আস্তাকুঁড় হল স্বভূমি! হর্ষ নেওটিয়া যে ভাবে গড়েছিলেন বাঙালির প্রিয় ডেস্টিনেশন
Swabhumi, Kolkata: সেটা ২০০১ সাল হবে। কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকার নারকেল ডাঙা মেইন রোডের উপর গড়ে উঠেছিল বাঙালির সাধের স্বভূমি। কিন্তু সেই স্বভূমি তৈরি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ এক লড়াইয়ের গল্প।
বাঙালির প্রিয় ডেস্টিনেশন স্বভূমি গড়া তাঁর নিজের হাতে। তিনি বাংলার অন্যতম শিল্পপতি হর্ষবর্ধন নেওটিয়া। শুধু বাণিজ্যেই নয়, শিল্প এবং সংস্কৃতিতেও তাঁর অবাধ বিচরণ। এ শহরের বহু সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যের নেপথ্যে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর সংস্থা অম্বুজা নেওটিয়া। তাঁর প্রতিটি নির্মাণেই লুকিয়ে রয়েছে এক অনন্য শিল্পবোধ ও বাঙালিয়ানার ছাপ। অনেকেই হয়তো জানেন না, কলকাতার বুকে রোজ কলেজ কেটে, সপ্তাহান্তে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া বা আড্ডা মারার বহু গন্তব্যেরই নেপথ্যনায়ক আসলে এই মানুষটি। শহরের একাধিক মল, হোটেল, রেস্তরাঁ এবং হাসপাতাল গড়েছেন তিনি।
কলকাতার এক মাড়োয়ারি পরিবারে জন্ম হর্ষের। এখানেই বড় হয়ে ওঠা। ছোটবেলায় লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ, এবং পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক হন। তার পর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল উচ্চশিক্ষা। তবে শেষমেশ কলকাতার টানে ফিরে এসেছেন তিনি দেশে। নিজের প্রিয় শহরে গড়েছেন একের পর এক ইমারত। শহরকে সাজিয়ে তুলেছেন মনের মতো করে।
কৈশরে বা যৌবনে স্বভূমিতে পা রাখেনি, এমন মফসসলের ছেলেপুলেও পাওয়া বিরল। স্বভূমি বললেই অবশ্য অনেকে সিনেমাহলটুকুই বোঝে। কিন্তু সেই স্বভূমির ভিতরেই রয়েছে আরেক স্বভূমি, যেখানে হেঁটে দেখতে শিখতে হয় কলকাতার মতোই। শহরের বুকে এক টুকরো টিলা, সেই টিলার বুকে জেগে ওঠা আশ্চর্য সুন্দর একটা নির্মাণ, সেই স্বভূমিকে একদিন শূন্য থেকে গড়ে তুলেছিলেন হর্ষ। সেই স্বভূমি তৈরি হওয়ার গল্প শুনলে চোখ কপালে উঠবে অনেকেই। সম্প্রতি ইনস্ক্রিপ্টের ক্যালকাটা পডকাস্ট অনুষ্ঠানে এসে সেই গল্প শোনালেন হর্ষ নিজেই।
আরও পড়ুন: প্রথম আয়োডাইজ লবণ! অন্ধকার থেকে দরিদ্র ভারতকে সেদিন তুলে এনেছিলেন রতন টাটা
সেটা ২০০১ সাল হবে। কলকাতার কাঁকুড়গাছি এলাকার নারকেল ডাঙা মেইন রোডের উপর গড়ে উঠেছিল বাঙালির সাধের স্বভূমি। কিন্তু সেই স্বভূমি তৈরি হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ এক গল্প, এবং তা বেশ মজার। হর্ষ বলেন, “এই স্বভূমির সূচনাটাই হয়েছিল অজানা দিয়ে। ওই এলাকা দিয়ে বেশ কয়েকবার এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়েছি। প্রতিবারই চোখে পড়েছে টিলার মতোন একটি জায়গা। সেই টিলার উপরে আবার দিব্যি গাছও জন্মেছে।” দেখে বেশ ভালো লাগে তাঁর। ভেবে ফেলেন, ওই টিলার উপর যদি আশ্চর্য সুন্দর একটি পার্ক তৈরি করা যায়, বানিয়ে ফেলা যায় যদি কয়েকটা থাকার ঘর, বা গানবাজনার জায়গা, তবে শহরবাসীকে একটুকরো অবসর উপহার দেওয়া যাবে দিব্যি। সে সময় জয়পুরের চোখী ধনি এলাকা থেকে ঘুরে এসেছেন হর্ষ। ঘুরেছেন দিল্লি হাটও। সেই সব জায়গাগুলির ভাবনা মাথায় ঘুরছে তাঁর।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বসলেন হর্ষ। বিশেষ করে উল্লেখ করলেন টিলার কথা। তখন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। হর্ষের চিঠি পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব তাঁকে ডেকে পাঠালেন, দেখা করলেন হর্ষ। সচিব তো তাঁর প্রস্তাব শুনে হতবাক। বললেন, ওটা তো আসলে আস্তাকুঁড়। মিউনিসিপ্যাল ওয়েস্ট জমে জমেই ওই টিলা তৈরি হয়েছে। শুনে ততোধিক অবাক হন হর্ষও। প্রশ্ন করেন, “তাহলে যে অমন সুন্দর বড় বড় গাছ হয়েছে!” সচিব জানান, “ওসব নিজে থেকেই যেমন হওয়ার হয়েছে। ” এসব শুনে ওই আস্তাকুড় ঘুরে দেখার অনুমতি চান হর্ষ। নিজের দলবল নিয়ে ঘুরেও আসেন সেখান থেকে। আস্তাকুঁড় জানার পরেও ভারী পছন্দ হয়ে যায় জায়গাখানা। ওই জায়গার টপোগ্রাফিটাই টেনেছিল মূলত তাঁকে।
ফের বিষয়টি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন হর্ষ। জ্যোতিবাবু জিজ্ঞেস করেন যে তিনি ওই আস্তাকুঁড় এলাকায় কী করবেন তিনি? পুরো পরিকল্পনাটা মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেন তিনি। তখন পারিষদদের ডেকে জ্যোতিবাবু জিজ্ঞেস করেন, ওই জায়গাটি সরকারের অন্য কাজে ব্যবহার হতে পারে কিনা। সকলেই জানান, নাহ, ওখানে কোনও কাজের কাজ হওয়ার নয়। শেষমেশ হর্ষের হাতেই দিয়ে দেওয়া হয় জায়গাখানা। যাতে তিনি সেখানে তাঁর স্বপ্নোদ্যান গড়ে তুলতে পারেন।
অনুমতি তো মিলল। শুরুও হল কাজ। কিন্তু পদে পদে বাধায় ভরা ছিল সেই কাজ। নিজের দলবল, বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে গিয়ে হর্ষ দেখলেন, ওই জায়গায় কাজ করা অসম্ভব। কারণ শত্রু মিথেন গ্যাস। দীর্ঘদিন ধরে আবর্জনা, জঞ্জাল জড়ো হয়ে যে টিলা তৈরি হয়েছে, তার নীচে জমে রয়েছে মিথেনের খনি। যেখান থেকে অবিরত বেরিয়ে আসছে ওই বিষাক্ত গ্যাস। সেখানে একটা দেশলাই জ্বালালেও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে পারে, এতই সে গ্যাসের তীব্রতা। তবে উপায়? এত সাধের টিলাভূমি, এত কষ্ট করে অনুমতি জোগাড় করা সব বিফলে যাবে? তড়িঘড়ি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হর্ষ। তাঁরা জানান, উপায় একটাই, মাটির ভিতরে গভীর গর্ত খুঁড়ে সেখানে পাইপ ঢুকিয়ে মিথেন গ্যাস বেরোনোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যে পরিমাণ মিথেন গ্যাস জমা হয়ে আছে ওখানে, সেখানে কোনওরকম নির্মাণ কাজ বা যে কোনও রকম কাজ করাই বিপজ্জনক।
ফাঁড়া কি একটা? ততদিনে হর্ষ জানতে পারেন, ওই জমিতে দু'তলার বেশি নির্মাণ সম্ভব নয়। কারণ আবর্জনা দ্বারা তৈরি হওয়া ওই মাটি মোটেও শক্তপোক্ত নয়। তার বেয়ারিং ক্যাপাসিটিও নেই। ফলে বেশি উঁচু ভবন বানালে তা ধ্বসে যেতে পারে। হর্ষের কথায়, “এর চেয়ে উঁচু নির্মাণ করতে হলে ওই ষাট ফুট উঁচু টিলার নীচে গিয়ে অরিজিনাল আর্থিং যেখানে রয়েছে, সেখানে গিয়ে পাইলিং করতে হত। যা বেশ খরচসাপেক্ষ। যা এই নির্মাণে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।” প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল ওই জায়গা থেকে মিথেন গ্যাসের বেরিয়ে যেতে। ততদিন থমকে ছিল কাজ। তবু ওই পোড়ো জমিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার স্বপ্ন থেকে সরে আসেননি হর্ষ। বরং সব প্রক্রিয়া মেনে ওই জায়গাকে সাজিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তৈরি হল স্বভূমি।
সম্পূর্ণ এপিসোডের লিঙ্ক:
শূন্য থেকে শুরু, কী ভাবে সাফল্যের চূড়ায়? অর্কর মুখোমুখি হর্ষ নেওটিয়া
— inscript.me (@inscript_dot_me) October 18, 2024
সম্পূর্ণ পর্ব বিস্তারিত কমেন্টে
From Zero to Success: Arko Deb in Conversation with Harsh Neotia Full Episode in the Comments#bengalipodcast #CalcuttaDialogues #BestBengaliPodcast #harshneotia pic.twitter.com/Hui3PeAtc2
সত্যি বলতে পাঁচ-ছ বছর রমরমিয়ে চললও তা। শহরের মানুষ ঘুরতে আসতেন সেখানে। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। খুলল ছোট ছোট দোকানও। যেখানে পসার সাজিয়ে বসত ছোট-বড় বিক্রেতা থেকে নানা সংস্থাও। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই পাল্টে যেতে লাগত শহরটা। খুলতে শুরু করল একের পর এক মল। ছোটখাটো গহনা, প্রসাধনী সামগ্রী, যেগুলি স্বভূমিতে বিক্রি হত এতদিন, তা উঠে যেতে লাগল মলগুলির ধারপাশে। এমনকী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জায়গাও মিলতে লাগল মলেই। প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়লেন হর্ষ। এত খেটেখুটে বানানো তাঁর সাধের স্বভূমি, ফের কি পোড়োজমির দিকে এগোলো তবে!
আরও পড়ুন: দেউলিয়া হয়ে ঘুরেছেন রাস্তায়! জনপ্রিয়তম তারকা-শেফ রণবীর ব্রারের গল্প যেন আস্ত রূপকথা
না, হাল ছাড়লেন না হর্ষ। প্রায় বছর দশেক এই দোলাচলে কাটানোর পরে ফের তিনি হাত দিলেন সাধের প্রকল্পে। নতুন করে জীবনশক্তি পুরে দিয়ে সাজিয়ে তুললেন স্বভূমিকে। বানিয়ে তুললেন স্বভূমি হেরিটেজ। সেখানে তিনি বানিয়ে ফেললেন রাজকুটির। হর্ষের কথায়, রাজকীয় কিন্তু এক হাম্বল অ্যাবোড যেন। প্রায় ১৩ একর জায়গা জুড়ে তৈরি সেই স্বভূমি হেরিটেজে রয়েছে একটি কনভেনশন সেন্টার, একটি ভোজসভা-যুক্ত আর্টিসান কোর্ট যাকে কারুশিল্পগ্রামও বলা যেতে পারে। রয়েছে আরবান কোর্ট ও সন্তুষ্টি নামে একটি ফুড কোর্ট। কলকাতা শহরের ঐতিহ্য, মাদকতার কথা মাথায় রেখে সাজিতে তোলা হয়েছে জায়গাটিকে। রয়েছে পাঁচ তারা একটি বুটিক হোটেল, যার নাম রাজকুটির। যেখানে চাইলে একটি বা দুটি দিন ছুটির অবসর কাটিয়ে আসতে পারেন শহরবাসী। সেই বুটিক হোটেলে রয়েছে সমস্ত রকম ব্যবস্থা। রয়েছে বিলাসবহুল স্পা-ও। এছাড়া রয়েছে রাসমঞ্চ, রঙ্গমঞ্চ ও রং দরবার নামে তিনটি অনুষ্ঠান ভেন্যু। যা বিয়ে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া নিতে পারেন শহরবাসী। রাজবাড়ির আকারেই সাজানো হয়েছে গোটা হোটেলটিকে। তার সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেস্তরাঁ, ক্যাফে ও কয়েকটি দোকান। যেখানে গহনা, ফ্যাশন বুটিকের মতো একাধিক মনোগ্রাহী বিপণীও। যা আজও একই রকম ভাবে টানে মানুষকে।
একদিন মলের চাপে মুখ লুকিয়েছিল যে স্বভূমি, আজ শহরের ঐতিহ্যের মতো জেগে রয়েছে সেই দুর্দান্ত নির্মাণ। যাকে একদিন বহু স্বপ্ন এবং শিল্পবোধ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বাংলার এই শিল্পপতি।