তুবড়ি থেকে তারাবাতি, যেভাবে সেদিন শুরু হয়েছিল আতশবাজির পথচলা

History Of Firecrackers: কার্যত যুদ্ধ নয়, বারুদের সঙ্গে উৎসবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল কিন্তু আতসবাজিই। বারুদকে উৎসবের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার এই অভিনব ভাবনা, তার শুরুটা হয়েছিল ঠিক কোথায়?

দীপাবলি মানেই আলোর মেলা। এই আলোর ভিড়ে যেমন প্রদীপ, মোমবাতি আর টুনি লাইটরা সামিল, তেমন ভাবেই কালীপুজোর রাত মানে কিন্তু আতশবাজির রশনাই। এখন অবশ্য বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে নববর্ষের রাত, সবেতেই আতশবাজির ধুম, তবে একটা সময় কালীপুজোর রাতে আতশবাজির জ্বালানোর আলাদাই মজা ছিল। বাড়ির বাবা-কাকারা ছুটতেন নুঙ্গি কিংবা বিখ্য়াত কোনও বাজিবাজারে। ব্যাগ ভরে উঠত নানাবিধ বাজির সম্ভারে। চরকি, তুবড়ি, রকেট থেকে নিরামিশ তারাবাতি,ইলেকট্রিক তার কিংবা সাপবাজি, কী থাকত না সেখানে! সেসব উল্টেপাল্টে রোদে দিয়ে হাল্লা পৌঁছে যেত যুদ্ধের ময়দানে। যুদ্ধক্ষেত্র বলতে বাড়ির উঠোন কিংবা ছাদ, আলোয় আলোয় সে যেন একটি রাতের রাজা। কেউ কেউ আবার নিজের চেষ্টায় তৈরি করে ফেলতেন দুর্দান্ত সব তুবড়ি। কার তুবড়ি কত তলা বাড়ির ছাদ ছুঁয়ে ফেলে, তা ছিল রীতিমতো চর্চার বিষয়। তখন অবশ্য শেল বা আশমান-গোলা জাতীয় বাজির এত চল ছিল না। যা ছিল, তা সাধারণ রকেট। যা গন্তব্য ভুলে প্রায়শই সিঁধিয়ে যেত পড়শি বাড়ির জানলা দিয়ে। সেটাও কম দুশ্চিন্তার ছিল না বাজি মহোৎসবে পাহারায় থাকা গুরুজনেদের জন্য। মোটামুটি মফসসলের দীপাবলীর সন্ধে থেকে রাত গড়াত এই আতশবাজির সাহচর্যে। তখন গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে বহুতল বানানোর ট্রেন্ড যেমন ছিল না, তেমনই ছিল না আতশবাজি থেকে পরিবেশ দূষণের এত ভয়। এই যে কালীপুজোর গায়ে লেগে থাকা আতশবাজির এই বন্ধুত্ব, তার শুরুটা কোথায় জানেন? কীভাবে শুরু হল তার পথচলা? বারুদ শুনলেই সবার প্রথমে অস্ত্রের কথাই মনে পড়ে। কার্যত যুদ্ধ নয়, বারুদের সঙ্গে উৎসবের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল কিন্তু আতসবাজিই। বারুদকে উৎসবের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার এই অভিনব ভাবনা, তার শুরুটা হয়েছিল ঠিক কোথায়?

এই আতশবাজির উৎসের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে ভারতের পড়শি দেশ চিনের যোগ। অনেকেই মনে করেন, আতশবাজির শুরুটা হয়েছিল চিনের প্রাচীন লিউয়াং এলাকায়। প্রথম আতশবাজিতে অবশ্য বারুদের ব্যবহার তেমন ছিল না। বাঁশের ডালপালা জড়ো করে সেসব আগুনে ছুড়ে ফেলা হত। সে সময় বাঁশের ফাঁপা যে অংশগুলো, সেগুলোর মধ্যে বাতাস আটকে থাকার দরুণ প্রচণ্ড উত্তাপে সেগুলো দুমদাম ফেটে যেত। সেই ছিল প্রথম প্রাকৃতিক আতশবাজি। চিনারা মনে করতেন এই প্রাকৃতিক আতশবাজি খারাপ আত্মাদের তাঁদের থেকে দূরে রাখবে। সেটা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর কথা।

৬০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনও একসময় এক চিনা অ্যালকেমিস্ট নাকি পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফার এবং কাঠকয়লা মিশিয়ে একধরনের কালো পাওডার জাতীয় গুঁড়ো বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম গানপাওডার। যেটি ফাঁপা বাঁশের লাঠি কিংবা শক্ত কাগজের টিউবের মধ্যে ঢেলে প্রস্তুত হয়েছিল মানুষের তৈরি প্রথম আতশবাজি। এই বিস্ফোরিত বাঁশের ডাল 'বাওঝু' বা or 'বোগান' নামে পরিচিত ছিল। জানা যায়, সং রাজার সময় (৯৬০-১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ) থেকে সাধারণ মানুষ আতশবাজির বাজার থেকেই সংগ্রহ করতে পারতেন ওই পারতেন সেসব। ১১১০ সাল নাগাদ নাকি সম্রাট হুইজং রাজদরবারে বিশাল আতশবাজির প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।

আরও পড়ুন: তুবড়ি থেকে ফানুস, আতসবাজির সেই উন্মাদনা হারিয়েছে কালীপুজোর কলকাতা?

তেরোশো শতাব্দীর দিকে ইউরোপে প্রবেশ করল আতশবাজি। শোনা যায়, ১২৯৫ সালে মার্কো পোলো প্রাচ্য থেকে ইউরোপে আতশবাজি নিয়ে আসেন। তবে ১৪'শ শতক নাগাদ ইউরোপে ব্যাপক ভাবে বাজি তৈরি শুরু হয়। পনেরো-সতেরো শতকের মাঝামাঝি ব্যপক ভাবে জনপ্রিয় হয় তা ধর্মীয় উৎসব ও জনসাধারণের বিনোদনের জন্য। শোনা যায়, ইউরোপীয়রা শাসকেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাদের দুর্গ আলোকিত করতে ব্যবহার করত এইসব আতশবাজি। পাশাপাশি প্রজাদেরও মুগ্ধ করত সেসব। তবে সেসব ছিল নেহাতই সাদামাটা বাজি। কার্যত ইউরোপে এসে ইতালীয়দের হাত ধরেই খোলতাই হল আতশবাজি। তারা আতশবাজির খোলা টিউবগুলিতে চূর্ণ ধাতু এবং কাঠকয়লা মিশিয়ে তৈরি করতে লাগলেন স্পার্কলার। উনিশ শতকে আধুনিক রসায়ন আবিষ্কারের পর আরও রং লাগল সেই বাজির গায়ে। তার আগেই অবশ্য ১৭৮৬ সালে বার্থোলেট নামে এক ব্যক্তি আবিষ্কার করে ফেললেন, পটাশিয়াম ক্লোরেটের সাথে জারণের ফলে বেগুনী রঙ তৈরি করা সম্ভব। বেরিয়াম, স্ট্রন্টিয়াম, তামা এবং সোডিয়ামের ক্লোরেটের সাথে জারণের ফলে যে আরও নানান উজ্জ্বল বর্ণের ফুলকি তৈরি সম্ভব, তা সামনে আসতে লাগল অচিরেই। দেখা গেল, ধাতব ম্য়াগনেসিয়াম ও অ্যালুমিনিামের মিশ্রণে তৈরি হওয়া সম্ভব দুর্দান্ত রূপালি আলো। এক এক করে খুলতে লাগত আতশবাজির রূপ। ইউরোপ থেকে ক্রমে আমেরিকাতেও ঢুকে পড়ল আতশবাজির সংস্কৃতি। জানা যায়, ১৭৩০ সালে ঔপনিবেশিক শক্তির হাত ধরে আমেরিকাতেও ঢুকে পড়ে তারা। ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা দিবসে ব্যবহার করা হল তাদের। তার পর থেকে প্রতিবারই স্বাধীনতা দিবসে ব্যবহার হতে শুরু করল আতশবাজির। দিব্যি রংচঙে উৎসবকে আরও কয়েক মাত্রায় বাড়িয়ে দেওয়া আতশবাজির চাহিদা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল গোটা আমেরিকা জুড়ে।

ভারতে ঠিক কবে আতশবাজি এসে পৌঁছলো, তা নিয়ে নানাবিধ বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ১৫১৮ সালে গুজরাটে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রথম বার আতশবাজি ব্যবহার হয়েছিল। পোর্তুগিজ পর্যটর বারবোসার বিবরণ থেকে তেমনটাই জানা যায়। তবে সেই আতশবাজি ছিল মূলত ধনীদের ব্যবহারের জিনিস। সর্বসাধারণের আয়ত্তের মধ্যে ছিল না তা মোটেই। তবে অনেকেই মনে করেন, ভারতে আতশবাজির রমরমা শুরু হয়েছে ইসলাম বিজয়ের পরে পরেই। শোনা যায়, আনুমানিক ১৬০৯ সালে বিজাপুরের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহ তাঁর সেনাপতির মেয়ের সঙ্গে নিজাম শাহি জেনারেল মালিক অম্বরের বিয়েতে প্রায় বিরাট অঙ্কের যৌতুক দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আতশবাজির পিছনেই খরচ করা হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা সেই সময়ে দাঁড়িয়ে। এই সময়ের সাহিত্যেও কিন্তু আতশবাজির বর্ণনা মেলে। সাধক একনাথের জনপ্রিয় মারাঠি কবিতা 'রুক্মিণী স্বয়ম্বরা'-তে কৃষ্ণ-রুক্মিনীর বিয়েতে আতশবাজির রশনাইয়ের বর্ণনা রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও কিন্তু দীপাবলির অনুষ্ঠানে আতশবাজি জ্বালানোর প্রথা ছিল। মারাঠা সাহিত্য 'পেশওয়াঞ্চি বাখর'-এও উল্লেখ রয়েছে তার। বর্তমান রাজস্থানের কোটাতে নাকি সেসময় চারদিন ধরে দীপাবলি উৎসব পালন করা হত, যেখানে লক্ষাধিক প্রদীপ জ্বালানোর পাশাপাশি বিশাল আতশবাজির প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হত। যাকে বলা হত লঙ্কা অব ফায়ার ওয়ার্কস বা আগুনের লঙ্কা।

এরই মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল, ভারতে ঢুকে পড়ল ব্রিটিশরা। প্রাথমিক ভাবে অবশ্য ইউরোপ ও চিন থেকেই ভারতে আতশবাজি আমদানি হত। উনিশ শতকের দিকে ভারতে প্রথম স্থাপিত হল আতশবাজির কারখানা। এবং সেটি হল খোদ কলকাতার বুকে। স্বাধীনতার পরে সেটি উঠে আসে তামিলনাড়ুর শিবাকাশীতে। ক্রমশ তা হয়ে উঠল ভারতের ফায়ারক্র্যাকার হাব। পি আইয়া নাদার নামে এক ভারতীয় উদ্যোগপতি তাঁর ভাই শানমুগা নাদারের সঙ্গে মিলে তৈরি করলেন দুটি আতশবাজির কারখানা। ১৯২২ সাল নাগাদ তাঁরা ভারতে এসেছিলেন দেশলাই বাক্স শিল্পের বিষয়ে শিখতে। জার্মানি থেকে আমদানি করা মেশিনের মাধ্য়মে সেই ব্যবসায় পাকাপোক্তও হয়ে উঠলেন তাঁরা। ১৯২৫ সাল নাগাদ তাঁদের হাত ধরেই শিবাকাশিতে গড়ে উঠল আতশবাজির কারখানা। তাঁদের হাত ধরেই কার্যত শিবাকাশি হয়ে উঠেছিল আতশবাজির পীঠস্থান। এখন শিবাকাশি জুড়ে পাঁচশোরও বেশি আতশবাজি নির্মাতা রয়েছেন।

মোঘল আমলে দীপাবলিতে আতশবাজির চল থাকলেও শোনা যায়, কোম্পানির আমল থেকেই দীপাবলীর উৎসবের সমারোহে যোগ হয় আতসবাজি। তখন অবশ্য বাংলায় তেমন বাজি তৈরির চল ছিল না। বাজি আসত বাংলার বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। বাজি আমদানি সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল তখন লখনউ। পলাশির যুদ্ধ মানে ১৭৫৭ সালের পরবর্তী সময়ের কথা। কোম্পানির কাছ থেকে বাজি তৈরির লাইসেন্স আদায় করেছিলেন মইনুদ্দি নামে এক বাজিওয়ালা। কালীচরণ সিংহ নামেও এক প্রসিদ্ধ বাজিওয়ালার কথাও শোনা যায় সে সময়। তখনকার বেশিরভাগ বাজিকারিগররাই নাকি ছিলেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। শুধু কি দীপাবলী, সেসময় কলকাতার দেশিবিদেশি বিভিন্ন ভোজসভা থেকে অনুষ্ঠানে, বিনোদনের জন্য আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানোর রীতি ছিল।

পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মেনউইক নামে এক সাহেবের বাগানবাড়ি ছিল সে সময় গার্ডেনরিচে। তাঁর সেই বাগানবাড়িতে বসত বিরাট মেলা। আর সেই মেলার প্রধান আকর্ষনই ছিল হরেক রকম আতসবাজির কসরত ও প্রদর্শনী। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে বাজি তো এল কলকাতায়। কিন্তু সে সময়ে তুবড়ির যত রমরমা ছিল, ততটা হাউই বাজির রমরমা ছিল না। কারণ সে সময়ে কলকাতার বেশিরভাগ বাড়িতেই ছিল খড়ের ছাউনি। হাউই বাজির দৌলতে যে কোনও সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তাই হাউই ছিল নিষিদ্ধ। শিমুলিয়ায় চড়কের মাঠে বিক্রি হত তুবড়ির খোল। কালীপুজোয় কয়েকদিন আগে থেকেই ওই মাঠে শুরু হত বাজি পোড়ানো। তার সঙ্গে ওড়ানো হত ফানুস। হরেক রঙের হরেক আকারের ফানুস। সে কারিগরদের হাতের গুণ ছিল এমনই যে রাতের আকাশে বিভিন্ন জীবজন্তুর চেহারা নিত ওই ফানুস। কখনও বা আলোর লেখনীতে আকাশের গায়ে লেখা হত নানা কথা। পরে অবশ্য সেই তালিকায় ঢুকে পড়ত হাউইও। রীতিমতো প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। অভিজাত পরিবারগুলির তরফে রীতিমতো অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হত নানা ধরনের বাজি। মফস্সল থেকে ছুটে আসতেন মানুষ শুধু ওই বাজি পোড়ানো দেখতে। বাজি পোড়ানোর এই চল কিন্তু বাংলা রপ্ত করে উত্তর ভারত থেকেই। বিশের দশকে শুরু হলেও ১৯৪০-এর সময়ে রমরমিয়ে উঠেছিল শিবকাশীর বাজির কারবার। সেই বাজির বাজার অবশ্য এখনও বিখ্যাত। বাংলায় বাজির এই যে ছোঁয়াচে চল, তার পিছনে কিন্তু বড় হাত ওই শিবকাশী বাজির বাজারেরই।

আরও পড়ুন: বোমাবাজি থেকে কালীপুজো! রূপোলি পর্দার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় বাস্তবের ‘ফাটাকেষ্ট’

ক্রমে সেই বাজির বাজার পৌঁছে গিয়েছিল উচ্চবিত্তের হাত থেকে মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যে। দীপাবলির পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবেও চলতে থাকে আতশবাজির রমরমা। তবু দীপাবলীর সঙ্গে আতশবাজির সম্পর্ক যেন চিরন্তন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের লাল চোখের সামনে তৈরি হয়েছে পরিবেশবান্ধব বাজি। আইনের ফাঁকফোকর গলে দেদার ফোটে শব্দবাজিও। কালীপুজোর আসতে না আসতেই আকাশের বুকে ফুটতে থাকে আতশবাজি দিয়ে লেখা উৎসবের নকশা। যার আবেদন বোধহয় এড়ানো আজও কঠিন।

More Articles