পঙ্গপাল ভাজা থেকে রেশমকীটের স্যুপ! খাবার পাতে পোকা কেন অনুমোদন পেল সিঙ্গাপুরে?

Insects as Food: চিন, জাপান শুধু নয়, এবার সিঙ্গাপুরেও খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিল পোকামাকড়-খাদ্য। গত ৪ জুলাই সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় খাদ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে ১৬টির প্রজাতির কীটপতঙ্গকে দেশে বিক্রয় ও খাওয়ার।

খাবার পাতে ফড়িং ভাজা কিংবা পঙ্গপালের কোর্মা! ভাবতে পারেন? শুনে নাক কোঁচকালেও বহু দেশেই কিন্তু ভারী আহ্লাদের সঙ্গে খাওয়া হয় এই সব খাবারদাবার। চিন, জাপান শুধু নয়, এবার সিঙ্গাপুরেও খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিল পোকামাকড়-খাদ্য। গত ৪ জুলাই সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় খাদ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে ১৬টির প্রজাতির কীটপতঙ্গকে দেশে বিক্রয় ও খাওয়ার। এই মর্মে একটি সার্কুলারও জারি করা হয়েছে।

বিশ্ব জুড়েই বিকল্প খাবারদাবারের খোঁজ চলছে বহু দিন ধরেই। বিজ্ঞানীরা দিন রাত গবেষণা করে চলেছেন এ নিয়ে। আসলে মানুষ যেভাবে দিনের পর দিন সর্বভুক হয়ে পড়ছে, তাতে বিপদের মুখে পড়ছে খাদ্যভাণ্ডার। ফলমূল, শাকপাতা, বীজ-কন্দ থেকে শুরু করে প্রাণীজাত খাবারদাবার, কী নেই মানুষের পাতে। প্রাণীজাত খাবারদাবারের বিকল্প খুঁজতে একদিন শুরু হয়েছিল ভেগান আন্দোলন। সেখানে শুধু প্রাণীজ মাংস নয়, প্রাণীজাত যে কোনও ধরনের পদার্থই খাওয়া নিষেধ। এমনকী বাদ দুধ-পনিরও। তার বিকল্প হিসেবেই বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছেন সোয়াদুধ বা টোফুর মতো উপাদান।

আরও পড়ুন: ঝিঁঝিঁ পোকা দিয়ে তৈরি আইসক্রিম! হু হু করে কেন বিকোচ্ছে এই বিচিত্র খাবার?

তবে যারা আদ্যোপান্ত নিরামিশাষী নন, আমিষেই যাঁদের প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি, তাঁদের পাল্লায় পড়ে সংকটে প্রাণীজগতের বড় অংশ। সিঙ্গাপুরেই তো দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরিসৃপ ও পাখি খাওয়ার চল। এদিকে বহু ক্ষেত্রেই সেই পরিমাণ প্রোটিনের জন্য মানুষকে ভরসা করতে হচ্ছে প্রাণীজ খাবারদাবারের উপরেই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, চিনা-জাপানিরা দিব্যি কচমচিয়ে পোকামাকড় খায়। আরশোলা, ফড়িং, পঙ্গপাল, রেশম কীট থেকে শুরু করে কী নেই সেই তালিকায়। আর এই সব পোকামাকড়ে যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন ও পুষ্টিগুণও থাকে। এ দেশেও তো বহু জায়গাতেই পিঁপড়ের ডিম খাওয়ার চল। সম্প্রতি তো ভারতে জিআই ট্যাগও পেয়েছে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের বিখ্যাত পিঁপড়ের ডিমের চাটনি। আদিবাসী নিম্নবর্গের মানুষেরা বহু যুগ ধরে এই খাবারটি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ করেছেন।

ঠিক তেমন ভাবেই এই সব পোকামাকড়ও কিন্তু হয়ে উঠতে পারে প্রাণীজ প্রোটিনের দুর্দান্ত বিকল্প। তাছাড়া বহু ক্ষেত্রেই এই সব পোকামাকড়েরা মানুষের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। বিশেষত পঙ্গপাল। একবার ক্ষেতে পঙ্গপালের হামলা হলে আর দেখতে হবে না, মাঠ কে মাঠ শস্য উধাও হয়ে যাবে ওই সব বিপজ্জনক পোকার দাপটে। সেই পঙ্গপালকে যে এমন একটা মহৎ কাজে ব্যবহার করা যায়, সেই বুদ্ধি কার্যত বিস্মিত করেছে বিজ্ঞানীদের। বছর দুয়েক আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই সব বিকল্প খাবারদাবার নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিল। তারা খাদ্য়তালিকায় জায়গা দেওয়ার কথাও ভাবে। চাল বা আটার মধ্যে থাকা পোকা কিংবা নিশুত রাতে ঝোপের ধারে একটানা ডেকে চলা ঝিঝি, এ সবই কিন্তু হতে পারে বিকল্প খাবারের দুর্দান্ত উৎস।

আর এবার সেই কাজটাই সরকারি ভাবে করে দেখালো সিঙ্গাপুর। সেখানকার খাদ্যতালিকায় ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে ষোলো প্রজাতির পোকামাকড়। সিঙ্গাপুরের স্টেট ফুড এজেন্সি (এসএফএ) জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে তারা পোকামাকড় ও ওই জাতীয় খাদ্য আমদানিতেও অনুমোদন দেবে। সেই খাদ্যতালিকায় রয়েছে পঙ্গপাল, ফড়িং, রেশমকীট এবং বিভিন্ন প্রজাতির বিটল বা গুবরে পোকা। খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীদের খাবার হিসেবে তো বটেই, মানুষের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে এই সব পোকামাকড়। তবে এই সব পোকামাকড়দের যেহেতু বাস্তুতন্ত্রের উপর আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে, সেহেতু খেয়াল রাখতে হবে যাতে এদের প্রজাতি বিলুপ্তি বা সঙ্কটের মুখে না পড়ে। সে কারণে বনজঙ্গল থেকে এসব পোকামাকড় সংগ্রহ করা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যে কোনও অনুমোদিত খামারে চাষ করা যাবে সেগুলি। এবং বিক্রয় বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা খামারে উৎপন্ন সেই প্রমাণও থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: ভুখা পেটের বিকল্প খাবার থেকে জিআই তকমা, যেভাবে বিখ্যাত হল লাল পিঁপড়ের চাটনি

প্রোটিনজাত খাবারদাবারের বিকল্প হিসেবে পোকামাকড়ের ব্যবহার শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। তবে এই ইনসেক্ট ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ বাড়ছে বলেই মত এসএফএ-র। ইতিমধ্যেই এই সংক্রান্ত একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও গঠন করা হয়েছে। কোন কোন পোকামাকড়কে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত, তা নির্ধারণের ভার তাদের উপরেই। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা ২১০০ পোকা শনাক্ত করেছেন, যাদের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২২ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, পোকামাকড় শুধুমাত্র প্রাণীজ প্রোটিনেরই বিকল্প একটি উৎস নয়, একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও বড়সড় একটি উৎস। মেক্সিকোর বহু জায়গাতেই ঘাসফড়িং জনপ্রিয় ডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হয়। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে পিঁপড়ে, ঝিঁঝি বা ট্যারানটুলা মাকড়সা খাওয়ার চল রয়েছে। এবার সিঙ্গাপুরের মেনুতেও যোগ হল জ্যান্ত পোকামাকড়। এতদিন পর্যন্ত সেখানে সরিসৃপ ও পাখি খাওয়ার চল ছিল। যা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে বলে অভিযোগ। সেই জায়গাটায় অনেকটাই বদল আনতে পারে পোকামাকড় খাওয়ার চল বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।

More Articles