জানুন কেন দুর্গার মূর্তি তৈরিতে পতিতালয়ের মাটি লাগে
বাঙালিদের সবথেকে বড় উৎসব এই দুর্গাপুজো। সারা পশ্চিম ভারত দশেরার আগের ৯টি দিনকে নবরাত্রি হিসাবে পালন করলেও বাংলা তথা ভারতের পূর্ব অংশের কাছে দুর্গাপুজো নামে এই উৎসবটি প্রচারিত। এই দুর্গাপুজো উৎসবের একাধিক জায়গার একাধিক আলাদা আলাদা নিয়মকানুন আছে। তার মধ্যে কিছু নিয়মের ব্যাখ্যা আছে, আবার কলকাতায় এমন কিছু নিয়ম আছে যেগুলির তেমন কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না অথবা সেগুলির ব্যাখ্যা তেমন একটা কেউ জানে না। সেরকম একটি রীতি বা নিয়ম হল পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার করে মায়ের মূর্তি গড়া এবং এই মূর্তি বিশেষত তৈরি হয় কলকাতার প্রতিমা তৈরিতে। এই রীতিটির ব্যাপারে সকলেই কমবেশি জানলেও, কেউই প্রায় জানেন না কেন এটা করা হয়। চলুন, আজকে এটাই জেনে নিই, কেন হঠাৎ পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার করা হয় মা দুর্গার মূর্তি তৈরিতে।
প্রতি বছর এই চারটে দিনের জন্য মা দুর্গা কৈলাস থেকে নিজের বাপের বাড়িতে আসেন। তার জন্যে মর্তে প্রত্যেকটি জায়গায় শুরু হয়ে যায় উৎসব। ধুপ, দীপ, আলপনা দিয়ে সেজে ওঠে বাড়ির প্রত্যেকটি কোনা। প্রতিটি মণ্ডপে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু এই দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করতেই ব্যবহৃত হয়েছে 'অশুদ্ধ' পতিতালয়ের মাটি। বহুদিন ধরে এই নিয়ম শাস্ত্র মেনে করাও হচ্ছে। সমাজ যেখানে এই সমস্ত নারীদের পরিহার করেছে, তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছে, সেখানেই তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে আদিশক্তি। মা দুর্গার কাছে সবাই তার সন্তান। তার কাছে কেউ ভালো, কেউ অশুচি এরকম কোনো তফাত নেই।
বলাই বাহুল্য, তার কাছে এই সমাজের ব্রাত্য নারীরাই রয়েছেন উপরে, তাই এখানকার মাটি দুর্গা মূর্তি তৈরি করতে অবশ্যই প্রয়োজন। শাস্ত্রের বিধান, মা দুর্গার মূর্তি তৈরিতে যদি পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার না করা হয় তাহলে সেটা মা দুর্গার সঠিক মূর্তি নয়। কথিত আছে, অকাল বোধনের সময় মহিষাসুরমর্দিনীকে পতিতালয়ের মাটি দিয়েই তৈরি করতে হবে। তবে, শাস্ত্রের বিধান এখন পুরোপুরি মানা হয়না। শাস্ত্রে যেখানে পুরো মূর্তিটি এই মাটি দিয়ে করার কথা, সেখানে এখন কিছুটা মাটি আসল মাটির তালের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিকভাবে এই মাটি লেপতেই হবে চিন্ময়ীর কাঠামোয়। কিন্তু এর কারণ জানেন কি আপনি?
হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, মা দুর্গার মূর্তি তৈরি করতে ৪টি জিনিস লাগবেই। এই ৪টি জিনিস হল, গঙ্গার পলি মাটি, গোমূত্র, গোবর এবং পতিতালয়ের মাটি। এই ৪টি জিনিসের সঙ্গে সাধারণ মাটি মিশিয়ে তৈরি করা হয় মা দুর্গার মূর্তি। বর্ণিত আছে, পুরুষরা পতিতালয়ে গিয়ে সেখানে তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত পূণ্য ফেলে দিয়ে আসে। পরিবর্তে সঞ্চয় করে নিয়ে আসে বহু পাপ। বহু পুরুষের পুণ্যের জন্যই সেই জায়গা নাকি সবথেকে বেশি বিশুদ্ধ, সবথেকে বেশি পূণ্য মাটি। এককথায়, বর্ণিত, সমাজকে বিশুদ্ধ রাখতে এই অশুচি পতিতারাই সাহায্য করেন। তাই দুর্গাপুজোয় মূর্তি তৈরিতে অবশ্যই লাগবে এই পতিতালয়ের মাটি।
আর এই পূণ্য মাটি জোগাড় করতে হবে মন্দিরের পুরোহিতকে। এই পূণ্য মাটি জোগাড় করার পদ্ধতি বড় অদ্ভুত। এই পদ্ধতিটি যেমন শাস্ত্রসম্মত তেমনি নাটকীয়। এখানে মন্দিরের পুরোহিতকে যে কোনও একটি পতিতালয়ে গিয়ে সেখানে দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে সেই মাটির জন্য। দুর্গা মায়ের মূর্তি তৈরির জন্য এই জায়গায় ঘুরে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে একবার করে মাটি চাইতে যেতে হবে। মাটি না পাওয়া পর্যন্ত তাকে সেখানে অপেক্ষা করতে হবে। তারপর মাটি পাওয়া গেলে মন্ত্র পড়ে তারপর তাকে মাটি নিয়ে সেই মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করতে হবে।
কিন্তু এই মাটি ব্যবহারের পিছনে আসল কারণ কী? পুরুষদের পূণ্য এই মাটিতে আছে বলে একেই 'পূণ্যমাটি' বলা হয় শাস্ত্রমতে। আর দুর্গাপুজোর মত একটা অনুষ্ঠানে এই রকম পূণ্য মাটি লাগবেই। মনে করা হয়, যদি পতিতাদের কেউ আশীর্বাদ না নিয়ে দুর্গা পুজো করেন তাহলে সেটা শুভ হয় না। তাই এই মাটি গ্রহণ করা মানে একদিক থেকে সমাজের ব্রাত্য মহিলাদের আশীর্বাদ প্রাপ্তি। মা দুর্গার কাছে সকল সন্তান এক সমান। তাই তিনি চেয়ে থাকেন যাতে সমাজের ব্রাত্যজনদেরও সবাই এক চোখে দেখুক। এই কারণেই এই মাটি ব্যবহার।
তবে, এই মাটি ব্যবহারের আরেকটি কারণ আছে এবং সেটার সঙ্গে সরাসরিভাবে যোগ রয়েছে শাস্ত্রের। কথিত আছে, এই দুর্গাপুজোয় মা দুর্গার ৯টি রূপের পুজো একসঙ্গে হয়। আর এই ৯ রূপের মধ্যে শেষ রূপটি পতিতালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত থাকে। ৮ কন্যার পরে নবম কন্যাও পুজো পায়।
তবে, এই প্রথা কিন্তু শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই প্রচলিত। বাংলার বাইরে আর কোথাও এই ধরনের কোনও প্রথা চলে না। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু বাংলার বাইরের কোনও পুজোয় এই নিয়ম পালন করা হয় না সাধারণত। বাংলায় দুর্গাপুজোর সময় এই যৌনকর্মীদের কিছুটা গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই এই পন্থা অবলম্বন। তবে প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। সমাজের পতিতাদেরকেও সঠিক সম্মান দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে মাটি ব্যবহারের রীতি পালন করা হয়, তার আসল উদ্দেশ্য কি আদৌ রক্ষা করা হয়? প্রত্যেক বছর পুজোয় এইসব পতিতাদের বাড়ি গিয়ে তাদের কাছ থেকে মাটি নিয়ে আসা হয়। তারপর সারা বছর তাদের কথা কেউ ভাবেই না। তারা যেখানে আছে, তাদের সেখানেই ফেলে রাখা হয়।
যারা প্রত্যেক বছর মাটি সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করে মূর্তি বানিয়ে পুজো করেন, তারা যদি সমাজের এই মহিলাদের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের জন্য সামান্য কিছুও করতেন, তাহলেও হয়তো এই রীতিপালনের আসল উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল হতো। কেউ কেউ হয়তো করেনও, কিন্তু বেশিরভাগেরই আগমন ঘটে শুধু দুর্গাপুজোর সময় এই পূণ্যমাটি নিতে।