মোদিই প্রধানমন্ত্রী হবেন? নাকি, শেষ মুহূর্তে মোক্ষম চাল দেবেন নীতীশ-নাইডু?
Nitish Kumar & Chandrababu Naidu: নীতীশ কতবার বিজেপিতে এসেছেন আর গিয়েছেন তার হিসেব মনে হয় নীতীশ নিজেও রাখা ছেড়ে দিয়েছেন।
৪০০ পেরোল না, ৩৭০-ও পেরোল না। সংখ্যাগরিষ্ঠতাও জুটল না বিজেপির। এনডিএ জোট সব মিলিয়ে এখনও ২৯৩ টি আসনে জিতেছে। ২৭২ ম্যাজিক ফিগার। ফলে এনডিএ জোট সরকার গড়তেই পারে, যদি সমস্ত জোটসঙ্গী মোদির হাত ধরেন। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির গেমচেঞ্জার হতে পারেন দু'জন। তাঁদের একজনকে আট মাস আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। দুর্নীতির দায়ে ২ মাস জেলও খেটেছেন। আরেকজনের তো নামই পল্টুরাম। রাজনীতিতে যখন তখন, যেখানে সেখানে তিনি ডিগবাজি খেতে ওস্তাদ! এই দু'জন এবারের লোকসভা নির্বাচনে কিংমেকার হয়ে উঠবেন। বিজেপি নিখুঁত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াতে এখন এই দুই মানুষের সাহায্য দরকার মোদির। এই দুই নেতা হলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এবং জেডিইউর প্রধান নীতীশ কুমার এবং তেলেগু দেশম পার্টির নেতা এন চন্দ্রবাবু নাইডু।
টিডিপি অন্ধ্রপ্রদেশে একাই ১৬ টি আসন জিতেছে। মোট ২৫ টি আসনের মধ্যে এনডিএর ২১ টি আসনে জিতেছে অন্ধ্রপ্রদেশে। বিহারে নীতীশ কুমারের জেডিইউ পেয়েছে ১৫ টা আসন, বিজেপি ১২ টি আসন জিতেছে। যত বেলা গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে ভোটের চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। ইন্ডিয়া জোট চমকে দেওয়া ফল করেছে নিঃসন্দেহে। বিজেপিকে কাঁটায় কাঁটায় টক্কর দিয়েছে তারা। বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার নেতারা এবার সংখ্যাগরিষ্ঠদের একত্রিত করার প্রচেষ্টায় ভারতীয় রাজনীতির এই দু'জন প্রবীণ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা যাচ্ছে। কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলছেন, কিছুই এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ইন্ডিয়া জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে সবটা আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ইন্ডিয়া জোট এখনও ২৩৩ টি আসন জিতেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ৩৯ টি আসন কম। বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ ২৯১ টি আসন জিতেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে ১৯ টি বেশি আসন। এই ১৯ টির মধ্যে ওয়াইএসআরসিপি এবং নির্দল চারজন রয়েছেন। সুতরাং, যদি ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় আসতে চায় তবে তাদের সঙ্গে নিতে হবে জেডিইউ, টিডিপি এবং কিছু নির্দলদেরও। অন্যদিকে বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে চাইলে অবশ্যই তাদের এই সঙ্গীদের যে কোনও মূল্যে ধরে রাখতে হবে।
আরও পড়ুন- রায়বরেলি কংগ্রেসেরই! দুই আসনেই যেভাবে ব্যাপক জয়ের মুখে রাহুল গান্ধি!
কংগ্রেস প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়্গে নতুন জোটসঙ্গীদের একত্রিত করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নতুন জোটসঙ্গীরা যদি ইন্ডিয়ার সঙ্গে জুড়তে চান, তাহলে বিজেপি বিপদে পড়বে। কিন্তু চন্দ্রবাবু নাইডু আর নীতীশ কি জুড়বেন?
নীতীশ কতবার বিজেপিতে এসেছেন আর গিয়েছেন তার হিসেব মনে হয় নীতীশ নিজেও রাখা ছেড়ে দিয়েছেন। ইন্ডিয়া জোটে ছিলেন তিনি। মনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনাও ছিল। কিন্তু ইন্ডিয়া জোটে মাথাদের ভিড়। ফলে ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে শেষ মুহূর্তে পল্টুরাম চলে আসেন এনডিএ -তে। বিহারে কয়েক দশক ধরে এনডিএ জোটকে এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি। অথচ এই শেষবারের দলবদলে নীতীশ কুমারকে কম সংখ্যক আসন নিয়েই খুশি থাকতে হয় কারণ বিজেপি ততক্ষণে স্পষ্ট করে দেয় যে এই জোটে তারাই মূল দল। এবার লোকসভায় জেডিইউয়ের হাতে আছে ১৫ টি আসন। তারা ইন্ডিয়া জোটে যোগ দিলে ইন্ডিয়ার আসন বাড়বে।
এক দশকে পাঁচবার ডিগবাজি খেয়েছেন নীতীশ। ১৯৯৪ সালে নীতীশ তৎকালীন জনতা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জর্জ ফার্নান্দেজের সঙ্গে সমতা পার্টি গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বিজেপিতে চলে যান এবং অটল বিহার বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন। ২০০৩ সালে শরদ যাদব এবং লালু প্রসাদ যাদব জোট ভেঙে আরজেডি গঠন করেন। নীতীশ ঠিক করেন তাঁর সমতা পার্টিকে জনতা দলের সঙ্গে মিলিয়ে দেবেন এবং নতুন জোটের নাম হবে জনতা দল (ইউনাইটেড)।
নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এক দশকের বহুবার দল বদলেছেন নীতীশ। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদিকে যখন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করে, তখন নীতীশ এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলেছিলেন তাঁর দল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নীতীশ তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং কংগ্রেসের সঙ্গে প্রথম 'মহাগঠবন্ধন জোট' গঠন করেন। এই মহাজোট ১৭৮টি আসনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করে।
২০১৭ সালেই IRCTC কেলেঙ্কারিকে ঘিরে এই 'মহাগঠবন্ধন' ত্যাগ করেন নীতীশ। জোট ছেড়ে আবার এনডিএ-তে যোগ দেন এবং বিজেপির সমর্থনে আবারও মুখ্যমন্ত্রী হন। তখনই আরজেডি নেতারা নীতীশকে প্রথম 'পল্টুরাম' বলে ডাকতে শুরু করেন।
২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই জোটটির সঙ্গেও সমস্যা হয় নীতীশের। বিজেপি নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চায়নি কারণ জেডিইউ-এর বিধানসভা আসন ২০১৫ সালে ছিল ৭১, ২০২০ তে তা কমে দাঁড়ায় ৪৩!। অন্যদিকে বিজেপির আসন ৫৩ থেকে বেড়ে হয় ৭৪। নীতীশ আশঙ্কা করেছিলেন যে বিজেপি জেডি(ইউ) নেতা এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর.সি.পি. সিংকে ব্যবহার করে তাঁর দল ভাঙাতে পারে।
আরও পড়ুন- আসন ভাগ করতে চাননি রাজ্যে, এবার কি ইন্ডিয়া জোটের মাথা হতে চাইবেন মমতা?
২০২৪ সালে নীতীশের মূল সমস্যা হয় আরজেডির সঙ্গেই। লালুর কন্যা রোহিণী আচার্য বলেন, হাওয়া যেদিকে বয় নীতীশের আদর্শ সেদিকেই বেঁকে যায়। সেই থেকেই শুরু হয় তিক্ততা। ইন্ডিয়া জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করতে ঢিলেমি এবং বিরোধী জোটের নেতা হিসাবে নীতীশ কুমারকে তুলে না ধরাতে এবছর বিজেপির হাত ধরেন পল্টুরাম।
নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং বিজেপি ২০১৯ সালে বিহার লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিল৷ কর্পুরী ঠাকুরকে ভারতরত্ন দেওয়ার কথা এবং নীতীশের আবার এনডিএ-র সঙ্গে বন্ধুত্ব সব একই সারিতে৷ বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুরকে যেই ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি, তারপরেই নীতীশ নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের দিকে ঝোঁকেন। নীতীশ কুমার ১৯৯৬ থেকে এই দলবদলের ধারা জারি রেখেছেন। কিন্তু নিজের রেকর্ড ভাঙতে দেননি। নবমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি ধরে রেখছেন তিনি।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে তিনটি আসন জিতেছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু। এই বছর ১৯ টি আসন জিতেছেন তিনি। চন্দ্রবাবু নাইডুর এই প্রত্যাবর্তন তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই। টিডিপির কাঁধে ভর করে বিজেপিও এই রাজ্যে তিনটি আসন জেতে যে রাজ্যে তাঁদের কোনও ভিত্তিই নেই। টিডিপি বিধানসভা নির্বাচনেও ব্যাপক জয়লাভ করেছে। ১৯৯০-এর দশকের জোটের যুগে এইচডি দেবেগৌড়া এবং ইন্দ্রকুমার গুজরালকে মুখ্যমন্ত্রী করার নেপথ্যে ভূমিকা ছিল চন্দ্রবাবুর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে চন্দ্রবাবু নাইডুর রাজনৈতিক বন্ধুবর্গ কম নয়। ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে জু জুড়বেন তিনি? তাঁর পুত্র নারা লোকেশ সহ বরিষ্ঠ টিডিপি নেতারা বলেছেন, তারা এনডিএ-র সঙ্গেই থাকবেন। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো নেবেন চন্দ্রবাবুই। তাতে ইন্ডিয়া জোট বিপাকে ফেলবে বিজেপিকে। বন্ধুর হাত কি ছেড়ে দেবেন চন্দ্রবাবু? ইতি টানবেন মোদি জমানায়?