ঔপনিবেশিক ইতিহাসেই লুকিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চাবি? বিশ্বকে অবাক করল যে গবেষণা

Nobel Prize in Economics 2024: নোবেলজয়ীদের অন্যতম অ্যাসামোগলু জানাচ্ছেন, বৃহদাকারে বলতে গেলে তাঁদের এই কাজ আসলে গণতন্ত্রের পক্ষে। একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানান, 'গণতন্ত্র কোনও প্রতিষেধক নয়। গণতন্ত্র চালু করা খুব কঠিন কাজ।

গত বছর নারীশ্রমের মূল্য নিয়ে কাজ করে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ক্লদিয়া গোল্ডিন। চলতি বছর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তিন বিজ্ঞানীর কাজ এনে দিল নোবেল। গত সোমবার ২০২৪ সালের অর্থনীতিতো নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করল রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেলের জন্য যৌথভাবে মনোনীত হলেন তুরস্ক বংশোদ্ভূত ড্যারন অ্যাসেমোগুলো, ইংল্যান্ডের সাইমন জনসন ও আমেরিকার এ রবিনসন। দেশের সমৃদ্ধিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন এই তিন অর্থনীতিবিদ। যা এনে দিয়েছে এই অনন্য সম্মান।

ড্যারন অ্যাসেমোগুলু জন্মসূত্রে তুর্কি, সাইমন জন্মসূত্রে শেভিল্ড এবং জেমস এ রবিনসন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ। যদিও ২০২৪ সালের এই তিন নোবেলজয়ীই অবশ্য বর্তমানে তিন জনেই আমেরিকার বাসিন্দা। দেশীয় সমৃদ্ধিতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলি গঠিত হয় এবং কীভাবে তারা সমৃদ্ধির উপর প্রভাব ফেলে সেটাই ছিল এই তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণার বিষয়। নোবেল কমিটির (অর্থনীতি) চেয়ারম্যান জ্যাকব সভেনসন বলেছেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যে আয়ের পার্থক্য কমানো এই সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই তিন অর্থনীতিবিদ দেখিয়েছেন, সেই অসাম্য দূর করতে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির বড় ভূমিকা রয়েছে। যে সব দেশের সামাজিক রীতিনীতিগুলি শোষণমূলক, সেই সব সমাজ বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠতে পারে না। গবেষণার মাধ্যমে তা-ই দেখিয়েছেন তিন বিজ্ঞানী।’’

আরও পড়ুন: পেলব অথচ নৃশংস! কেন পড়তেই হবে নোবেলজয়ী হ্যান কাং-এর লেখা?

এখানেই শেষ নয়, ঔপনিবেশিকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে দেশ ধনী হবে না দরিদ্র হবে, তা নির্ধারণ করতে পারে, সেটা নিয়েও কাজ করেছেন এই তিন অর্থনীতিবিদ। তাঁদের গবেষণা বলছে, ইউরোপীয় অভিবাসীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রতিষ্ঠানগুলির অন্তর্ভুক্তিকরণ আসলে সমাজের জন্য কাজের হয়েছে। পাশাপাশি তাদের গবেষণা এ-ও দেখাচ্ছে, যে সব দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি আদিবাসী জনসংখ্যাকে শোষণ করেছে, এবং নিজেদের দেশে সম্পদ আহরণ করে নিয়ে গিয়েছে, তার প্রভাব হয়েছে ক্ষতিকর। এই ভয়ঙ্কর চাপ আসলে বহু সমাজকে দারিদ্রে মুড়ে রেখেছে। এমনকী বহু দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে নীচের দিকেই ঘোরাফেরা করে, তার জন্যও দায়ী এই শোষণ, মনে করেছেন তিন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। গবেষণায় তাঁরা দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিকতার সময় যে দেশগুলি তুলনামূলক ভাবে ধনী ছিল, সম্পদপূর্ণ ছিল, সেই দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা আজ সবচেয়ে সঙ্কটে।

নোবেল পুরস্কার কমিটি এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে জানিয়েছেন, যখন ইউরোপীয়রা বিশ্বের নানা দেশে নিজেদের উপনিবেশ তৈরি ও বিস্তার করা শুরু করেছিল, তখন সেই সব সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলিতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করল। সুবিধার জন্য সেই সমস্ত দেশে একের পর এক নতুন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুরু করে ইউরোপীয়রাই। কিন্তু দেখা গিয়েছে, যে উপনিবেশগুলি সে সময় সমৃদ্ধ ছিল, সেগুলি এখন দরিদ্র; আর যে উপনিবেশগুলিতে সে সময় দারিদ্র্য ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গেই সমাজে সম্পদের বণ্টন কী ভাবে হচ্ছে এবং সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার হাতে রয়েছে তার বিশ্লেষণ জরুরি বলেই মনে করছে গবেষণা। কখনও কখনও জনগণ একজোট হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। অর্থাৎ সংঘবদ্ধ সমাজের ক্ষমতা কখনও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। এই পরিস্থিতি এড়াতে শাসক নানা স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়, ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ, তখন অসাম্য ঘোচানোর একটিই বিকল্প পথ রয়েছে— শাসক যদি নিজেই জনগণের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, অর্থাৎ ক্ষমতার হস্তান্তর এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

নোবেলজয়ীদের অন্যতম অ্যাসামোগলু জানাচ্ছেন, বৃহদাকারে বলতে গেলে তাঁদের এই কাজ আসলে গণতন্ত্রের পক্ষে। একই সঙ্গে তিনি এ-ও জানান, 'গণতন্ত্র কোনও প্রতিষেধক নয়। গণতন্ত্র চালু করা খুব কঠিন কাজ। আপনি যখন নির্বাচন শুরু করেন, সেটা সংঘাতের সৃষ্টি করে।' সেইসঙ্গে তাঁরা যে গবেষণা করেছেন, সেটার সঙ্গে চিনের মতো দেশের আর্থিক উন্নতির বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, সেই প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন যে এরকম একনায়কতন্ত্রের দেশগুলি কঠিন সময়ের মুখে পড়বে।

সমাজ ও অর্থনীতি সংক্রান্ত ভীষণ জরুরি এই গবেষণাই এই বছর নোবেল এনে দিয়েছে তিন অর্থনীতিবিদকে। নোবেলজয়ী ড্য়ারন ও সাইমন বর্তমানে ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)-তে গবেষণা করছেন। জেমস শিকাগো ইউনিভার্সিটির গবেষক। ১৯৬৭ সালে তুরস্কেই জন্ম হয় ড্যারন আ্যকমোগলুর। ১৯৬৩ সালে জন্ম সিমন জনসনের। নোবেল কমিটি যখন অ্যাসামোগলুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তিনি তখন কনফারেন্সে যোগ দিতে গ্রিসে। এই সম্মানে তিনি আপ্লুত।

আরও পড়ুন:AI-ই বিজ্ঞানীদের শেষ ভরসা? কী বলছেন রসায়নে নোবেলজয়ী হ্যাসাবিস?

আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞানের তিন শাখার পাশাপাশি সাহিত্য় ও শান্তি পুরষ্কার দেয় নোবেল কমিটি। ১৯০১ সাল থেকে এই নোবেল পুরস্কার দিয়ে আসা হচ্ছে। তবে তার সাপেক্ষে অর্থনীতি শাখায় নোবেল পুরস্কার প্রদান কিন্তু শুরু হয় অনেক দিন পরে, ১৯৬৯ সালে। এই বিভাগের নোবেলটি আদৌ নোবেল কিনা, তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এই শাখার নোবেল ঘোষণা নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকেন বিশ্বের মানুষ। ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন প্রাপকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। অর্থনীতি শাখায় যা চলতি বছরের ডিসেম্বরে তুলে দেওয়া হবে এই তিন অর্থনীতিবিদের হাতে। নোবেলজয়ীরা নোবেল পদক ছাড়াও পাবেন একটি সনদপত্র এবং মোট ১১ বিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা, ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য আট কোটি ৯০ লক্ষ টাকারও বেশি।

More Articles