শেয়ার বাজারের রাজা! কোটিপতি হয়েও কেন কোঁকড়ানো শার্ট পরতেন রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা?
এত সম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার সময় তাঁর পরনে ছিল অতি সাধারণ একটি কোঁকড়ানো ঢিলেঢালা সাদা শার্ট।
বিগত ১৪ অগাস্ট স্টক মার্কেটের বিনিয়োগকারীদের কার্যত অভিভাবকহীন করেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন ভারতের ওয়ারেন বাফেট, রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা। একটা দীর্ঘ সময় যাবৎ তিনি ছিলেন ভারতের স্টক মার্কেটের সবথেকে বড় খেলোয়াড়। বলা হতো, রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা কখনও ভুল হতে পারেন না। ভারতের স্টক মার্কেটে তার থেকে উঁচুমানের বিনিয়োগকারী ভারত খুবই কমই দেখেছে বলা চলে। ১৯৯২ সালের হর্ষদ মেহতার সেই কুখ্যাত জালিয়াতির ঘটনার পরে যখন শেয়ার বাজার কার্যত বিপন্ন, সেই সময়ে স্টক শর্ট করে বিনিয়োগ করে নতুন আয়ের পথ বাতলে দিয়েছিলেন রাকেশ। সেই থেকে শুরু। তারপর এগিয়েছে সময়, এসেছেন নতুন বিনিয়োগকারীরা, এসেছে নতুন কোম্পানির শেয়ার, কিন্তু বিগ বুল রয়ে গেলেন তাঁর নিজের পুরনো জায়গাতেই।
ফোর্বসের তালিকায় একটা সময় বিত্তবান ভারতীয়দের তালিকায় একদম ওপরের দিকে অবস্থান করতেন রাকেশ। তার নেট ওয়ার্থ ছিল ৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, টাকার পাহাড়ের অধিকারী হলেও জীবনযাপন ছিল একেবারেই আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয়র মতোই। সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিং, এটাই ছিল রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার দর্শন। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, সেই সময়েই তাঁর একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়ে ওঠে ভাইরাল। এত সম্পত্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার সময় তাঁর পরনে ছিল অতি সাধারণ একটি কোঁকড়ানো ঢিলেঢালা সাদা শার্ট। স্বভাবতই ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা হয়ে ওঠেন টক অফ দ্য টাউন।
রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ট্যুইট-এর মাধ্যমে ভারতবাসীর উদ্দেশে ব্যক্ত করতেই এই ছবিটি ব্যবহার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সেই সময় হয়তো তিনি জানতেন পর্যন্ত না, এই একটি ছবিই হয়ে উঠবে সোশ্যাল গসিপের কেন্দ্রবিন্দু। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, রেডিটের মতো মাধ্যমে মিম মেটিরিয়াল থেকে শুরু করে পাড়ার রকের চায়ের চর্চাতেও উঠে আসে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার এই সাদা জামাটি।
আরও পড়ুন: শেয়ার বাজারে তাঁর ভবিষ্যৎবাণী ছিল অব্যর্থ, যে পথ দেখিয়ে গেলেন দালাল স্ট্রিটের বিগ বুল
এই ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে যখন ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে তিনি বক্তৃতা রাখতে আসেন, সেই সময় সাংবাদিকদের মুখরোচক প্রশ্নের বিষয়বস্তুও হয়ে ওঠে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার সেই বিতর্কিত সাদা শার্ট। তবে, এইবার আর প্রশ্ন এড়ানো গেল না। অবশেষে সেই সাদা শার্ট বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলতেই হলো রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা বললেন, "আমার সাদা জামাটি এভাবে অদ্ভুতভাবে কুঁকড়ে গেছে, এটা আমি আগে বুঝতে পারিনি। আমি ৬০০ টাকা খরচ করে এই জামা ইস্ত্রি করিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও কেন যে এরকমভাবে জামাটা কুঁকড়ে গেল, তা আমি বলতে পারব না। তবে আমি এরকম ধরনের পোশাক মাঝেমধ্যেই পরে থাকি। কোঁকড়ানো শার্ট আমার জন্য নতুন কিছু নয়। আমি অনেক সময় শর্টস পরে অফিসেও গিয়েছি। কোন ক্রেতা অথবা কোন ক্লায়েন্ট না থাকলে আমি সেই দিনটা নিজের মতো করেই কাটাতে পছন্দ করি।"
তাঁর স্ত্রীর কাছেও রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা অতি সাধারণ একজন ব্যক্তি। রাকেশ কোটিপতি হলেন কি হলেন না, এটা নিয়ে রেখা খুব একটা মাথা ব্যথা করেন না। রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার কথায়, "যদি আমার কাছে খুব একটা বেশি সম্পত্তি নাও থাকত, তাহলেও হয়তো আমার পারিবারিক দিক থেকে তেমন কোনও সমস্যা হতো না। হ্যাঁ হয়তো, এতটা বিলাসবহুলভাবে আমি জীবন কাটাতে পারতাম না, তবে ঠিকঠাক মানিয়েগুছিয়ে চালিয়ে নেওয়া যেত।"
তবে জীবনযাপনের দিক থেকে অতি সাধারণ হলেও শেয়ার মার্কেটের জগতে ঝুনঝুনওয়ালা ছিলেন এক ধ্রুবতারা। শেয়ার বাজারে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি এমন অনেক কথা বলেছেন, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকারীদের জন্য হতে পারে গুরুমন্ত্রের সমান। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার সময় যেগুলো মাথায় রাখা উচিত এবং কখন সতর্ক হওয়া উচিত, এমন অনেক বিষয় নিয়েই আলোচনা করতেন তিনি। আর এই গুরুমন্ত্রগুলি অনুসরণ করলেই ভারতীয় স্টক মার্কেট বিনিয়োগের সমস্ত ভালো এবং খারাপ দিকের ব্যাপারে জানা যায়।
নিবেশ করার আগে করুন হোমওয়ার্ক
আপনি যদি কোনও একটি শেয়ারে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করে থাকেন তাহলে সবার আগে প্রয়োজন হোমওয়ার্ক। সেই শেয়ারের ব্যাপারে না জেনে কখনওই সেই শেয়ারে বিনিয়োগ করাটা যুক্তিসংগত নয়। সবসময় সেই কোম্পানির শেয়ার কেনার চেষ্টা রাখুন, যে কোম্পানি শিরোনামে রয়েছে। আগে সেই কোম্পানির স্টকের মূল্যায়ন করে নিন। তারপরে শেয়ারে বিনিয়োগ করুন।
লোকসানের জন্য তৈরি থাকুন
শেয়ার মার্কেটে যে কোনও সময় ওঠানামা হতেই পারে। কখনও কখনও এমন হয় যে, আপনি শেয়ার মার্কেটে দারুন মুনাফা কামিয়ে নিলেন। আবার কখনও এমনও হতে পারে, আপনার বিনিয়োগ করা শেয়ারটি ক্ষতির সম্মুখীন হলো। তাই শেয়ার মার্কেটে লাভ এবং লোকসান দুটোই রয়েছে। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে হলে আপনাকে লোকসানের দিকটা মাথায় রেখে তবেই নামতে হবে। তাই কখনওই ধার নিয়ে বিনিয়োগ করবেন না। সব সময় এমন জায়গায় বিনিয়োগ করবেন, যেখানে আপনার লোকসান হলেও তেমন কোনও ক্ষতি হবে না।
বাজারকে সম্মান করুন
শেয়ার মার্কেটের জগতে যদি আপনাকে নাম কামাতে হয় তাহলে আপনাকে বাজারকে সম্মান করতে হবে। তার পাশাপাশি আপনাকে নিজের মস্তিষ্ক খোলা রাখতে হবে। কোন শেয়ার কিনতে হবে, কখন বিনিয়োগ করতে হবে, কখন লোকসান গুনতে হবে, সবকিছুই আপনাকে ধীরে ধীরে শিখতে হবে নিজে। তাই সবসময় বাজারকে সম্মান করুন এবং শেয়ার বাজারের নিয়মগুলিকে মেনে চলার চেষ্টা করুন।
সিদ্ধান্ত নিতে তাড়াহুড়ো করবেন না
শেয়ার মার্কেট সকলের জন্য উন্মুক্ত একটি মার্কেট। এই মার্কেটে যে কেউ যে-কোনও সময় বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে অনেকে এমন রয়েছেন, যাঁরা বিনিয়োগের আগে কারও সঙ্গে পরামর্শ করেন না বা নির্ণয় গ্রহণের আগে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে ফেলেন। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো আপনার সমূহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আপনার শেয়ার বাজারের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ একেবারে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
আত্মবিশ্বাস রাখুন এবং সাহসী হন
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে গেলে আপনাকে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। যদি আপনি প্রথমেই ভাবেন, এসেই একটা বড় দামের শেয়ার কিনে লাখপতি হয়ে যাবেন, তাহলে সেটা ভুল ধারণা। প্রথমে ছোট ছোট দামের শেয়ার কিনে ধীরে ধীরে টাকা রোজগার করতে হবে এবং তার সঙ্গেই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরেই আপনি বড় শেয়ারের ওপরে হাত দিতে পারেন। তবে যদি আপনার প্রথম বিনিয়োগ লোকসানের মুখ দেখে তাহলেও শেয়ার মার্কেট থেকে সরে আসবেন না। বরং শেয়ার মার্কেটে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটান। নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখুন। প্রথমবার লোকসান হলে দ্বিতীয়বার দীর্ঘমেয়াদি শেয়ার কিনে চেষ্টা করুন। শেয়ার বাজারে টিকে থাকলে অবশ্যই আপনিও সাফল্য পাবেন একদিন না একদিন।