কেন আদানির বিরুদ্ধে তদন্ত হয় না? সেবির প্রধানের সত্য ফাঁস হিন্ডেনবার্গের নতুন রিপোর্টে

Hindenburg New Report: 'সেবি'র চেয়ারম্যান মাধবী পুরি বুচ ও তাঁর স্বামী স্বয়ং আদানি শেয়ার ঘোটালার (Adani money siphoning scandal) সঙ্গে সরাসরি যুক্ত!

এক বছরের ব্যবধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শর্ট সেলার কোম্পানি হিন্ডেনবার্গের নতুন রিপোর্ট আবার হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিল আদানি গোষ্ঠী ও ভারত সরকারের অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে। এবারের রিপোর্টের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, দেশে কর্পোরেট আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে সরকারি এজেন্সির হাতে অর্থাৎ 'সেবি'র (সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) চেয়ারম্যান মাধবী পুরি বুচ ও তাঁর স্বামী স্বয়ং আদানি শেয়ার ঘোটালার (Adani money siphoning scandal) সঙ্গে সরাসরি যুক্ত!হিন্ডেনবার্গের নির্দিষ্ট অভিযোগ, আদানিদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ার, কারণ সেবির নিষ্ক্রিয়তা। সোজা বাংলায় যাকে বলে, সর্ষের মধ্যেই ভূত!

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২০২২ সালের শেষের দিকে এই হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আর্থিক জগতে হইচই ফেলে দেয় আদানিদের ব্যবসা সংক্রান্ত একাধিক জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে; "brazen stock manipulation and accounting fraud scheme over the course of decades"। আদানিরা যথারীতি এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং এই রিপোর্টকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও অগ্রগণ্য শক্তি হিসাবে ভারতের উঠে আসার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র বলে দাগিয়ে দেয়। অবশ্য আদানিদের প্রতিবাদ ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি খুব একটা কাজে দেয়নি। বাস্তবে আদানিদের শেয়ারে ধস নামে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে গৌতম আদানির সম্পদ প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যায়। আন্তর্জাতিক আর্থিক মহলে বিষয়টা শুধু শেয়ারের ধসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ডাও জোনস সাসটেনেবিলিটি ইনডেক্স-এর তালিকা থেকে আদানি এন্টারপ্রাইজের নাম সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্রেডিট সুইস, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড, সিটি ব্যাঙ্ক আদানি গ্রুপ সম্পর্কে বিরূপ মূল্যায়ন প্রকাশ করে। প্রাথমিক পর্বে কিছুটা টালমাটাল চললেও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি, দেশের সরকারের সহযোগিতা ও আদানিদের বিরুদ্ধে তদন্তের ক্ষেত্রে সেবির পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়ে আদানিরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন- যে কোনও যোগাযোগই রাষ্ট্রের হাতে? যে ভয়াবহ টেলিকম আইন ২০২৩ চালু হচ্ছে দেশে

হিন্ডেনবার্গের এবারের রিপোর্টের মূল বিষয়গুলি হলো:

* সেবির বর্তমান চেয়ারপার্সন মাধবী পুরি বুচ ও তাঁর স্বামী দাভাল বুচের আদানি মানি সাইফনিং স্ক্যান্ডালের সঙ্গে যুক্ত দুটো অফশোর ফান্ডে শেয়ার আছে।

* এই ফান্ড দুটো নিয়ন্ত্রণ করেন গৌতম আদানির বড় ভাই কুখ্যাত বিনোদ আদানি। ফান্ড দু'টি ট্যাক্স হেভেন বারমুডা ও মরিশাসে রেজিস্ট্রিকৃত।

*রিপোর্ট অনুসারে, বুচ দম্পতি ২০১৫ সালের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে IPE PLUS FUND-1 এ অ্যাকাউন্ট খোলেন। ২০১৭ সালে দাভাল বুচ মরিশাস ফান্ড অ্যাডমিনেস্ট্রেটরের (ট্রিডেন্ট ট্রাস্ট) কাছে একটা চিঠি লিখে জানান যে, এবার থেকে তিনি একাই অ্যাকাউন্ট অপারেট করবেন। এই চিঠি লেখার কয়েকদিনের মধ্যে মাধবী বুচ সেবির পূর্ণ সময়ের সদস্য নিযুক্ত হন।

* নথিপত্র অনুসারে বলা যায়, মাধবী বুচ ও তাঁর স্বামীর গৌতম আদানি পরিচালিত এমন একটা ফান্ডে শেয়ার আছে যারা একাধিক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।

* হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ, আদানিদের বিরুদ্ধে সেবির তদন্তের অনীহার কারণ খোদ সেবির চেয়ারপার্সনই আদানিদের অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত।

* ২০১৭ (এপ্রিল) ও ২০২২ (মার্চ) সালে যখন মাধবী পুরি বুচ সেবির পূর্ণ সময়ের সদস্য তখন 'অ্যাগোরা পার্টনার্স' নামে সিঙ্গাপুরের একটি অফসোর কোম্পানিতে তাঁর ১০০ শতাংশ স্বার্থ জড়িত। সেবির প্রধান হওয়ার ঠিক দু' সপ্তাহ আগে মাধবীর শেয়ার তাঁর স্বামীর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হয়।

* কোনও রকম অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে দাভল বুচ ব্ল্যাকস্টোন কোম্পানির সিনিয়র অ্যাডভাইসার পদে নিযুক্ত হন। এই কোম্পানি 'অ্যাম্বাসি'-কে স্পনসর করে। অ্যাম্বাসি হলো ভারতের প্রথম রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (RIET)।

* বর্তমানে মাধবী বুচের ইন্ডিয়ান কনসাল্টিং বিজনেস এজেন্সি 'অ্যাগোর অ্যাডভাইসারিতে ৯৯% মালিকানা রয়েছে। এখানে তাঁর স্বামী ডিরেক্টর। ২০২২ সালে এই কোম্পানির আয় ছিল ২,৬১,০০০ মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রেও স্বার্থের সংঘাত (conflict of Interest) স্পষ্ট।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের গুরুত্ব সহজে বোঝার জন্য কয়েকটি শব্দের অর্থ বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।

* অফশোর: এই কথাটির অর্থ আন্তর্জাতিক অবস্থান বা জাতীয় সীমানার বাইরে অবস্থিত কোনও এলাকা।

* ট্যাক্স হেভেন: ট্যাক্স হেভেন বলতে বোঝায় সেই সমস্ত দেশ যেখানে কর আইন সহজ, করের পরিমাণ কম, যারা অন্য দেশের কর্তৃপক্ষকে সাধারণত তাদের বিদেশি সঞ্চয়কারীদের আয় সংক্রান্ত তথ্য শেয়ার করে না। কর ফাঁকির জন্য ও কালো টাকা রাখার জন্য এইসব দেশ আদর্শ। উদাহরণ - বারমুডা, বাহামা, মরিশাস, সেন্ট কিটস, লুক্সেমবার্গ প্রভৃতি।

* মিসইনভয়েসিং: বিশ্বায়নের যুগে কালো টাকা পাচারের এক উন্নত পদ্ধতির নাম 'মিসইনভয়েসিং' বা 'মিসপ্রাইসিং'। সোজা কথায়, এই বিষয়টি হলো রপ্তানির সময় দ্রব্যের অর্থমূল্য কম করে দেখানো, যাতে রপ্তানিজাত লাভের একটা বড় অংশ বেনামি বিদেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত রাখা যায় এবং রপ্তানিজাত আয় কম করে দেখানোর ফলে দেশেও কর ফাঁকি দেওয়া যায়। উল্টোদিকে আমদানির সময় খরচ বেশি করে দেখানোর ফলে হিসাবের খাতায় লাভের কড়ি কম করে দেখানোর দ্বারা বড় অংশের কর ফাঁকি দেওয়া যায়।

* শেল কোম্পানি: এগুলো সাধারণত কর্পোরেট সত্তা যাদের কোনও সক্রিয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম বা উল্লেখযোগ্য সম্পদ দখলে নেই। সরকার তাদের সন্দেহের চোখে দেখে কারণ তাদের অর্থ পাচার, কর ফাঁকি এবং অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন- হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের কাঠগড়ায় সেবি প্রধানরা! কী কী অভিযোগ রয়েছে সেবি প্রধানদের বিরুদ্ধে?

আদানিদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগের একটা বিষয় হলো বিভিন্ন অফশোর কোম্পানির আদানি গ্রুপে বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে পর্দা ফাঁস হয় ওসিসিআরপি রিপোর্টে (এই রিপোর্ট ৩১ আগস্ট, ২০২৩ দ্য গার্ডিয়ান ও ফিনান্সিসিয়াল টাইমসে প্রকাশিত হয়) দেখা যাচ্ছে আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোতে যে বিদেশি তহবিল এসেছে তার অর্ধেকটাই অস্বচ্ছ অফশোর কোম্পানি থেকে।

২০১৭-২০২২ সময়পর্বে আদানি গ্রুপে ফরেন ফান্ড ঢোকে ৫.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এসেছে এই ধরনের সন্দেহভাজন কোম্পানিগুলো থেকে। ফিনান্সিসিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, মরিশাসের দু'টি ফান্ড কোম্পানি এমার্জিং ইন্ডিয়া ফোকাস ফান্ড (ইআইএফএফ) এবং ই এম রিসার্জেন্ট ফান্ড (ইএমআরএফ) ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আদানিদের চারটি কোম্পানির প্রচুর শেয়ার কেনে। এই ফান্ডগুলোর মালিক হলেন দুই বিদেশি, নাসির আলি সাবন (সংযুক্ত আরব আমিরশাহি) এবং চ্যাং চুং লিন (তাইওয়ান)। এই টাকা আসে বারমুডার গ্লোবাল অপরচুনিটিস ফান্ড (জিওএফ) থেকে। ওসিসিআরপি রিপোর্ট দেখাচ্ছে, এই সমস্ত ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড আদতে এক্সেল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভাইসারি সার্ভিস লিমিটেডের হয়ে বিনিয়োগ করছে এবং এই কোম্পানির মালিক হলেন বিনোদ আদানি। এ কথার অর্থ হলো, নাসির আলি ও চ্যাং চুং লি-এর সংগঠনগুলি আদতে গৌতম আদানির ফ্রন্টাল সংগঠন। এই কেনাবেচা দেশের আইনের সরাসরি উলঙ্ঘন। এবারের রিপোর্টের ভয়ংকর বিষয় হলো, এই গ্লোবাল অপরচুনিটিস ফান্ডের অংশীদার হলেন সেবি চেয়ারম্যান মাধবী বুচ ও তাঁর স্বামী।

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট বলছে, শেয়ার মার্কেটে স্বচ্ছতা ও আর্থিক দুর্নীতি ধরবার ক্ষেত্রে যে এজেন্সির ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করার কথা, তারই প্রধান দুর্নীতিতে যুক্ত। গত একবছর ধরে আমরা দেখছি, একাধিক অভিযোগ বার বার এই অমিত শক্তিধর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে উঠছে। শুধু হিন্ডেনবার্গ নয়, ওসিসিআরপি রিপোর্ট একাধিক তথ্য সামনে এনেছে। সরকারি সংস্থা ডাইরেক্টরেট অব রেভেনিউ ইনটেলিজেন্স (ডিআরআই) তাদের রিপোর্টে আদানিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি আমদানির সময় দাম বাড়িয়ে দেখানোর (ওভারপ্রাইসিং) অভিযোগ এনেছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে জোচ্চুরি ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। অথচ নিয়ামক সংস্থা হিসাবে সেবি কোনও তদন্তই করেনি। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত এক্সপার্ট কমিটির পর্যবেক্ষণ উল্লেখযোগ্য: "SEBI had in 2018 diluted and in 2019, entirely deleted the reporting requirements relating to the ultimate beneficial (i.e actual) ownership of foreign funds"। এই অবস্থায় মাধবী বুচকে পদে রেখে কোনও তদন্তই সম্ভব নয়। এমনকি কোনও সরকারি এজেন্সির উপরই ভরসা রাখা সম্ভব নয় কারণ আজকের লগ্নিপুঁজি নির্ভর, একচেটিয়া আগ্রাসনের সময় আদানিদের ব্যবসা করার মডেলই উন্নয়নের প্রতীক। বিরোধী পক্ষ জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠনের মাধ্যমে তদন্ত দাবি করছেন, যদিও 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গার' ধ্বজাধারীরা সে প্রস্তাব মানবেন বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় জনগণের সক্রিয়তার উপরই ভরসা রাখতে হবে।

More Articles