রাজ্যে কোভিড বিধিনিষেধ, বেলাগাম ফূর্তির মাশুল? বছরের শুরুতেই কেন প্রয়োজন পড়ল?
বছরের শুরতেই ফের একবার বিধিনিষেধের আওতায় রাজ্য। গত কয়েকদিনে করোনার গ্রাফ যেভাবে ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছিল তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে ছিল প্রশাসনের। কিছুদিন আগে মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেই স্পষ্ট হয়েছিল একাধিক কোভিড নিয়ম আসতে চলছে রাজ্যবাসীর জন্য।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী-
১. আপাতত বন্ধ থাকবে রাজ্যের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
২.মেট্রো চলবে ৫০% ক্যাপাসিটি নিয়ে।লোকাল ট্রেনও ৫০% ক্যাপাসিটি নিয়ে চলবে। সন্ধ্যে ৭ টার চলবে না ট্রেন।
৩.সেলুন, পার্লার, পুল, টুরিস্ট স্পটগুলি আপাতত বন্ধ।
৪.অনুষ্ঠান বাড়িতে সর্বাধিক ৫০ জন নিমন্ত্রিত।
৫.সরকারি বেসরকারি অফিসে ৫০ শতাংশ হাজিরা
৬. রাত দশটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্ত চলবে নাইটকার্ফু
৭. রাত দশটাতেই বন্ধ করতে হবে সিনেমাহল, শপিং মল।
৮. পানশালাগুলিও বন্ধ করে দিতে হবে রাত দশটার মধ্যে
কিন্তু বছরের শুরুতেই কেন প্রয়োজন হল এই বিধি নিষেধের?
শনিবার স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৪৫১২ জন। আগের দিনের তুলনায় এক হাজারেরও বেশি লোক সংক্রমিত হয়েছেন একদিনে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত অবশ্যই কলকাতার মানুষ। শুধু একদিনের বিচার নয়, সংক্রমনের গতিবেগ কয়েকদিন ধরেই বেড়েছে হু হু করে। জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন গড়ে ৩ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে সংক্রমণের হার। এরই মধ্যে চলেছে বর্ষবরণ। ঊর্ধ্বমুখী করোনার গ্রাফ উত্তেজনা কমাতে পারেনি অসচেতন জনতার। রেকর্ড সংখ্যক মানুষ নেমেছে রাস্তায়। ২৫ ডিসেম্বর রাতে পার্কস্ট্রিটে ফূর্তির যে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তা দেখে প্রমাদ গুণেছিলেন বহু চিকিৎসক।
বর্ষবরণেও সেই একই ছবি ধরা দিয়েছে। ভিক্টোরিয়া চিড়িয়াখানা ইকো পার্কে উপচে পড়েছে মানুষের ভিড়। যারা এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হলেন তাঁরা তো সংক্রমণের সম্ভাবনা নিয়ে বাড়ি ফিরলেনই, বিপদ বাড়ল বাড়ির বয়স্কদেরও, যারা কোনও আদেখলামোয় নাম লেখাননি। তবে শুধু বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না। দুর্গাপুজোর সময় রাতের বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ায় রাস্তায় মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। করোনা কমছে, অতএব বহুদিন চারদেওয়ালে বন্দি থাকার যন্ত্রণা ভুলতে শীতের ছুটিতে মানুষ বাঁধনছাড়া হয়ে উঠেছিল। ২৫ শে ডিসেম্বর রাতের পার্ক স্ট্রিটের ছবি তারই একটা প্রমাণ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের অসচেতনতা। ভিড়ের মধ্যে কারও মুখে মাস্ক নেই, কারও আবার থুতনির কাছে ঝুলছে মাস্ক। প্রশ্ন করলে মিলছে বেপরোয়া উত্তর। সামাজিক দূরত্ব ভুলে জনজোয়ারের সাথে পা মিলিয়েছে মানুষ। দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ভুলেই গিয়েছেন করোনার কথা, নিজের তো বটেই স্বজনবন্ধুর বিপদের কথা। ইউরোপ আমেরিকায় ওমিক্রন যখন থাবা বসাচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন ফের লক্ষ লক্ষ মানুষ একদিনে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন তখনও উদাসীন থেকেছে কলকাতাবাসী। বিপদ আসে আসুক, ফূর্তিটাকে তো আর হাতছাড়া করা যায় না। রাস্তায় নেমে এই ফুর্তির মাশুল এবার তাই সকলকেই গুনতে হচ্ছে তাই বছরের শুরুতেই।
সাধারণ মানুষ তো রয়েছেনই। বারংবার দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছেন রাজনীতিবিদরাও। চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা কানেও তোলেননি কেউ। বহু চিকিৎসকই একাধিক বার অনুরোধ করেছেন নাইট কার্ফু না তোলার জন্য, তাদের কথা রাখা যায়নি। গত কয়েকদিনে যেভাবে সংক্রমণ বেড়েছে তাতে হাসপাতলে বেড পাওয়া যাবে না কিছু দিনের মধ্যেই, বলেছেন চিকিৎসকরা। আপাতত সেই ভয় জিইয়ে রাখছে কোভিডগ্রাফই। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের একাংশ বলেই দিচ্ছেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের স্মৃতি ফিরবে আবার। এমত অবস্থায় নতুন করে নিয়মের শিকলে মানুষকে বাঁধা ছাড়া দ্বিতীয় রাস্তা তো অবশিষ্টই নেই।
তৃতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই ছোটদের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল চিকিৎসকমহল কারণ তাঁদের এখনও ভ্যাকসিনে আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এখনও পর্যন্ত অনেক প্রাপ্তবয়স্কই ভ্যাকসিনে দ্বিতীয় ডোজ পাননি। পাশাপাশি বিদেশ বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়ে থাকলেও ভারতে তা এখনও চালু হয়নি। ওমিক্রনের সঙ্গে লড়াইয়ে চিকিৎসকদের কপালে যখন চিন্তার ভাঁজ, সাধারণ মানুষের একাংশ তখন গা ভাসিয়ে দিয়েছেন জনস্রোতে। ফলে এখন কোভিড আটকাতে ভরসা একমাত্র বিধিনিষেধ, সামাজিক দূরত্ববিধিই সবেধন নীলমনি।
গত কয়েক মাসে কমেছিল টেস্টের পরিমাণও। এরই মধ্যে ১ জানুয়ারি রাজ্যের একাধিক জায়গায় মাস্ক-দূরত্ব বিধি ভুলে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন হয়েছে। মেয়রের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক তৃণমূল সমর্থক। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের মাশুল কে গুণবে!
এ মুহূর্তে আসন্ন গঙ্গাসগর মেলাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভয়। কী ভাবে ভিড় সামলানো হবে তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। একাংশ মনে করেন, এই মুহূর্তে এই ধরনের মেলা বাতিল করাই উচিত কারণ কারও হুশ ফেরেনি, দূরত্ববিধি মেনে এই মে্লা করা সম্ভব হবে না তা পরিষ্কার। অন্য দিকে চিন্তা বাড়াচ্ছে আরও এক পুরনির্বাচনের নির্ঘণ্ট। দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, প্রস্তুতিও শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তুএই পরিস্থিতিতে জাঁকিয়ে ভোটের আয়োজন করাও সাধারণ মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা। এই নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী অবশ্য নির্বাচন কমিশন।
ভোট-মেলামোচ্ছব ইত্যাদিতে রাশ টানতে না পারলে, মানুষ সংযত না হলে, যে মৃত্যুভয় আমাদের শেষ দু'বছর ধরে তাড়া করেছিল তার থেকে স্বস্তি মিলবো না এই নতুন বছরেও। বিলক্ষণ জানে প্রশাসন। সেই কারণেই বিধিনিষেধ। আপাতত সে দিকেই চেয়ে থাকা।