ইজরায়েলকে এত দিন ঢালাও অস্ত্রসাহায্য বাইডেনের, যুদ্ধ থামাতে চাইবেন ট্রাম্প?
Israel America Relationship: বাইডেন জমানা তো শেষ। নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকেও কি একই রকম সহায়তা পেতে চলেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু? নাকি বদলাতে চলেছে সামগ্রিক সমীকরণই?
আমেরিকায় বদলে গেল সরকার। চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজের দখল আবার রিপাবলিকানদের হাতে। ২০২০ সালে ট্রাম্পকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন। আর বাইডেন-ট্রাম্প পালাবদলের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে একাধিক যুদ্ধ। যে সব যুদ্ধ শুরু তো হয়েছে, কিন্তু কার্যত তা শেষ হওয়ার নাম নেয়নি। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ তো ছিলই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইজরায়েলের সঙ্গে গাজার যুদ্ধ। শুধু কি তাই, তার পরে একে একে লেবানন ও ইরানের সঙ্গেও যুদ্ধে জড়িয়েছে ইজরায়েল। আর এ সমস্ত যুদ্ধেই আমেরিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ইজরায়েলের সঙ্গে আমেরিকার সুসম্পর্কের কথা কারওরই অজানিত নয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই ইজরায়েলকে নানা ভাবে সাহায্য জুগিয়ে এসেছে আমেরিকা। এমনকী যুদ্ধ শুরু হতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছুটে গিয়েছিলেন ইজরায়েলে। 'বন্ধু' নেতানিয়াহুকে শুধু নৈতিক সমর্থনই নয়, রীতিমতো অস্ত্রের পর অস্ত্র জুগিয়ে বন্ধুত্বের নজির গড়েছেন বাইডেন। আমেরিকার অন্যতম কারবার যে অস্ত্রের, তা তো নতুন করে বলে দিতে হয় না। আর ইজরায়েল-গাজার এই যুদ্ধের ময়দানে সেই অস্ত্রের কারবারে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে আমেরিকা। কার্যত নেতানিয়াহু-বাইডেন বন্ধুত্বের নেপথ্যে কি-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে এই যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ।
গাজায় যুদ্ধ লাগার পর থেকে ইজরায়েলকে অজস্র যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে গিয়েছে আমেরিকা। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের হিসেব বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৫০০-র বেশি ট্রান্সপোর্ট বিমান ও ১০৭টি জাহাজে চেপে আমেরিকা থেকে ইজরায়েলে পৌঁছেছে ৫০ হাজার টনেরও বেশি অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম। তার মধ্যে যেমন রয়েছে সাঁজোয়া গাড়ি, গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, রয়েছে বিভিন্ন সুরক্ষার সরঞ্জাম ও মেডিক্যাল জিনিসপত্র। যা গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের।
আরও পড়ুন: বন্দুকের নলই আমেরিকায় ক্ষমতার উৎস
এর মধ্যে একাধিক বার জো বাইডেন হুঙ্কার দিয়েছে, গাজায় মানবিক সহায়তা না দিলে ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করে দেবে আমেরিকা। কিন্তু এ ছিল শুধুই কথার কথা। কার্যত বহির্বিশ্বের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা। বাস্তবে ইজরায়েলকে অস্ত্রের জোগান বন্ধের কোনও রকম প্রচেষ্টাই দেখা যায়নি আমেরিকার তরফে। এই এক বছরে কোটি কোটি টাকার অস্ত্র ইজরায়েলে রফতানি করে গিয়েছে আমেরিকা। যা আমেরিকার বাণিজ্যে যেমন লক্ষ্মী এনেছে, তেমনই কোষাগারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা ইজরায়েলকে করেছে আমেরিকা। সে সময়েই হুঙ্কার দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছিলেন, ইরান ও তার যুদ্ধসঙ্গীদের হাত থেকে ইজরায়েলকে বাঁচাতে যা যা করার প্রয়োজন, তিনি করবেন। এই করার অর্থ যে অস্ত্র জোগানো, তা শিশুরও বুঝতে অসুবিধা হয় না। মে মাসেই হোয়াইট হাউজের তরফে জানানো হয়েছিল, ইজরায়েলে নতুন করে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নতুন অস্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা করছে বাইডেন প্রশাসন। ঠিক সে সময়ের কথা, যখন দক্ষিণ গাজার রাফা শহরকে পুরোপুরি ধ্বংসের ছক কষছে ইজরায়েল। এদিকে রাফাহ-তে ইজরায়েলের হামলা নিয়ে মুখে বিরোধিতা পুরোদমে চালিয়ে গিয়েছে আমেরিকা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট জানিয়েছিল, মার্কিন মিডিয়া এই খবর নিশ্চিত করে যে সে সময় আমেরিকার পাঠানো যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে ছিল ৭০০ মিলিয়ন ডলারের যুদ্ধট্যাঙ্ক ও গোলাবারুদ, ৬০ মিলিয়ন ডলারের মর্টার রাউন্ডস এবং ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ট্যাকটিকাল ভেহিক্যল।
আদতে ফেডারেল আইন অনুযায়ী, অন্য দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি নির্দিষ্ট একটি পরিমাণের বেশি হলেই তা বাধ্যতামূলক ভাবে হোয়াইট হাউজের তরফে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হয়। ফলে এই তথ্য সামনে এসেছিল অবধারিত ভাবেই। অবশ্য এই বিজ্ঞপ্তি সামনে আসার আগেই সম্ভবত অস্ত্র হস্তান্তরের কাজ সেরে ফেলেছিলেন বাইডেন। তার আগের মাসেই ইজারায়েল, ইউক্রেন ও তাইওয়ানকে ৯৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার প্যাকেজ অনুমোদন করে আমেরিকা। স্বাভাবিক ভাবেই ইজরায়েলকে যুদ্ধে মদত দেওয়া এবং গাজায় গণহত্যা চালানোর জন্য আমেরিকাকে পরোক্ষ ভাবে যে দায়ী করে বিশ্বের অন্য দেশগুলি, সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না আদপেই।
অনেকেই মনে করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল ভোটে বাইডেনের এই অস্ত্র হস্তান্তরের ব্যাপারটি ভালো মতোই প্রভাব ফেলবে। তা সত্যিই ফেলেছে কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু ২০২৪ প্রেসিডেন্সিয়াল ভোটের ফলাফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে ডেমোক্র্যাট দল। হোয়াইট হাউজ পুনরায় দখল করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২২৪টি আসন নিয়ে ম্যাজিক সংখ্যা থেকে বহু দূরে রয়ে গিয়েছেন প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিস। যিনি কিনা আমেরিকার ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ পান প্রেসিডেন্ট পদের দৌড় থেকে জো বাইডেনের সরে দাঁড়ানোর পরেই। অনেকেই ভেবেছিলেন, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস হয়তো অন্য পথে হাঁটালেও হাঁটতে পারেন। তবে প্রার্থী হওয়ার পরে পরেই তিনিও ঘোষণা করে দেন, ইজরায়েলের আত্মরক্ষার স্বার্থে বাইডেনের মতোই নেতানিয়াহুর পাশে থাকবেন তিনিও। গোড়া থেকেই মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান ল-মেকারসরা বারবার বাইডেনের এই অস্ত্রনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মেরিল্যান্ড-সহ বহু জায়গাতেই বিরোধীদের বাইডেনের বিরুদ্ধে প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই ইজরায়েল-গাজার যুদ্ধে আমেরিকার ইজরায়েলের প্রতি পক্ষপাত।
তবে ভোট দোরগোরায় এসে গেলেও সেই জায়গা থেকে সরে আসার রাস্তায় হাঁটেননি বাইডেন। একই পথ ধরেছিলেন কমলাও। অক্টোবরেও মার্কিন সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বারবার জো বাইডেনকে অনুরোধ করেন, তিনি যাতে ইজরায়েলকে অস্ত্রসাহায্য করা থেকে বিরত থাকেন। ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার ব্যাপারে আইন প্রবর্তনের দাবি তুলে তিনি জানিয়েছিলেন, অস্ত্র রফতানি আদতে ১৯৬১ সালের বৈদিশিক সহায়তা আইন ও অস্ত্র রফতানি নিয়ন্ত্রণ আইনের লঙ্ঘন। তবে তাতে কিছু বদলায়নি। ইজরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ জারি রেখেছিলেন বাইডেন।
আজ থেকে নয়, সেই ২০০৮ সাল থেকে ইজরায়েল এবং ওই সব অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে অস্ত্র বিক্রয় চালিয়ে আসছে। গাজার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু পর থেকে সেই জোগান স্বাভাবিক ভাবেই আরও বেড়েছে। বাইডেন মৌখিক ভাবে মেনেও নিয়েছেন, মার্কিন অস্ত্রের সাহায্যে গাজায় প্রচুর সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েল। তবে তার পরেও অস্ত্রের সরবরাহ বন্ধ হয়নি। ২০১৬ সালের একটি চুক্তির ফলাফল হিসেবে,আমেরিকা প্রতি বছর ইজরায়েলকে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা প্রদান করে। যে প্রক্রিয়ার আওতায় আবার আমেরিকাই ইজরায়েলকে আমেরিকার অস্ত্র কেনার জন্য অর্থও জোগায়। ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাস হামলার পর থেকে ইজরায়েল-আমেরিকার মধ্যে অন্তত শতাধিক অস্ত্রবিক্রির ডিল সম্পন্ন হয়েছে, যাতে অনুমোদন দিয়েছে খোদ বাইডেন প্রশাসন। আর তা হয়েছে কংগ্রেসকে কোনও কিছু না জানিয়েই। এই এক বছর ধরে একের পর এক অস্ত্র বিক্রিতে অনুমোদন দিয়ে গিয়েছে বাইডেন সরকার। এরই মধ্যে কংগ্রেসে আবার ইজরায়েলের জন্য ২৩.৬ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানের জন্য বিল পাশ হয়েছে। যা আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতো অস্ত্র মোতায়েনের কাজে ব্যবহার হবে বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ম্যাজিক সংখ্যা পেরিয়ে হোয়াইট হাউজের পথে ট্রাম্প, যা যা বললেন বিজয়ভাষণে
এখন প্রশ্ন, বাইডেন জমানা তো শেষ। নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকেও কি একই রকম সহায়তা পেতে চলেছেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু? নাকি বদলাতে চলেছে সামগ্রিক সমীকরণই। ট্রাম্পের জয়ের খবর পেয়েই তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি নেতানিয়াহু। ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য তেমন আশঙ্কা করছে না মোটেও। অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্পের এই প্রত্যাবর্তন আদতে নেতানিয়াহুর হাতই আরও শক্ত করতে চলেছে আগামিদিনে। ট্রাম্প বরাবরই আমেরিকার এই অস্ত্র বিক্রির ধারাকে তাঁর আভ্যন্তরীণ শক্তিবৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। তাঁর প্রেসিডেন্সির প্রথম দফার প্রথম সফরে তিনি সৌদি আরবে যান, যেখান থেকে প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রির বরাত নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। ফলে ট্রাম্পের নয়া জমানায় তেমন কোনও সমস্যায় পড়তে না-ও হতে পারে নেতানিয়াহু সরকারকে। বরং যে বিষয়টি নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের কোণঠাসা করেছিলেন বিরোধীরা, সেই অস্ত্রবিক্রিকে কেন্দ্র করেই ভবিষ্যতে আরও মজবুত হতে চলেছে ইজরায়েল-আমেরিকার বন্ধুত্ব, তেমনটাই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। ‘রাজা আসে যায় রাজা বদলায়/নীল জামা গায় লাল জামা গায়...’— এ কথা যে আমেরিকা ও তার অস্ত্রব্যবসার আধিপত্যের ব্যাপারে একশো শতাংশ সত্য, তা উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।