজ্যের নাম

যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দুশো বছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে এই নাম বদলে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আসলে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচারের কথা। যে সংস্থা ‘ইন্ডিয়া’-তে ব্যবসা করতে এসে, দেশটাকে লুটপাট করে ফোঁপরা করে দিয়ে গেছে, তাঁদের উত্তরসূরিরা কি এই নাম বদল দেখলে উল্লসিত হবে না? তারা তো ভারতে ব্যবসা করেনি বা ভারতকে লোটেনি। তারা তো ‘ইন্ডিয়া’-কে শোষণ এবং শাসন করেছে। ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে পারলে কি সমস্ত পক্ষেরই লাভ হয় না? ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ শব্দটাই তো আর উচ্চারিত হবে না।

আগামী শীতকালীন অধিবেশনে হয়তো নরেন্দ্র মোদি সরকার এই ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটির পরিবর্তে ‘ভারত’ লেখার প্রস্তাব আনবে সংবিধান সংশোধন করে। তাই তার আগেই এনসিইআরটি এই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি। সম্প্রতি শেষ হওয়া জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনেও কিন্তু ‘ভারত’ কথাটি দেখা গেছে। সুতরাং সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি সবদিক দিয়ে প্রস্তুত হয়েই এগোচ্ছে কীভাবে আগামীদিনে ইন্ডিয়াকে শুধু ভারত নয়, হিন্দু রাষ্ট্র বানানো যায়। কিন্তু তা প্রতিরোধ করতে আমরা কি প্রস্তুত?

২০২১ সালের বাংলার নির্বাচনের আগে বাংলার বেশ কিছু শিল্পী, বুদ্ধিজীবি এবং চিত্রতারকা মিলে একটা গান তৈরি করেছিলেন যা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।

তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস
ইতিহাসকে বলো পুরানো
তোমার কাজ শিক্ষাকে লাঠিপেটা করে
মূর্খের জ্বালা জুড়ানো
তোমার ভক্তিতে দাগ রক্তের
তুমি কাউকেই ভালোবাসো না
তুমি বেসাতি করতে এসেছ
দেশপ্রেমের কিছুই জানো না

সেই গানের রেশ ধরেই বলা যায়, আজকে এনসিইআরটির যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার মধ্যেও এই একই উদ্দেশ্য আছে। পুরাণ এবং ইতিহাসকে সঙ্ঘ পরিবার গুলিয়ে দিতে চাইছে। যার মধ্যে দিয়ে ক্ষতি হবে আগামী প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের, যারা হয়তো জানবেই না একদিন সংবিধানে লেখা ছিল, INDIA অর্থাৎ ভারত এই শব্দদুটোর মধ্যে কোনও মৌলিক তফাৎ নেই।

More Articles