২০২৪ এর আগেই কেন 'ফেল' কংগ্রেস : সুমন চট্টোপাধ্যায়
Assembly Polls Results 2023 : এবারের ভোটে কংগ্রেস অন্তত তিনটি রাজ্যে সরকার গড়তে পারলে বিজেপি বিরোধী জোটের অবিসংবাদিত নেতা হতেন রাহুল। আর হবেন না।
কোনও ভ্যানতারা নয়, অযথা শব্দ নিক্ষেপ নয়, রবিবার চার রাজ্যে (মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা) ভোটের ফলাফল নিয়ে আমার দু’কড়ির মূল্যায়ন চুম্বকে বলে দেওয়া যাক।
সমীক্ষকদের গালে মুড়ো ঝাঁটা
ইচ্ছে হোক অথবা অনিচ্ছায়, দশ দশটি সমীক্ষার একটিরও এক্সিট পোল মেলেনি। দশটির মধ্যে নয়টি বলেছিল, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস ফের সরকার গড়বে। মধ্যপ্রদেশের ফল নিয়ে তাদের সমীক্ষা ছিল দ্বিধাবিভক্ত, সেখানে যে ১৮ বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও বিজেপির এমন বিপুল জয় হবে কেউ আঁচই করতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য রাজস্থান সম্পর্কেও। একমাত্র তেলেঙ্গানা সম্পর্কে সমীক্ষার ইঙ্গিত মিলে গেছে। তাও তাদের কৃতিত্বে নয়। সেখানে বিআরএসের বিরুদ্ধে যে আঁধি উঠেছিল তাতে সমীক্ষা না চালিয়েও ফলাফল চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যেত। খবরের টেলিভিশনের গোপাল ভাঁড়কুল তথাপি বগল বাজিয়ে যাচ্ছে, মজ্জাগত বদভ্যাস মতো বলে চলেছে, ‘আমরাই কিন্তু ঠিক বলেছিলাম।’ বেহদ্দ নির্লজ্জের দল।
এক এক রাজ্যে এক এক রকম
প্রতিটি রাজ্যে জয় পরাজয়ের কারণাবলী স্থানিক, তাদের বিশেষ কোনও একটি ন্যারেটিভে ফেলা যায় না। যেমন, তেলেঙ্গানায় যদি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করে থাকে, মধ্যপ্রদেশে তা হয়নি। বরং মধ্যপ্রদেশেই টানা ১৮ বছর ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধেই জনরোষ প্রতিফলিত হওয়ার কথা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যায় অনেক পণ্ডিতমশাই বলছেন ভোটের অব্যবহিত আগে শিবরাজ সিং চৌহানের ‘লাডলি বহেন যোজনা’ নাকি পাশার দান শেষ প্রহরে উল্টে দিয়েছে। তাহলে রাজস্থানে অশোক গেহলত সরকারের অসংখ্য গরিবমুখী সরকারি কর্মসূচি মাঠে মারা গেল কেন? গেহলতের সরকার গত পাঁচ বছরে অসংখ্য বিষয়ে যেভাবে গরিবের সেবা করেছে হিন্দি বলয়ে তা তুলনারহিত। তা সত্ত্বেও শিবরাজের ক্ষেত্রে যা সত্য হলো গেহলতের ক্ষেত্রে হলো না। কেন?
আরও পড়ুন- আদানি অস্ত্রে কাবু হবেন মোদি? : সুমন চট্টোপাধ্যায়
জোর ধাক্কা খেল রাহুলের ক্যারিশমা
এবারের ভোটে কংগ্রেস অন্তত তিনটি রাজ্যে সরকার গড়তে পারলে বিজেপি বিরোধী জোটের অবিসংবাদিত নেতা হতেন রাহুল। আর হবেন না। ভারত জোড়ো যাত্রার মহিমা নিয়ে আর কীর্তন গাওয়া যাবে না, গাইলে লোকে প্যাঁক দেবে। অর্থাৎ নেতৃত্বের প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদি রাহুলের তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ যেমন এগিয়ে ছিলেন, তেমনই থাকবেন। বিজেপি বিরোধী জোটে কংগ্রসকে দাদাগিরি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, তামাক খেতে হবে আঞ্চলিক দলগুলির হাতে। সেক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে দুই-কংগ্রেস আবার জোট বাঁধবে কিনা নতুন করে সেই জল্পনা শুরু হবে।
কংগ্রেসের ভুল তাস
কাস্ট সেনসাস বা জাতপাত ভিত্তিক সমীক্ষা। এবারের ভোটে এটাই ছিল কংগ্রেসের প্রচারের মূল এজেন্ডা। রাহুল এমনভাবে প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে এই সমীক্ষা দাবি করছিলেন যে মনে হচ্ছিল প্রয়াত বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং যেন তাঁর উপরে ভর করেছেন। বোঝা যাচ্ছিল, রাহুল চাইছেন কমণ্ডলকে রুখতে তিনিও মণ্ডল ২.০ খাড়া করে বাজিমাত করবেন। পারলেন না বরং লোক হাসালেন।
একটি কারণ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ইন্দিরা তনয়ের মন রাখতে জাত সুমারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাশ করলেও কংগ্রেসের অন্দরে এ নিয়ে ঐকমত্য নেই। কেননা এমন একটি দাবি করার মতো রাজনৈতিক বা নৈতিক অবস্থানে কংগ্রেস আছে কিনা, কিংবা এর পক্ষে-বিপক্ষে কী কী যুক্তি আছে তা নিয়ে কংগ্রেসে খোলামেলা আলোচনাই হয়নি। যেমন কর্নাটকের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া তাঁর নিজের রাজ্যে জাত-সুমারি সম্পন্ন করে হাতে রিপোর্ট নিয়ে বসে আছেন কিন্তু শিবকুমার কিছুতেই তা প্রকাশ করতে দিচ্ছেন না হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায়। জাতপাতের রাজনীতি কংগ্রেসের সনাতনী ঐতিহ্যের বিরোধী রাহুল সে কথা বোঝেন কিনা বলা মুশকিল, তাঁকে উচিত পরামর্শ দিয়ে বোঝানোর মতো কেউ আছেন কিনা সেটাও জানা নেই। তদোপরি হঠাৎ ওবিসিদের জন্য কংগ্রেসের মড়াকান্না ভোটারদের কাছে যৎপরোনাস্তি অপরিচিত ও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে কেননা কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃত্বে ওবিসি মুখ নামমাত্র। নীতীশ কুমার, লালু অথবা অখিলেশ যাদবের পক্ষে যেটা সহজভাবে মানিয়ে যায়, অনেক কষ্ট করেও রাহুলকে তা মানায় না। হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওবিসি, ওবিসি করে চেঁচালেই কি রাতারাতি তাদের আস্থা অর্জন করা যায়? সেই সারসত্যটি জানেন বলেই বিজেপি এই স্পর্শকাতর ইস্যুতে প্রত্যাঘাতের রাস্তায় হাঁটেনি, নাদানের আস্ফালন দেখে কেবল একটু মুচকি হেসেছে মাত্র। সর্বোপরি সমীক্ষার খুড়োর কল দেখালে এমনকী ওবিসি ভোটারও তার তাৎপর্য বুঝতে পারবেন না যদি না সমীক্ষা করলে সেটা কীভাবে তাঁদের উপকারে আসবে জলবৎ তরলং করে সেটা তাঁদের বোঝানো যায়। জিতনা আবাদি উতনি হক একটি ছেঁদো কথা, প্রথম মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট লাগু হওয়ার পরে অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংরক্ষণের যে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে তা লঙ্ঘনই বা করা যাবে কোন উপায়ে?
আরও পড়ুন- ৫ রাজ্যের ভোটেই উল্টোচ্ছে গদি? সেমিফাইনালেই হাসি ফুটবে ইন্ডিয়া জোটের মুখে?
ম্যান অব দ্য ম্যাচ
এক এবং অদ্বিতীয় শিবরাজ সিং চৌহান, মধ্যপ্রদেশের ভোটের প্রচারে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যাঁকে কোনও গুরুত্বই দেননি, পদে পদে হেনস্থা করেছেন, দিল্লি থেকে আধ ডজন মন্ত্রী-সাংসদকে রাজ্যে পাঠিয়ে তাঁর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এতৎসত্ত্বেও শেষ হাসিটা কিন্তু ‘মামাজিই’ হাসলেন। এমন অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে কিনা কয়েক দিনের মধ্যে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যদি হয় রাজনীতির নিকৃষ্টতম অবিচার হিসাবে ইতিহাসে তা চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
সেরা ব্যাটসম্যান
অবশ্যই তেলেঙ্গানার রেবন্তী রেড্ডি যিনি বিজেপি, টিডিপি, টিআরএস সব ঘাটের জল খেয়ে কংগ্রেসে এসে দলকে অপ্রত্যাশিতভাবে জিতিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ ভারত থেকে কার্যত সাফ হয়ে গেল বিজেপি, রেবন্তী এবং রাজশেখর রেড্ডির কন্যার হাত ধরে এবার অন্ধ্রপ্রদেশেও প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হলো কংগ্রেসের সামনে। এবারের ভোটে তেলেঙ্গানাই কংগ্রেসের একমাত্র সান্ত্বনা পুরস্কার।
লোকসভা ভোটে প্রভাব
বিধানসভা আর লোকসভা ভোটে সম্পূর্ণ আলাদা চিত্র ফুটে ওঠে এই তত্ত্ব মানলে বিজেপির নতুন করে তেমন কিছু লাভ হলোনা, অন্তত অঙ্কের বিচারে। কেননা গত লোকসভা ভোটে এই চারটি রাজ্যের মোট ৬৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি একাই পেয়েছিল ৬৩টি আসন যার মধ্যে চারটি আসন ছিল তেলেঙ্গানায়। কংগ্রেসের বিধানসভা ভোটে সাফল্য তাই তেলেঙ্গানায় বিজেপির কিঞ্চিৎ শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে এই মাত্র। তবে তিন রাজ্যে এমন বিপুল সাফল্য মনস্তাত্বিকভাবে বিজেপির শক্তিশালী পেশিতে আরও বল জোগাবে, আরও প্রশস্ত করে দেবে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যাবর্তনের রাস্তা।