ট্রাম্প-মাস্ক বন্ধুত্বই তবে কাল? কেন ‘এক্স’ ছেড়ে ভিড় বাড়ছে ডরসির ‘ব্লুস্কাই’য়ে?
X vs Bluesky: তার পর থেকেই নাকি হু হু করে কমছে মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এর ইউজার সংখ্যা। জানা গিয়েছে, গত কয়েকদিনে বিরাট সংখ্যক ইউজার এক্সের পরিবর্তে বেছে নিয়েছেন বিকল্প ব্লু স্কাইকেই।
সদ্য রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে আমেরিকায়। ফের জনগণের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন রিপাবলিক প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। শোনা যায়, যাকে ক্ষমতায় আনতে কোটি কোটি অর্থ খরচ করেছেন এই ধনকুবের। ট্রাম্পকে ভোট দিলে জনগণের জন্য মিলিয়ন ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তার ফলও মিলেছে হাতে হাতে। ট্রাম্প তো ক্ষমতায় ফিরেইছেন, তার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের তরফে এলন মাস্কের জন্য রয়েছে পাল্টা উপহার। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি অর্থাৎ সরকারি দক্ষতা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এলন মাস্ককে। এবং তার পর থেকেই নাকি হু হু করে কমছে মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্স-এর ইউজার সংখ্যা। এক্সের বিকল্প হিসেবে অন্য একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দরজায় বাড়ছে ভিড়। জানা গিয়েছে, গত কয়েকদিনে বিরাট সংখ্যক ইউজার এক্সের পরিবর্তে বেছে নিয়েছেন বিকল্প ব্লুস্কাইকেই।
২০২২ সালে টুইটার অধিগ্রহণ করেন স্পেস এক্স ও টেসলার সিইও এলন মাস্ক। অ্যালফাবেট ইনক থেকে শুরু করে মাইক্রোসফট, ওয়াল্ট ডিজনির মতো বাঘা বাঘা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছনে ফেলে টুইটার ছিনিয়ে নেন এলন। রাতারাতি তার নাম বদলে রাখা হয় এক্স। পাল্টে যায় লোগো। শুধু নাম নয়, এর পর অধুনা এক্সের অন্দরমহলে নানা রদবদল হতে থাকে। ক্ষমতায় এসেই টুইটারের প্রাক্তন সিইও পরাগ আগরওয়ালকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মাস্ক। একের পর শীর্যস্থানীয় বহু কর্মীই ছাঁটাই হতে থাকেন। নীল-সাদা থিম পাল্টে এক্সের মূল থিমই হয়ে যায় কালো, রাতারাতি ডানা মেলে উড়ে চলে যায় নীল রঙের সেই ছোট্ট পাখিটিও। শোনা যায়, এক্সের খরচ সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে ব্রিটিশ এই ধনকুবেরকে। সানফ্রান্সিসকোয় টুইটার অর্থাৎ অধুনা এক্সের সদরদফতর থেকে একে একে নিলামে তুলতে হয়েছে আসবাব থেকে শুরু করে কফি মেশিন পর্যন্ত। আরও নানা প্রশাসনিক বদল তো বটেই, এমনকী এই মাইক্রোব্লগিং সাইটটির পলিসিতেও একাধিক বদল আসে।
আরও পড়ুন: ভোটে জেতানোর পুরস্কার! ট্রাম্পের প্রশাসনে যে দায়িত্ব পেলেন এলন মাস্ক
জ্যাক ডরসি, নোয়াহ গ্লাস, বিজ স্টোন এবং ইভান উইলিয়ামস নামে চার জনের হাত ধরে ২০০৬ সালে তৈরি হয়েছিল টুইটার নামক এই সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম। কার্যত সে সময়ে দাঁড়িয়ে মাইক্রোব্লগিং সাইটটি ছিল এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার। রাতারাতি জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলে যা। তবে টুইটারের হস্তান্তর এবং এলন মাস্কের একের পর এক তুঘলকি সিদ্ধান্তের ফলে সেই জনপ্রিয়তা খানিকটা হলেও পড়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের পর নাকি তড়তড়িয়ে পড়েছে টুইটারের ইউজার। পরিবর্তে ইউজারেরা ঝুঁকছেন ব্লুস্কাইয়ের দিকে।
যতদূর জানা গিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হতে না হতে দেখা গিয়েছে প্রায় ১ মিলিয়ন ব্যবহারকারী চলে গিয়েছেন এক্স-এর প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্ম ব্লুস্কাইতে। একসময় নেতা-মন্ত্রী থেকে ক্রিকেটার, অভিনেতা, গায়কের মতো বহু পেশার মানুষের কাছে নিজেদের মতামত দুনিয়ার সামনে তুলে রাখার মূল মাধ্যম ছিল টুইটার তথা এক্স। আমেরিকার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন মুলুকের বহু অভিনেতা, সাংবাদিক, গায়ক থেকে শুরু করে নানা বিশিষ্ট ব্যক্তিই নাকি এক্স-কে ত্যাগ করে হাত ধরেছেন ব্লুস্কাইয়ের। আমেরিকার অ্যাপল অ্যাপ স্টোর এবং গুগল প্লে স্টোরের অ্যাপ ডাউনলোড চার্টের শীর্ষে রয়েছে এখন ব্লুস্কাইয়ের অ্যাপটিই।
এর নেপথ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি এলন মাস্কের অকুন্ঠিত সমর্থনকেই দায়ী করছেন ওয়াকিবহাল মহল। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্পকে ভোটে জেতানোর জন্য প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ খরচ করেছেন মাস্ক। সে সময় থেকেই বহু এক্স ব্যবহারকারীই ধুয়ো তুলেছিলেন, রিপাবলিকান নেতা ক্ষমতায় এলে এক্স প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করবেন তাঁরা। এক্স ছেড়ে দলে দলে লোক ব্লুস্কাই প্ল্যাটফর্মে চলে যাওয়ার ঠিক দু'দিন আগেই এলন মাস্ককে নিজের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন ট্রাম্প। যে সিদ্ধান্তকে ভালো মনে মানেননি অনেকেই। সেটাও টুইটার থেকে মানুষের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
bluesky's user count grew by another million today
— bluesky (@bluesky) November 18, 2024
welcome to all 19M of you 🥳https://t.co/x6v5YW0WFT pic.twitter.com/FtCvcyyr20
কী এই ব্লুস্কাই। এক্সের মতোই একটি সোশ্যাল মাইক্রোব্লগিং প্ল্যাটফর্ম এই ব্লুস্কাই। টুইটারের তৎকালীন সিইও জ্যাক ডরসিই পরবর্তী কালে টুইটারের একচ্ছত্র রমরমা কমিয়ে আনতে তৈরি করেছিলেন আরও একটি সোশ্যাল মাইক্রোব্লগিং সাইট। পরবর্তী কালে তাঁর সাধের টুইটারের ভবিষ্যৎ আগেভাগেই বুঝি দেখে ফেলেছিলেন তিনি। ২০২১ সালে ব্লুস্কাই ছিল পরীক্ষানিরিক্ষার পর্যায়ে। ওই বছরেরই অগস্ট মাসে জে গ্র্যাবারকে নিয়োগ করা হয় ব্লুস্কাই প্রকল্পকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ততদিনে টুইটার অধিগ্রহণ নিয়ে দড়ি টানাটানি শুরু হয়ে গিয়েছে। ওই বছরেরই অক্টোবরে 'ব্লুস্কাই সোশ্যাল' নামে ব্লুস্কাই প্রজেক্টকে স্বাধীন কোম্পানি হিসেবে নথিবদ্ধ করেন গ্র্যাবার। ২০২২ সালে তো টুইটার চলেই গেল মাস্কের হাতে। তার আগেই অবশ্য ব্লুস্কাই পেয়ে গিয়েছে তার প্রথম তিন কর্মীকে। মাস্কের হাতে টুইটার চলে যাওয়ার পরেই সেই সংস্থার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে আইনি ও আর্থিক ভাবে পৃথক সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ব্লুস্কাই। ২০২৩ সালেই ব্লুস্কাইয়ের বেটা ভার্সন আইওএস মডেলগুলিতে এসে যায়। রেকর্ড বলছে, ওই বছরের এপ্রিল মাসে প্রায় ৫০ হাজার ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সেটি। তার পর ছোট্টো ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে জনতার দরবারে পৌঁছে যায়। কার্যত এক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী তো বটেই, পাশাপাশি শিল্পী, বামপন্থীরা তো বটেই, পাশাপাশি কৃষ্ণাঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডার, যৌনকর্মীর মতো বহু কোণঠাসা ব্যক্তিমানসেরই স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল এই ব্লুস্কাই।
এতদিন যা ছিল হাতে গোনা কয়েকজনের ব্যবহারের মাধ্যম, মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের পর সেই ব্লুস্কাই যেন পৌঁছে গেল আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে। যাঁরা মাস্কের এক্স ছেড়ে ব্লুস্কাইয়ের দিকে ঝুঁকছেন, তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, ব্লুস্কাইয়ের ক্ষেত্রে একটা অরাজনৈতিক ভাবনার জায়গা রয়েছে। সেটাও মানুষকে আকৃষ্ট করেছে ভোটের বাজারে তার দিকে টানতে। ব্লুস্কাইয়ের ক্ষেত্রে আরও একটা বড় সুবিধার জায়গা হল, ব্লুস্কাই প্ল্যাটফর্মে ইউজাররা নিজেদের মতো অ্যালগরিদম বেছে নিয়ে নিজেদের ফিড-কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পাশাপাশি ইউজারদের নিজেদের হ্যান্ডেলে ওয়েবসাইট অ্যাড্রেস ব্যবহারেরও অনুমতি দেয় এই নয়া প্ল্যাটফর্ম। যা বিখ্যাত ব্যক্তি, খেলোয়ার বা সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন টুল হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে।
আরও পড়ুন: মঙ্গলগ্রহে ইন্টারনেট বসাতে উদ্যোগী এলন মাস্ক! কারা ব্যবহার করবে এই নেটওয়ার্ক?
মার্কিন নির্বাচনের পর রাতারাতি তুমুল ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্লুস্কাই। গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ৪২ হাজার মডারেশন রিপোর্ট পেয়েছে ব্লুস্কাই প্ল্যাটফর্ম। যেখানে ২০২৩ সালে সেই সংখ্য়াটা ছিল ৩ লক্ষ ৬০ হাজারের কাছাকাছি। আপাতত এই ভয়ঙ্কর ইউজার স্রোত সামাল দিতে আরও কর্মী নিয়োগের ভাবনাচিন্তা করছেন ব্লুস্কাই কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই নতুন ইউজারদের সাইন আপ করার ক্ষেত্রে ইমেইল ভেরিফিকেশনও চালু করেছে ব্লুস্কাই।
তবে কি ব্লুস্কাইয়ের এই রমরমিয়ে বেড়ে চলা জনপ্রিয়তা ক্রমশ গ্রাস করতে চলেছে এক্সের দাপট? এলন মাস্কের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগই কাল হল তাঁর সোশ্যাল ব্লগিং সাইট এক্সের জন্য। তবে ইতিহাস সাক্ষী, ধনকুবের এলন মাস্ক বরাবরই আপন মর্জির মালিক। তিনি কখন কী করেন, কখন কার পক্ষে যান, তা হিসেব করে বোঝা মুশকিল! এত যুদ্ধ করে যে টুইটারের দখল নিয়ে তাকে খেটেখুটে এক্স বানালেন মাস্ক, সেই এক্সের বাজারে শেষপর্যন্ত পুনর্দখল করবে জ্যাক ডরসির ব্লুস্কাই প্রতিষেধক? আমেরিকা থেকে শুরু হয়েছে যে ট্রেন্ড, তা কি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে? তার উত্তর মিলবে অচিরেই।