পাকিস্তানের 'জিহাদি জেনারেল'! কতখানি ক্রূর সেনা প্রধান মুনির?
Pakistan Army Chief Asim Munir: সেনা প্রধান আসিম মুনির বলেছিলেন, "পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য এবং নীতি হলো শহিদ অথবা গাজী (যে জিহাদে অংশ নেয়) হওয়া।"
ঝড় উঠেছে ভারত পাকিস্তানের সম্মিলিত মহাকাশে। এই ঝড়ের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। পাকিস্তানে সেনাপ্রধানদের চরিত্র বরাবরই রঙিন, কঠিন আবার আঁধারময়। ২০১৯ সালে কুখ্যাত পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা, ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই-এর প্রধান ছিলেন মুনির। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালেরই ১৪ ফেব্রুয়ারি সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের ৪০ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছিল ভয়াবহ পুলওয়ামা হামলায়। সেই ঘটনার পর ছয় বছর কেটে গেছে। মুনির, যিনি এখন কার্যাত পাকিস্তানের সুপ্রিমো। এবার ভারতে পহেলগাঁও হামলা ঘটল। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের মনোরম বৈসরন তৃণভূমিতে এলাকায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয়কে গুলি করে হত্যা করা হলো। তারপর থেকেই ভারত এই হামলার প্রত্যুত্তর দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। পাকিস্তানও পাল্টা ঘুঁটি সাজিয়েছে। আর তাতে আসিম মুনিরের ভূমিকা তুখোড়।
ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৮ সালে মুনিরকে আইএসআই প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন, কিন্তু নয় মাস পরে তাঁকে সরিয়েও দেন কারণ মুনির ইমরানের স্ত্রী বুশরা বিবির দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেছিলেন। মুনির এই বরখাস্ত হওয়ার ঘটনার জন্য ইমরান খানকে কখনই ক্ষমা করতে পারেননি, চেয়েছিলেন বদলা নিতে। ২০২২ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী-পরিকল্পিত 'সংসদীয় অভ্যুত্থানে' ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর, ইমরানের বিরোধী শাসক জোটের সমর্থনে মুনির সেই বছরের নভেম্বরে সেনাপ্রধান হন। এর কয়েক মাস পরেই, মুনির ইমরানকে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগে জেলে পাঠান। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে এই বছরের শুরুতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-কর্নেল সোফিয়া কুরেশি: একতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে অপারেশন সিঁদুরের মাস্টারস্ট্রোক
পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানকে উপযুক্ত 'সবক' শেখাতে আসিম মুনিরের ব্যক্তিত্ব, মানসিক চিন্তার স্তর, শক্তি এবং দুর্বলতাগুলিকে নজরে রাখা, বিশ্লেষণ করা ভারতের প্রত্যাঘাতের অন্যতম কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। মুনির এমন একটি সেনা বাহিনীর প্রধান যা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম বাহিনী, যাদের পারমাণবিক অস্ত্রও রয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ রেখায় ভারতীয় সৈন্যদের প্রতিক্ষণে হামলা করতে প্রস্তুত তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ভারত আর পাকিস্তানের লরাই কিন্তু ইজরায়েল বনাম হামাস বা আজারবাইজান বনাম আর্মেনিয়ার মতো কোনও অসম যুদ্ধ নয়। এটি দু'টি সবচেয়ে পেশাদার সেনাবাহিনীর মধ্যের সংঘাত যারা প্রায় সমতুল্য এবং পারমাণবিক ক্ষমতাসম্পন্ন। ফলে যে তরফেই আঘাত হোক, পাল্টা আঘাত আসবে এবং ভালো পরিমাণেই আসবে।
আসিম মুনির হলেন সেই বিরল পাকিস্তানি জেনারেল যিনি আইএসআই-এর প্রধান এবং সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক ছিলেন। তাই হামলার কৌশল যে নিখুঁত করার চেষ্টা তিনি করবেন তা অনুমেয়। পহেলগাঁও হামলার পর ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত করে বুঝিয়ে দেয়, টক্কর সমানে সমানে। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনিরের সমস্ত পদক্ষেপ দ্বিতীয়বার বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। তাঁর আচরণ এবং বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বিশদ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও জরুরি।
ইমরান খানের গ্রেফতারির পর কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও পরে মুনির সেনাবাহিনীর উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন। পাকিস্তানের নিরাপত্তা আধার হয়ে উঠেছেন, এমনকী রাজনৈতিক ক্ষমতার সকল স্তরও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছেন। সেনাবাহিনী পরিচালিত বিশেষ বিনিয়োগ সুবিধা কাউন্সিলের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি সামালও দিয়েছেন। এমনকী মুনির বিচারকদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সংসদে একটি সংশোধনী পাস করিয়ে সুপ্রিম কোর্টকেও প্রায় দখলে রেখেছেন। সংশোধনী পাস করিয়ে তাঁর মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছরও করে দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত চালকের আসনে থাকবেন তিনি এবং পরবর্তী মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য কোনও বয়সসীমাও আর থাকবে না।
সেনাপ্রধান হওয়ার পর মুনির বহু সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা তো ছিলই, অর্থনীতিও ভেঙে পড়ার মুখে ছিল, সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান ঘটছিল এবং সেনাবাহিনীতেও অভ্যন্তরীণ বিরোধ ছিল। অন্যদের তুলনায় এই সমস্যাগুলির দক্ষ মোকাবিলা করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশ পরিচালনায় চিরকালই বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। জন্মের পর থেকে গত ৭৭ বছরে, দেশটি ৩৩ বছরে তিনটি ভিন্ন পর্যায়ে সামরিক আইনের অধীনে ছিল। জেনারেল জিয়া-উল হকের পর মুনিরই প্রথম সেনাপ্রধান যিনি ইসলামিক জাতীয়তাবাদকে আহ্বান জানিয়েছেন। মুনির একজন হাফিজ-ই-কুরআন, অর্থাৎ এমন একজন যাঁর কুরআন মুখস্থ। আসিম মুনিরের বাবা সৈয়দ সারওয়ার দেশভাগের পর জলন্ধর থেকে চলে এসেছিলেন। রাওয়ালপিন্ডির একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন সৈয়দ সারওয়ার। মুনির নিজে পড়েছিলেন গ্যারিসন শহরের একটি মাদ্রাসায়। অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
মুনিরের ঠিক আগে, ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাজওয়া পাকিস্তানের রাজনীতির দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁর আমলেই পুলওয়ামা হামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী শিবিরগুলিতে বিমান হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ভারতের এটিই ছিল প্রথম বিমান হামলা। বাজওয়ার মেয়াদের শেষের দিকে, তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, তাঁর দেশকে আঞ্চলিক সংযোগ, বাণিজ্য এবং উন্নয়ন অংশীদারিত্ব অনুসরণ করে অর্থনৈতিকভাবে নিজের ঘর গোছাতে হবে, এমনকী ভারতের সঙ্গেও সুসম্পর্কে আসতে হবে। আন্তরিকতার নিদর্শন হিসেবে তিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়ন্ত্রণ রেখায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেন, যা চার বছর স্থায়ী হয়েছিল। তারপরেই মুনির পহেলগাম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন এবং যুদ্ধবিরতি ভাঙেন।
আরও পড়ুন-বিশ্বাসঘাতকতার সাত দশক! কেন বালুচিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?
মুনির সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক পরিসরে অবাধে ভিন্নমত দমন করেছিলেন। ২০২৩ সালের শেষের দিকে, মুনির পাকিস্তানে ১৫০,০০০ এরও বেশি আফগান শরণার্থীকে বহিষ্কার করেছিলেন, যার ফলে তিনি আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালিবানদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেউ, মুনির পাকিস্তানের বাইরে কর্মরত একটি ইরানি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর উপর তেহরানের ড্রোন হামলার পর ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে দ্বিধা করেননি। স্বাধীন বেলুচিস্তানের দাবিতে সোচ্চার বেলুচিস্তান বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধেও মুনির কঠোর পদক্ষেপ করেছেন। তবে তাঁদের দমানো যায়নি। মুনির বারবার ভারতকে বালুচ এবং টিটিপি বিদ্রোহীদের উস্কে দেওয়ার বা সমর্থন করার জন্য দোষারোপ করেছেন। পাকিস্তানের অনেক বিশেষজ্ঞই এটিকে পহেলগাঁও হামলার যুক্তি হিসেবেও তুলে ধরেছেন।
মুনির সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আরও মাথাচাড়া দিয়েছে। ২০২৩ সালের অগাস্টে পেশোয়ারে এক উপজাতীয় জিরগায় (কাউন্সিল) ভাষণে মুনির ঘোষণা করেছিলেন, "পৃথিবীর কোনও শক্তি পাকিস্তানের ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা আল্লাহর পথে জিহাদ (পবিত্র যুদ্ধ) করছি এবং সাফল্য আমাদেরই হবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য এবং নীতি হলো শহিদ অথবা গাজী (যে জিহাদে অংশ নেয়) হওয়া।" পহেলগাঁও হামলার ছয় দিন আগে, ১৬ এপ্রিল এক কনভেনশনে মুনির দ্বি-জাতি তত্ত্বের পুনরাবৃত্তি করেন এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৩৭০ ধারা বাতিল, নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং উপত্যকায় পর্যটকদের ঢল বাড়ায় কাশ্মীরের পরিস্থিতি নয়াদিল্লির পক্ষে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই উপত্যকার শান্তি ও স্থিতিশীলতার ভ্রম ভাঙতে ২০০৮ সালের মুম্বইয়ের মতো বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা জরুরি হয়ে পড়েছিল। মুনির এইসব হামলা পরিকল্পনার পাশাপাশিই আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকা আইসিস-কে কমান্ডার মহম্মদ শরিফুল্লাহকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত করে ট্রাম্পের পাশে থাকেন। শরিফুল্লাহ অ্যাবে গেটে ভয়াবহ বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল। আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় ১৩ জন মার্কিন সেনা নিহত হন ওই হামলায়। ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানান। গ্রেফতারের খবর প্রকাশ্যে আসার এক সপ্তাহ আগেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৬ বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাকিস্তানকে ৩৯৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়। পহেলগাঁওয়ের পর, ট্রাম্প সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করলেও পাকিস্তানকে দোষারোপ করেননি। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের এই বিরোধ "হাজার হাজার বছর ধরে চলছে" এবং দুই দেশের একসঙ্গে এর সমাধান করা উচিত। চিন এবং তুরস্ক সন্ত্রাসী হামলার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। গত দুই বছর ধরে, পাকিস্তান এই দুই দেশ থেকে অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনছে, চিন থেকে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জামও কিনছে।