এই চটছেন, পরক্ষণেই যোগমুদ্রায়! রামদেব মানেই বিতর্ক
যোগগুরু বাবা রামদেবের রোষের মুখে এবার সাংবাদিক। দিনের পর দিন হু হু করে বেড়ে চলেছে তেলের দাম। ইউপি ইলেকশনের আগে যদিও তেমন বাড়েনি, কিন্তু বিজেপি জেতার ঠিক পর থেকেই আবার নিজের গ্রাফ বজায় রেখেছে তা। সম্প্রতি পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বেড়েছে ৮০ পয়সা প্রতি লিটার। এই নিয়ে গত দশ দিনে তেলের দাম বেড়েছে ৬ টাকা ৪০ পয়সা। দিল্লিতে পেট্রোল এখন লিটার প্রতি ১০১.৮১ টাকা, ডিজেল ৯৩.০৭ টাকা। মুম্বইয়ে পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ১১৬.৭২ টাকা, চেন্নাইয়ে তা ১০৭.৪৫ টাকা এবং কলকাতায় ১১১.৩৫ টাকা। ডিজেলের দাম কলকাতায় ৯৬.২২ টকা প্রতি লিটার। চারিদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে মানুষ যখন হাঁসফস করছে তারই মাঝে ক্রমাগত জ্বালানির দাম বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্র সরকার।
এই নিয়েই এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন রামদেবকে। ২০১৪ সালে লাগাতার প্রচারে বলে আসছিলেন রামদেব যে মূল্যবৃদ্ধি দেশের অন্যতম শত্রু। আপনারা কাকে ভোট দেবেন? যে সরকার তেলের দাম ৭০-৮০ টাকা নেয়, নাকি ৩০-৪০ টাকা–অর্থাৎ সহি দাম নেয় যারা? বিজেপির প্রচারে বারবার বলেছিলেন কংগ্রেসকে হারাতে পারলেই হবে মূল্যবৃদ্ধির সুরাহা
রামদেবকে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই। লোকজনের অসুবিধাও হচ্ছে। দাম কমাটাই উচিত। কিন্তু কী আর করা যাবে? দেশের দুর্দিনে একটু বেশি পরিশ্রমই কাম্য জনতার কাছ থেকে। আমি সন্ন্যাসী হয়ে সকাল চারটেয় উঠি, রাত দশটায় শুতে যাই। সমানে কাজ করি। আর ট্যাক্স না নিলে সরকার মাইনে কীভাবে দেবে, রাস্তা কীভাবে বানাবে? নিতেই হবে।”
বেশি খেটে নিজের ট্যাক্স উশুল করার ব্যাপারটা সাংবাদিকের খুব একটা বোধগম্য হয় না। কাজেই সাংবাদিক পূর্বে তাঁর ওই তেলের দাম কমে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিতে চাইলেই চটে যান বাবা। বলেন, “একদম এসব প্রশ্ন করবে না। আমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ঠিকা নিয়ে রেখেছি নাকি? বলেছিলাম বলেছিলাম, এখন আর বলছি না। হয়ে গেল। যা পারবে করে নাও।” মেজাজ হারিয়ে অত্যন্ত কদর্য ভাবে আক্রমণের এই ভিডিওটি ভাইরাল হয়। এবং শুধু সেখানেই থামেননি রামদেব। সাংবাদিককে হুমকিও দেন তিনি। বেশি প্রশ্নের ফল খুব একটা মধুর হবে না–জাতীয় উক্তি করেন। এই ধরনের বক্তব্যে ফের বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন-নিজেকে ভালোবাসো তুমি এবার, এ কথাটাই কী ভাবে শেখাবেন সন্তানকে!
বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বরবার বিতর্কের কেন্দ্রেই থাকেন রামদেব। কেন্দ্রীয় সরকারকে সঙ্গে বেরাদারি আর পতঞ্জলির উত্থান এখন সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এককালীন প্রাণায়ম প্রচারকারী বাবা কোন ফাঁকে ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন এবং মানুষের ধর্মীয় আবেগের সুযোগ নিয়ে প্রোডাক্ট বিক্রি করতে লাগলেন চুটিয়ে, তা অনেকেই ঠাওর করতে পারে না।
সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু গোল বাঁধে মহামারী ভাঙিয়ে খাওয়ার অতি কাঁচা একটি চালে। মহামারীর সময় থালা ব্যান্ড, মশাল মিছিল ইত্যাদি অভূতপূর্ব অঙ্গভঙ্গির সাক্ষী থেকেছে ভারত। সেই সাড়ার পরিমাণে আত্মবিশ্বাসে দড় রামদেব ঘোষণা করে বসলেন করোনার ওষুধ তিনি আবিষ্কার করে ফেলছেন। এবং নাম রেখেছেন কোরোনিল। কিন্তু ভ্যাকসিনের আগমণের প্রাক্কালে এধরনের অযাচিত সাধু উদ্দেশ্যে খানিক নড়েচড়েই বসে কেন্দ্র সরকার। অঙ্গুলি হেলে। এবং কয়েকদিনের মাথায় আয়ুষ মন্ত্রক থেকে সরাসরি ৫৪৫ টাকা দামের এই পণ্য়ের বিজ্ঞাপণের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসে। যতক্ষণ না সরকার সমস্ত কাগজপত্র খতিয়ে দিচ্ছে ততদিন। মাত্র একদিনের মাথায় উত্তরখণ্ডের আয়ুর্বেদ বিভাগ জানায় ওষুধটির লাইসেন্স পাওয়ার আবেদনপত্রে ‘করোনা ভাইরাস’ শব্দটি বারেক উচ্চারণ করতেও ভুলে গিয়েছে পতঞ্জলী। বিক্ষুব্ধ জনতা অবিলম্বে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় রামদেবকে। দুটি ধারায় অভিযুক্তও হয় পতঞ্জলী।
সে সময় অ্যালোপ্যাথিকে ‘বোগাস বিজ্ঞান’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। এমনকি বাবার ক্রোধ, “রেমেডিসিভির, ফ্যাবিফ্লু ও অন্যান্য ওষুধে আদতে কোনও কাজ হয় না, লাখে লাখে মানুষ এই ওষুধ নিয়ে মারা যাচ্ছে”--দাবি করা অবধি ব্যপ্ত হয়। কিন্তু ড্রাগস্ কন্ট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়ার অনুমোদিত ওষুধ ঘিরে এই অহেতুক বিতর্ক তৈরির চেষ্টাকে খুব একটা হালকা ভাবে নেননি ডাক্তারেরা। অবশেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন একটি কড়া চিঠি পাঠান রামদেবকে। এতে বাবার রাগ সঙ্গে সঙ্গে জল হয়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষমাটমাও চেয়ে নেন।
আরেকটু পিছনে যাই। ২০১৫ সাল। পতঞ্জলির ‘ইন্সট্যান্ট নুডল্স” বেরলো। সঙ্গে সঙ্গে এফএসএসএআই-এর (ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ) নিষেধাজ্ঞা। ব্যাপার কী? চারিদিক সরগরম। শেষে জানা গেল এফএসএসএআই-এর অনুমোদনই নেয়নি কোম্পানিটি। আটা নুডলস্-এর ক্ষেত্রে কেসটা একটু ঘোরালো। চাপের মুখে সেই প্রোডাক্টে দেখা গেল ঠিকঠাক একটি লাইসেন্স নাম্বার রয়েছে। কিন্তু এফএসএসএআই-এর ধরন-ধারণ খুব একটা সুবিধের না। একবার ঠকে এবার তারা কিঞ্চিৎ সাবধান হয়ে গিয়েছিল। খতিয়ে দেখা হল। এবং এফএসএসএআই-এর তৎকালীন প্রধান আশিষ বহুগুণা জানালেন, “এ লাইসেন্স নাম্বার জালি। প্রোডাক্ট অনুমোদিতই হয়নি, লাইসেন্স নাম্বার আসবে কোত্থেকে? কীভাবে লাইসেন্স নাম্বার এল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” শেষমেশ সরকারের নোটিশ খায় কোম্পানিটি, তথা বাবা রামদেব। চিরকালই আত্মবিশ্বাসে চওড়া ছাতির দাম একটু বেশিই দিতে হয়েছে তাঁকে। বিশেষত ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বত্র যখন সরু গলিঘুঁচি। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তৈলবিতর্কে মেজাজ হারিয়ে ফেলাটা রামদেবকে নতুন মাত্রা দিল এমনটা একেবারেই নয়, বরং ব্যাপারটা স্বাভাবিকই।