প্রযুক্তির দুনিয়ায় নয়া বিপ্লবের নাম অ্যাজেন্টিক AI, জানেন কী কী করতে পারে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
Agentic AI: অন্যান্য এআই মডেলগুলি মানুষের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু অ্যাজেন্টিক এআই নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, পরিকল্পনা করতে পারে এবং কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আরও আপডেট করতে পারে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আলোচনা হচ্ছিল। তখন এআই-এর গাণিতিক তত্ত্বও আবিষ্কার হয়েছিল, তবে এই বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের জন্য যে ম্যাথম্যাটিক্যাল মডেলের প্রয়োজন ছিল তা তখনও আবিষ্কার হয়নি। গত কয়েক বছরে এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এআই খ্রিস্টধর্মের তত্ত্ব সম্পর্কে মতামত দিয়েছে, কবিতা লিখেছে, পদার্থ বিদ্যার কোয়ান্টাম থিওরি বুঝিয়ে দিয়েছে শিশুকে। এআই-এর প্রথম গ্রাহক মাইক্রোসফট, মার্কিন ব্যাঙ্ক মেরিল লিঞ্চ, এবং আইসল্যান্ডের সরকার। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের চাকরির ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এই আশঙ্কা অনেক দিন ধরেই করছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন অ্যাজেন্টিক এআই নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ শুরু হতেই এই চিন্তা আরও বেড়েছে। অ্যাজেন্টিক এআই-এর ক্ষমতা দেখে সারা বিশ্বের প্রযুক্তি বিষয়ক নীতি-নির্ধারক, বিনিয়োগকারী এবং নির্বাহীরা বলছেন, মানবজাতি বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে। কেন অ্যাজেন্টিক এআই বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে?
অ্যাজেন্টিক এআই কী?
অ্যাজেন্টিক এআই হল এক ধরনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পদ্ধতি। অন্যান্য এআই মডেলগুলি মানুষের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু অ্যাজেন্টিক এআই নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, পরিকল্পনা করতে পারে এবং কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আরও আপডেট করতে পারে।
অন্যান্য এআই-এর পক্ষে সব ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অ্যাজেন্টিক এআই প্রায় সব ধরনেরই কাজ করতে সক্ষম। এমনকী মানুষের করে দেওয়া প্রোগ্রামের বাইরেও অনেক কাজ করতে পারে সে। এই প্রযুক্তি যত বেশি ব্যবহার করা হয়, এরা নিজে থেকে তত নতুন কাজ শেখে এবং নিজেকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করে তোলে।
আরও পড়ুন:কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: যন্ত্রের যন্ত্রণা নাকি আধুনিক যুগের শাণিত হাতিয়ার?
ট্র্যাডিশনাল এআই থেকে আলাদা অ্যাজেন্টিক এআই। অ্যাজেন্টিক এআই-কে একটি ওয়েব সাইট বানাতে বললে এটি নিজে থেকে একটি লক্ষ্য তৈরি করে ওয়েব সাইট বানায়। ধাপে ধাপে ওয়েব সাইটের কাঠামো বানায়, স্ক্রিন লে আউট বানায়, প্রতিটি পেজের জন্য আলাদা কন্টেন্ট বানায়, নিজে থেকে এইচটিএমএল (HTML), সিএসএস (CSS) কোড এবং ব্যাকএন্ড(Backend) কোড লেখে। এর পর ভিস্যুয়াল ডিজাইন করে, প্রয়োজনীয় গ্রাফিক্স ইনপুট করার পর শেষে টেস্ট করে দেখে ওয়েবসাইটটি যথাযথ হয়েছে কিনা? যদি কোনও সমস্যা থাকে তার সমাধান করে। এই সকল কিছু অ্যাজেন্টিক এআই নিজে থেকেই করতে পারে।
অ্যাজেন্টিক এআই কি চাকরিতে প্রভাব ফেলতে পারে?
এইচএফএস (HFS)-এর গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, অ্যাজেন্টিক এআই-এর কারণে অনেক মানুষের চাকরি হুমকির মুখে পড়বে। এটা শ্রমের চাহিদা কমাতে পারে, মজুরিতে প্রভাব ফেলতে পারে এবং চাকরিও চলে যেতে পারে, এমনই তথ্য সামনে এসেছে এই গবেষণায়।
এত দিন যে সকল কাজ মানুষ নিজে করে আয় করত, সেই কাজগুলি এখন অ্যাজেন্টিক এআই একাই করে ফেলতে পারবে। যেমন তথ্য বিশ্লেষণ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ, কোনওকাজ সম্পাদনা করা ইত্যাদি। কৌশলগত পরিকল্পনার দিক থেকে দেখতে গেলে এই প্রক্রিয়া নিজে থেকে তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারবে, কী কী পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে তা খতিয়ে দেখতে পারবে এবং অপারেশনগুলোয় সাফল্য পেতে নিজে থেকে পরিকল্পনা করতে পারবে, এবং কোন সময় ঠিক কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারবে একাই।
অনেকগুলি ফাংশনে একসঙ্গে কাজ করতে পারে এটি। সাধারণত একসঙ্হে একাধিক ফাংশনে কাজ করতে গেলে, অনেকগুলি টুলের প্রয়োজন হয়। এই ক্ষেত্রে কাজ করতে আর্থিক পরিকল্পনা দেওয়া, পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থেকে পণ্য সরবরাহ করা এই সকল কিছু আলাদা আলাদা ভাবে করতে হয় না, অ্যাজেন্টিক এআই একাই এই কাজগুলি একসঙ্গে করতে পারে। ফলত কোম্পানিগুলির খরচ কম হয়। এর ফলে কম্পানিগুলোর মাল্টিপল লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় না এবং কোনও চুক্তিও মানতে হয় না।
এটি সাধারণ ভাষাকেও বুঝতে পারে, কাজগুলি আলোচনা করতে পারে, সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত এবং কেন নেওয়া উচিত সেটাও বলে দিতে পারে এতে এই পদ্ধতিতে কাজ করা আরও সুবিধে হয়ে যায়।
অ্যাজেন্টিক এআই কীভাবে ব্যবহার হতে পারে?
বাণিজ্য : অ্যাজেন্টিক এআই ব্যবসায় আমূল পরিবর্তন আনবে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটবে। অ্যাজেন্টিক এআই অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের চেয়েও দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে কাজ করে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুব দ্রুত বাণিজ্যিক কাজে এটার ব্যবহার শুরু হবে, অনেক মানুষ এটার ব্যবহার করতে শুরু করবে। তখন চাকরির বাজারেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
স্বাস্থ্য : রোগীরা চেকআপে গেলে অ্যাজেন্টিক এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতে পারে। যেমন, রোগীরা আগে কোন রোগের চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, কী ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, কত দিন আগে এসেছিলেন ইত্যাদি। অ্যাজেন্টিক এআই প্রতিদিন রোগীকে মনিটর করে সম্ভাব্য রোগের কথাও বলতে পারে।
সফ্টওয়্যার ডেভলপমেন্ট : অ্যাজেন্টিক এআই আর্কিটেকচার ডিজাইন করতে পারে,কোড লিখতে পারে। একটি ডিজিটাল প্রোডাক্ট কে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, তা বলে দিতে পারে অ্যাজেন্টিক এআই।
সাইবার সিকিউরিটি : অ্যাজেন্টিক এআই নেটওয়ার্ক ট্রাফিকের ওপর নজর রাখতে পারে এবং সাইবার হুমকি নিয়ে সচেতন করতে পারে।
আর্থিক: বাজারে কোন পণ্যের কতটা চাহিদা তা বিশ্লেষণ করে জানাতে পারে, পরিস্থিতি বুঝে বিনিয়োগ করার কৌশলগুলি বলতে পারে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা : অ্যাজেন্টিক এআই বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী টুল হতে পারবে। এটি গবেষকদের পুরো বিশ্বকে জানতে সাহায্য করবে। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্য বিশ্লেষণ, অনুমান সবটাই করতে পারে অ্যাজেন্টিক এআই। ফার্মাসিউটিক্যালে নতুন ওষুধের আবিষ্কারের মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শাখায় অ্যাজেন্টিক এআইকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
অ্যাজেন্টিক এআই কী কী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে?
মানুষ যে সব কাজ করে উপার্জন করে, তার একটা বড় অংশ আগামীতে মেশিনের হাতে চলে যাবে। অনেক ক্ষেত্রেই এই পদ্ধতি শুরুও হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মধ্যে কাজ হারানোর ভয় তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এছাড়াও ফেক নিউজ, ফেক ইভেন্ট আরও বাড়তে পারে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারে ডিজিটাল ডিভাইডের মতো বৈষম্য আরও প্রকট হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে মানুষের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিভাজন অনেকটাই বেড়ে যাবে।
গুগলের একজন মার্কিন টেকনিক্যাল ম্যানেজার তানজিম আহসান এআই নিয়ে বিবিসি-কে জানিয়েছেন, সুপার কম্পিউটিং পাওয়ারের জন্য এই সকল কিছু করা সম্ভব হচ্ছে। তাঁর কথায়, “গত কয়েক বছরে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আগে কোনও কোম্পানি যদি ইন্টেল সিপিও বানাত, ওরাই শুধু জানতো এটা কীভাবে বানাতে হয়? এটা ছিল বিশেষ একটা জ্ঞান। কিন্তু এখন এই সেমিকন্ডাক্টর একটা পণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা যেমন যে কোনও জায়গা থেকে একটা পেরেক কিনতে পারি, এখন সেমিকন্ডাক্টরের বিষয়টাও সেরকম হয়ে গেছে।' তিনি আরও বলেন, 'এই শিল্পের এ ধরনের বিস্ফোরণের ফলে যে কেউ যে কোনও জায়গা থেকে এটা কিনে একটা প্লাটফর্ম বানিয়ে সেটার উপর যে কোন ধরনের মডেলিং ও টেস্টিং করতে পারে আমাজন, গুগল এবং মাইক্রোসফ্ট এই তিনটি বড় কোম্পানি ক্লাউড সার্ভিস তৈরি করার কারণে বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে একটা মুদির দোকানও সেটা ব্যবহার করতে পারে যা আগে ছিল অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু এখন এই সুপার কম্পিউটিং পাওয়ারের কারণে যে কেউ-ই এসব কাজ করতে পারছে। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গণতন্ত্রায়ন হয়েছে।”
আরও পড়ুন: বুদ্ধি ফুটুক নাই ফুটুক, AI জাগ্রত দ্বারে!
এআই যে মানুষের থেকে বেশি বুদ্ধিমান না হলেও, মানুষের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে তা বোঝাই যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এআই আরও উন্নত হতে হতে মানুষও এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবে। যেহেতু মানুষই এই প্রক্রিয়া বানিয়েছে, তাই এটি মানুষকে ছাপিয়ে গেলেও মানুষ এআই-কে তার সীমাতে বেঁধে দিতে পারবে। যেমন বলা যায়, এআই ব্যবহার করে কিছু রাজনীতিবিদ ফেক নিউস ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে, এআই ব্যবহার করেই ফেক নিউস শনাক্তও করা হচ্ছে। প্রযুক্তিবিদদের মতে, এআই-এর আরও উন্নত প্রযুক্তি আসবে কিন্তু মানুষের প্রয়োজন কখনও শেষ হয়ে যাবে না। তবে, ভুল মানুষের দ্বারা এটি পরিচালিত হলে তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। মনে রাখা দরকার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা ভয়ঙ্কর রূপও নিতে পারে। তাই এআই নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং অপব্যবহার বন্ধ করতে আইনগত সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।