বিক্রম মিশ্রি থেকে সোফিয়া কুরেশি: 'দেশপ্রেমিক'-রাই যেভাবে হিংসার মুখে

Vikram Misri & Sofiya Qureshi: সোফিয়া সেনার সঙ্গে যুক্ত বলে এত হইচই হচ্ছে কিন্তু এদেশে, বিশেষ করে গোবলয়ে প্রতিদিন ঘৃণা ভাষণের শিকার হওয়া মুসলমানদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া ও চিৎকৃত লড়াইখ্যাপা টিভি অ্যাঙ্কর শাসিত এই উন্মাদ সময়ে, আমাদের নিত্যদিনের যাপনে একজন রাজনৈতিক নেতা, চিত্রতারকা, গায়ক বা পেজ থ্রি সেলিব্রিটিকে আমরা যতটা চিনি তার এক অংশও চিনি না আমলাদের। কারণ তাঁরা পর্দার আড়ালেই কাজ করতে অভ্যস্ত। অবশ্য ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি বর্তমান সময়ে এক ব্যতিক্রমী নাম। পহেলগাঁওতে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় অপারেশন সিঁদুর ও ভারত-পাক সংঘর্ষের সময় প্রতিদিন তিনি ছিলেন ভারতের মুখ। এ কথা কারও অজানা নয় যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কূটনীতি এক অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে ওঠে এবং যুযুধান দুই পক্ষের মুখপাত্রদের বক্তব্যের দিকে নজর থাকে সারা বিশ্বের। ভারত-পাক সংঘর্ষের এই ক'টা দিনে স্মিতবাক,শান্ত বিক্রম মিশ্রি তাঁর কাজ যথাযথভাবেই পালন করছিলেন। সমস্যা শুরু হলো, যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথিত মধ্যস্থতার পর দুই দেশ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সংঘর্ষ বিরতির কথা ঘোষণা করলেন। বিদেশ সচিব হিসাবে বিক্রম মিশ্রির এই ঘোষণার পর আমরা ভণ্ড দেশপ্রেমিক ও চরম দক্ষিণপন্থীদের ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র থেকে যে গরল উদগীরণ দেখলাম তা অভূতপূর্ব। এই আইটি সেলের বিভেদের বেসাতি আমরা রোজ প্রত্যক্ষ করি কিন্তু এবার তা আগের সব নজির ছাড়িয়ে গেল। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এক সাধারণ ছাত্রও জানে যে, সংঘর্ষ বিরতির মতো এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। অথচ আইটি সেলের লক্ষ্যবস্তু হলো বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি। সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল মন্তব্যের মূল সুর ছিল, সামরিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ভারতের স্বার্থকে পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন আমাদের বিদেশ সচিব। এই ঘৃণা ভাষণ থেকে রক্ষা পেলেন না সচিব কন্যা, লন্ডনস্থিত গ্লোবাল ল ফার্ম হার্বাট স্মিথ ফ্রিহিলসের কৌসুলী দিদান মিশ্রি।

এই ট্রোল কতটা সংগঠিত ছিল তা বোঝা যায় যখন দেখি, সচিব কন্যাকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমর্থক আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অথচ সত্যিটা হলো ইউএনএইচসিআর-এর একটা ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে দিদান অংশ নিয়েছিলেন এবং নানা ধরনের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত দৌত্যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। অবশ্য প্রথম দিন থেকেই বিক্রম মিশ্রির পরিণত বক্তব্য হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করেনি। তিনি বলেছিলেন, গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার থাকে। এমনকী বিজেপির আইটি সেলের হাই ভোল্টেজ প্রচার যে জৈশ-ই-মহম্মদের প্রধান আবদুল রউফ আজাহার নিহত, তাকেও সরকারি স্বীকৃতি দেননি। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে বিক্রম মিশ্রি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট প্রাইভেট করতে বাধ্য হন। একদিকে পাকিস্তানকে 'পরাজিত' করার বিজয় উৎসব, অন্যদিকে দেশের বিদেশ সচিবকে অশ্লীল আক্রমণ ও কুৎসা— অমৃতকালের ভারতের এই ছবি এক জাতীয় লজ্জা।

আরও পড়ুন-মিথ্যা ক্ষয়ক্ষতির বহর! পাকিস্তানের যেসব ভুয়ো প্রচার ফাঁস করলেন বিদেশ সচিব

আশার বিষয় হলো, দেরিতে হলেও এবার প্রাক্তন আমলা, আইএস অফিসারদের সংগঠন, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়ার একাংশ আইটি সেলের এই নোংরা খেলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমাদের সঠিকভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, সরকার রাজনৈতিক অংশের দ্বারা চালিত হয়, এক্সিকিউটিভরা সিদ্ধান্ত পালন করেন মাত্র। যথারীতি নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভা ও দল হিসেবে বিজেপি কোনও মন্তব্য করেনি। বিশেষ করে বচনবাগীশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর, যিনি এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে কখন ও কোন লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করা হবে তা পাকিস্তানকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই মন্ত্রী তাঁর অধীনে কাজ করা সচিবের সমর্থনে এগিয়ে আসেননি। তবে এই ট্রোল বাহিনীর কৃতকর্ম নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজু পারুলেকর:

"India's Foreign Secretary and his family are targeted by right wing troll army. That's not surprising, as the traits of the leadership percolate. 'Congress ki vidhwa', '50 crore ki girl friend', 'jersey gaay' etc show a glimpse into the patriarchal, misogynistic and regressive mindset of Narendra Modi. If he can say this despite occupying a constitutional office, the trolls working to bolster his image can definitely stoop to the lowest"

এই ঘৃণার বাস্তুতন্ত্রের ইতিহাস একদিনে তৈরি হয়নি।

এবারে সংঘর্ষের সময় কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করানোকে অনেকে মাস্টারস্ট্রোক আখ্যা দিয়েছিলেন। যুক্তি ছিল, এই দু'জন নারীর ক্ষমতায়ন ও ভারতের ধর্মীয় সংহতির বার্তা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু এটা যে নেহাৎই এক মুখোশ ছিল তা কয়েকদিনের মধ্যে পরিষ্কার করে দিলেন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মন্ত্রী বিজয় শাহ। ১২ মে (২০২৫) সে রাজ্যের মৌ শহরে এক জনসভায় মন্ত্রীমশাই কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে 'সন্ত্রাসবাদীদের বোন' অভিধায় ভূষিত করলেন। তাঁর হিন্দি বক্তব্যকে বাংলা করলে দাঁড়ায় : "যাঁরা আমাদের মেয়েদের সিঁদুর মুছে দিয়েছে.... আমরা তাঁদের বোনকে পাঠিয়ে তাঁদেরই ধ্বংস করেছি"। একদিকে তেরঙ্গা নিয়ে রাস্তায় জনজোয়ার, অন্যদিকে ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান এক সেনানীকে কুৎসা— দেশপ্রেমের ভণ্ডামি কোথায় যেতে পারে তার এক সার্থক উদাহরণ! হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এই কথার তীব্র নিন্দা করে এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৫২ ধারায় (জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত) মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এখনও এক প্রতীকী দুঃখপ্রকাশ ছাড়া বিজয় শাহ কিছুই করেননি। মধ্যপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী গোন্দদের (মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার ৪৭ টি বিধানসভা আসনে গোন্দরাই নির্ধারক শক্তি) নেতা হওয়ার কারণে মন্ত্রী বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছেন। আসলে সোফিয়া সেনার সঙ্গে যুক্ত বলে এত হইচই হচ্ছে কিন্তু এদেশে, বিশেষ করে গোবলয়ে প্রতিদিন ঘৃণা ভাষণের শিকার হওয়া মুসলমানদের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্ডিয়া হেট ল্যাবের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ভাষণের ঘটনা ঘটে।

সোফিয়া কুরেশিকে কুৎসার লক্ষ্যবস্তু বানানো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সংঘ পরিবারের অন্যতম তাত্ত্বিক গোলওয়ারকরের 'We or Our Nationhood defined' গ্রন্থে এই ঘৃণার মতাদর্শের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। গোলওয়ারকর বলেছেন এ দেশ একমাত্র হিন্দুদের এবং তারাই এদেশের মাটির সন্তান। অর্থাৎ বাকি সবাই (পড়ুন মুসলমান ও খ্রিস্টান) বহিরাগত। তারা এখানকার স্বাভাবিক অধিবাসী নয়। এমনকী নাগরিকত্বের সর্বমান্য প্রাথমিক ধারণা, যে যেখানে জন্মায় সে জন্মগত কারণে সে দেশের নাগরিক (territorial nationalism) — এটাও গোলওয়ারকারদের কাছে পরিত্যাজ্য। তাঁদের বক্তব্য এদেশে জন্মালেও তাঁদের মানসিক গঠন, বিচারবোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ হিন্দুদের মতো নয়। তাই তারা 'অপর'। এরা এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ও নিজেদের স্বাত্যন্ত্র বিসর্জন দিয়ে তাদের এদেশে থাকতে হবে। বিজয় শাহ মুখোশ ছিন্ন করে তাঁদের আচরিত মতাদর্শ বলেছেন মাত্র।

আরও পড়ুন-কর্নেল সোফিয়া কুরেশি: একতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে অপারেশন সিঁদুরের মাস্টারস্ট্রোক

শুধু মুসলমানরা নয়, এই ঘৃণার বাস্তুতন্ত্রের লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে পড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী, সেকুলার ভারতের সমর্থক এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে সওয়ালকারীরা। ২২ এপ্রিল হত্যাকাণ্ডের পর যে ছবিটি সমস্ত দেশবাসীকে আলোড়িত করেছিল, তা ছিল এক কর্নেলের মৃতদেহের পাশে বসে ক্রন্দনরতা এক মহিলা। মৃত কর্নেল বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী নারওয়ালের জন্য প্রকৃত অর্থে দেশজোড়া আবেগ ও সহানুভূতির বিস্ফোরণ আমরা দেখেছিলাম। ছবিটা পাল্টে গেল যখন কর্নেলের শোকসভায় হিমাংশী মানবিকতার অনন্য নজির স্থাপন করে বললেন, তিনি দোষীদের শাস্তি চান কিন্তু এই ঘটনাকে সামনে রেখে সমস্ত কাশ্মীরি এবং মুসলমানদের আক্রমণকে তিনি সমর্থন করেন না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় আইটি সেলের কুৎসিত আক্রমণ। হিমাংশীর ছাত্রজীবন যেহেতু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছে তাই তার সঙ্গে কাশ্মীরি ছাত্রদের যৌনগন্ধী সম্পর্ক, টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের সদস্য হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। এই তালিকায় দু'দিন আগে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নাম। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ রাম চান্দের জাঙ্গারা বলেছেন যে পহেলগাঁওতে নিহতরা বীর ছিল না কারণ, তারা হাতজোড় করে মৃত্যুকে বরণ করেছে। যদি প্রধানমন্ত্রীর অগ্নিবীর প্রকল্পের ট্রেনিং থাকত তাহলে হাতজোড় করে মরতে হতো না। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সমস্যা হলো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পের মতো, শেষ পর্যন্ত এই ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র তার নির্মাতাদেরই আক্রমণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মান দখলের জন্য ইহুদি বিদ্বেষ ও জার্মান জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে পুঁজি করে হিটলার বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন কিন্তু নামতে পারেননি। এবার সংঘর্ষ বিরতির সময় আমরা দেখলাম আইটি সেলের প্রচারকরা বহু ক্ষেত্রে দলীয় অনুশাসনকে ভঙ্গ করে নিজেদের লোকেদের নিশানা করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে 'মোদি হাটাও যোগী লাও' ধ্বনি। জরুরি অবস্থার নায়িকা ইন্দিরা গান্ধিকে বন্দনা করে প্রকৃত অর্থে মোদির প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করা হচ্ছে। আসলে আজকের ভারতে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প একইরকম প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। অপারেশন সিঁদুর থেকে এটাও একটা প্রাপ্তি।

More Articles