বাঙালির নিখাদ চায়ের আড্ডার স্টেশন! যেভাবে রাতারাতি গড়ে উঠেছিল টি জংশন
Tea Junction: ২০০৪ সালে সিটি সেন্টারে এক রাতে খুলে ফেলা হয়েছিল টি জংশন। পরবর্তীকালে ডানা মেলে আরও বেড়েছে তার আউটলেট সংখ্যা।
চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রথম চিনে হলেও ভারতীয়রা সেই যে চা-কে সাদরে গ্রহণ করল, তার পর চায়ের মাদকতা থেকে তাঁকে আর সরানো গেল না। ভারতীয় তো বটেই, বিশেষত বাঙালির সঙ্গে চায়ের সম্পর্ক চিরকালীন। চা ছাড়া বাঙালির আড্ডা অসম্পূর্ণ। আর সেই চা যদি ভাঁড়ের চা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। জানা যায়, ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায় ব্রিটিশরা। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ। চা মানে তো শুধু এক লোভনীয় পানীয় নয়, কার্যত বাঙালির আবেগের নাম চা। আর সেই আবেগকেই নতুন রূপ দিয়েছিলেন হর্ষ নেওটিয়া নামে বাঙালির এক নিজস্ব শিল্পপতি। তৈরি করেছিলেন টি জংশন। সেই নির্মাণের নেপথ্যগল্পটা শুনলে চোখ কপালে উঠবে অনেকেরই। ইনস্ক্রিপ্টের পডকাস্ট ক্যালকাটা ডায়লগসে এসে এই গল্প নিজে মুখেই বলেছেন হর্ষ নেওটিয়া।
জন্মসূত্রে তিনি মারওয়াড়ি হলেও কলকাতা শহর তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। কলকাতার নিজস্ব ঘ্রাণকে বুকে নিয়ে ঘোরেন তিনি। এবং সেই ঐতিহ্য, সেই আবেগের প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর প্রতিটি নির্মাণে। সল্টলেকের বুকে প্রায় ৫০,৪০০ বর্গ মিটার জমির টেন্ডার জেতার মল বানানোর বরাত পায় সংস্থা অম্বুজা নেওটিয়া। যেখানে গড়ে উঠেছিল এক ছকভাঙা মল সিটি সেন্টার। যে নির্মাণটির নকশা তৈরি করেছিলেন পৃথিবীবিখ্য়াত আর্কিটেক্ট চার্লস কোরিয়া সাহেব। সেই চার্লস কোরিয়া সাহেবকে বহু কষ্টে এই মলের নকশা তৈরি করার জন্য রাজি করিয়েছিলেন হর্ষ। বার বার তিনেক ঢুঁ মেরেছিলেন কোরিয়া সাহেবের ডেরায়। প্রায় প্রতিবারই না করে দেন তিনি। জানান, তিনি মলের ধারণাতেই বিশ্বাস করেন না। তবু হাল ছাড়েননি হর্ষ। শেষমেশ রাজি হন কোরিয়া সাহেব।
আরও পড়ুন: আস্তাকুঁড় হল স্বভূমি! হর্ষ নেওটিয়া যে ভাবে গড়েছিলেন বাঙালির প্রিয় ডেস্টিনেশন
সে সময় রাজ্যে ক্ষমতায় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শিল্যান্যাসের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরেই নাকি গোটা নকশাটি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন কোরিয়া সাহেব। ততক্ষণে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়ে গিয়েছে, তৈরি হয়ে গিয়েছে মডেলও। অথচ শেষ মুহূর্তে নকশা বদলে ফেললেন কোরিয়া সাহেব। গোটা শহর যখন পাশ্চাত্যের কায়দায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মল চাইছে, তিনি তখন চাইলেন বাজার স্টাইলের অভিনব এক শপিং কমপ্লেক্স। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শেষ পর্যন্ত সল্টলেকের বুকে গড়েই উঠল সিটি সেন্টার।
এক ভবনের সঙ্গে অন্য ভবন জোড়া, চারপাশ খোলামেলা, এখানে ওখানে বসে আড্ডা মারার জায়গা। ২০০৪ সালে ধুমধাম করে উদ্বোধন হয়ে গেলেও সেই অভিনব কায়দার মলের দোকানগুলি ফাঁকাই ছিল বেশিরভাগ। মলটি যখন উদ্বোধন হয়, তখন শপার্স স্টপ ছাড়া আর মাত্র দুটি দোকান খোলা ছিল গোটা মলে। ভারী উদ্বেগে পড়েন হর্ষ। কিন্তু মল কর্তৃপক্ষের কাছে খবর পান, দোকান না থাকলে কী হবে, মল ঘুরতে আসা শহরবাসীকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন হর্ষ। একটাও খাবারের দোকান নেই, কিছু নেই। কী করতে আসছেন তবে মানুষ। নতুন খোলা মলে ঘুরতে, হাওয়া খেতে, নিছক আড্ডা মারতে জড়ো হচ্ছেন এদিকে মানুষ।
সম্পূর্ণ এপিসোডের লিঙ্ক:
শূন্য থেকে শুরু, কী ভাবে সাফল্যের চূড়ায়? অর্কর মুখোমুখি হর্ষ নেওটিয়া
— inscript.me (@inscript_dot_me) October 18, 2024
সম্পূর্ণ পর্ব বিস্তারিত কমেন্টে
From Zero to Success: Arko Deb in Conversation with Harsh Neotia Full Episode in the Comments#bengalipodcast #CalcuttaDialogues #BestBengaliPodcast #harshneotia pic.twitter.com/Hui3PeAtc2
শহরবাসী আড্ডা মারবেন, অথচ তাঁর হাতের কাছে একটু চা থাকবে না! তা আবার হয় নাকি! আড্ডাবাজ শহরের মানুষজনের জন্য রাতারাতি কিছু করার কথা ভেবে ফেলেন হর্ষ। রাতারাতি গড়ে ওঠে টি জংশন। তবে সহজ ছিল না সেই জংশনকে চালু করার কাজ। সে সময় সকালে উঠে ভবানীপুরের বলবন্ত সিং ধাবার দিকটায় হাঁটতে যেতেন তিনি। ভারী ভালো লাগত তাঁর সেই রেস্তরাঁটি। তড়িঘড়ি ফোন করেন বলবন্ত সিংকে। যদি তাঁরা কোনও ভাবে একটি নতুন আউটলেট খুলে দিতে পারেন শহরের নতুন মলে। কিন্তু ফের প্রত্যাখ্যান। বলবন্তজি জানান, তাঁদের এমন আউটলেট খোলার সুযোগই নেই।
হতোদ্যোম হন না হর্ষ। বরং কয়েক জনকে জোগাড় করে রাতারাতি বসিয়ে দেন চা বানাতে। গড়ে ওঠে টি জংশন, বাঙালির চা-পূরাণের নতুন স্টপেজ। যেখানে চায়ের সঙ্গে টা বলতে মিলত শুধুমাত্র সিঙাড়া। মাটির ভাঁড়ে ধোঁয়া ওঠা চা আর সঙ্গে গরম গরম সিঙাড়া, বাঙালির আড্ডায় এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে। ভিড় বাড়তে থাকে সিটি সেন্টারে, সঙ্গে মানুষের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে শুরু করে টি জংশন। পরবর্তী কালে তার মেনুর দৈর্ঘ্য বেড়েছে। তাতে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের স্যান্ডউইচ, বিভিন্ন ধরনের চা এবং কফি, শরবত। তবে টি জংশনের মূল আকর্ষণ কিন্তু যাকে বলে কুল্লড় চায়ে। দুর্দান্ত দেখতে সব মাটির ভাঁড়ে চা খেতে সেখানে ভিড় জমান মানুষ।
আরও পড়ুন:বাজারের পাশাপাশি আড্ডার ঠেক, যেভাবে গড়ে উঠেছিল বাঙালির প্রিয় মল সিটি সেন্টার
২০০৪ সালে সিটি সেন্টারে এক রাতে খুলে ফেলা হয়েছিল টি জংশন। পরবর্তীকালে ডানা মেলে আরও বেড়েছে তার আউটলেট সংখ্যা। বর্তমানে কলকাতা ও শিলিগুড়ি জুড়ে প্রায় ৪৫টিরও বেশি আউটলেট রয়েছে টি জংশনের। যেখানে কুল্লড় চা তো মেলেই, তার সঙ্গে মেলে সুস্বাদু কেশরিয়া চা, যা টি জংশনের অন্যতম আকর্ষণ। রয়েছে বাবল চা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সচেতনদের জন্য় বিভিন্ন ধরনের ভেষজ চা। আদি অকৃত্রিম সিঙাড়ার পাশাপাশি মেলে বিভিন্ন ধরনের প্যাটি ও সুস্বাদু সব আইটেম।
সেই ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু। সেই থেকে এখনও কিন্তু সিটি সেন্টারের অন্যতম আকর্ষণ টি জংশন। এখনও সিটি সেন্টারে আগত মানুষজন একবার হলেও ঢুঁ মারেন এই চায়ের আড্ডায়। আগামী দিনে টি জংশনকে বাঙালির চায়ের ওয়ান স্টপ ডেস্টিনেশন গড়ে তোলাই লক্ষ্য কর্তৃপক্ষের।