ব্রাহ্মণদের এঁটো খাবারের উপর গড়াগড়ি খায় শূদ্ররা! ভারতে এখনও পালিত হয় নিকৃষ্ট এই প্রথা!

Made Snana Ritual: মানুষও বিশ্বাস করেন এঁটো খাবারের উপর গড়াগড়ি দিলে ত্বকের নানা রোগ তো সারবেই, তারা যে পাপ করেছেন তা থেকেও মুক্তি মিলবে।

ব্রাহ্মণদের 'উচ্ছিষ্ট ভোজন' করে রোগ নিরাময়। শুনে মধ্যযুগের কথা মনে হলেও এ আচার ভারতে এখনও বর্তমান এবং রীতিমতো উৎসবের আকারে বর্তমান। 'জাত' চেনানোর এই আচার এতটাই জনপ্রিয় যে আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরেও ফের চালু হয়েছে এই উৎসব! কর্ণাটকে এই উৎসবের নাম মাদে স্নান। এই বিচিত্র আচারের অংশ হিসাবে, তপশিলি উপজাতি এবং অন্যান্য নিম্ন বর্ণের ভক্তরা কলাপাতায় ব্রাহ্মণদের এঁটো খাবারের উপর দিয়ে গড়াগড়ি খায়! কারণ তাঁদের বিশ্বাস ব্রাহ্মণদের উচ্ছিষ্ট দেহে মাখলে তা তাদের বিভিন্ন অসুস্থতা থেকে মুক্তি দেবে।

মন্দিরের মধ্যে ব্রাহ্মণদের যে খাবার পরিবেশন করা হয়, তারই উচ্ছিষ্টের উপর দিয়ে গড়াগড়ি খান শয়ে শয়ে ভক্ত। এটি সুব্রমণ্য মন্দিরে উদযাপিত ষষ্ঠী উৎসব চলাকালীন ঘটে। বিশ্বাসী ভক্তদের অধিকাংশই শূদ্র এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ, তবে মজার বিষয় হলো অসমর্থিত, 'নিচুস্তরের' ব্রাহ্মণও কম নেই এতে। কিছু মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত মানুষও রয়েছেন যারা বিশ্বাস করেন এঁটো খাবারের উপর গড়াগড়ি দিলে ত্বকের নানা রোগ তো সারবেই, তারা যে পাপ করেছেন তা থেকেও মুক্তি মিলবে। মাটিতে এই গড়াগড়ি খাওয়াকে কন্নড় ভাষায় 'উরুলু সেভ' বলা হয়। মাদে স্নানা কথাটির মধ্যে স্থানীয় টুলু ভাষায় মাদে শব্দটি অর্থ হলো এঁটো। স্থানীয়দের দাবি, এই আচার প্রাচীন, বয়স কমপক্ষে পাঁচশো বছর।

মাদে স্নানা মূলত কর্ণাটকের সুব্রামণ্য মন্দিরগুলিতে বিশেষ উৎসবের দিনে পালিত হয়, তবে কৃষ্ণমঠ, উদুপির মতো বৈষ্ণব স্থানেও এটি পালিত হয়েছে। তবে কুক্কে সুব্রামণ্য মন্দিরে এবং কালাভরার সুব্রামণ্য মন্দিরে, কুন্ডাপুরার তালুক এবং হাসান জেলার রামনাথাপুরায় এই আচার সবচেয়ে বেশি ও নিয়মিত পালিত হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই জাতীয় আচারকে অব্যাহত রাখারই নির্দেশ দিয়েছে। যেহেতু প্রচলিত মাদে স্নানা অবৈধ, তাই এখন নাম বদলে হয়েছে 'এদে স্নানা'। এটি মাদে স্নানারই পরিবর্তিত সংস্করণ, যেখানে ভক্তরা ব্রাহ্মণের উচ্ছিষ্টের বদলে 'প্রসদা' অর্থাৎ দেবতাদের দেওয়া ভোগ বা গরুর খাওয়া খাবারের উপর গড়াগড়ি দেন।

আরও পড়ুন- ভারতের এই মন্দিরে পূজিত হয় মোটরবাইক! ‘বুলেট বাবা’-র নেপথ্যে রয়েছে গা ছমছমে যে ঘটনা

কর্ণাটকে এই জাতীয় কুসংস্কারমূলক আচারের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্ত আন্দোলন আগে হয়েছে, তবে ২০১২ সালে সংঘবদ্ধ লড়াই শুরু হয়। শ্রী জি ভি শ্রীরাম রেড্ডির নেতৃত্বে সিপিএম, মাইসোরের কর্ণাটক ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস অ্যাওয়ারনেস ফোরামের শ্রী কে এস শিবরামু এবং কোমু সৌহার্দ্য বৈদিকের সদস্যরা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বিখ্যাত যুক্তিবাদী নরেন্দ্র নায়ক এবং এসডিপিআইয়ের মুনির কাটিপল্যার মতো শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতা।

দাসত্বের প্রতীক হিসাবে চলে আসা এই কুসংস্কারের আচার নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। সাধারণত ব্রাহ্মণ সহ সমস্ত বর্ণের হিন্দুরাই এই উৎসবটিকে সঞ্চালনা করেন। বিক্ষোভকারীরা দাবি ছিল, উচ্চ-বর্ণের হিন্দুদের, বিশেষত ব্রাহ্মণদের হাতে দলিত নিপীড়নের এই প্রথা কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কীভাবে চলতে পারে, বর্ণবাদ, কুসংস্কার এবং সাম্প্রদায়িকতার উপর ভর করে গড়ে ওঠা এমন আচরণ ভারতের লজ্জা। ২০১০ সালে রাজ্য সরকার কর্তৃক এই অনুষ্ঠানটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে মালেকুদিয়াস নামের স্থানীয় বন উপজাতি এই বিধিনিষেধের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। ২০১১ সালে তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে মন্দিরে তাদের দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে। তাদের চাপের মুখে নতিস্বীকার করে তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ২০১১ সালে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে।

রাজ্যের প্রগতিশীল নেতা এবং উদারপন্থীদের আন্দোলনের ফলে এই বিতর্কিত আচারকে কর্ণাটক প্রিভেনশন অফ সুপারস্টিশন প্র্যাকটিস বিলে (২০১৩) অন্ধ বিশ্বাস হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করে। কর্ণাটক হাইকোর্ট ২০১২ সালের ২ নভেম্বর তার আদেশে এই আচার পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিল, তবে সুপ্রিম কোর্ট কোনও বদলের পক্ষে যায়নি।

More Articles