শাহবাজ আসলে কে? নতুন পাক প্রধান কি ভারতবন্ধু?

পাকিস্তানের নয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন মিয়াঁ মহম্মদ শাহবাজ শরিফ। তাঁর দল মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর পাশাপাশি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল-সহ বেশ কয়েকটি দলের সমর্থন পেয়ে ইমরান খানকে 'বোল্ড আউট' করে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি দখল করলেন শাহবাজ। কে এই নেতা?  এই নিয়ে সারা বিশ্বে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি ভারতের লাভ ক্ষতির হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেছে নয়াদিল্লির অন্দরে।

শরিফ-এর জন্ম ১৯৫১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই। পাঞ্জাব প্রদেশের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবার থেকে এসেছেন। সেই প্রভাব সঙ্গে করে পাকিস্তানের কুর্সিতে বসলেন। লাহোরের সরকারি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট। তাঁর আর এক ভাই আব্বাস শরিফ। 

সম্পত্তির পরিমাণ?

পেশায় ব্যবসায়ী শরিফ। লাহোরের শিল্পপতি পরিবারে জন্ম। স্থানীয় স্তরেই তাঁর পঠন-পাঠন । এরপর পারিবারিক ব্যবসায় প্রবেশ করেন তিনি। পাকিস্তানের একটি স্টিল কোম্পানির যৌথ মালিক।

পাঞ্জাব থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৯৭ সালে প্রথমবার সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হন। যদিও তার আগে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট চলাকালীন সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে একবার জেলবন্দি হন। ২০০০ সালে তাঁকে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ২০০৭ সালে ফিরে আসেন তিনি। পাঞ্জাবে ফের তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু হয়।

রাজনৈতিক ইনিংস

নাওয়াজ শরিফের হয়ে ভাই শাহবাজ পাকিস্তান-মুসলিম-লিগ-নওয়াজ দল চালনা করেন। পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এটিই৷ এর আগে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদেও বহাল ছিলেন তিনি। পাঞ্জাব প্রদেশে তিন বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ। ভাইঝি মরিয়াম শরিফকে নিয়ে দল চালাচ্ছিলেন তিনি। জনপ্রিয়তার দৌড়ে দাদা নওয়াজ কিংবা ভাইঝি মরিয়মের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়েই রয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে শাহবাজের দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তা জানে পাক রাজনৈতিক মহল। 

পাকিস্তান-মুসলিম-লিগ-নওয়াজের দায়িত্ব ভাইয়ের হাতে তুলে দেন বড় শরিফ। এই পদ ছাড়াও একইসঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন। সম্প্রতি অনাস্থা ভোটে ইমরানের বিরুদ্ধে ১৭৪টি ভোট পড়তেই ইমরান সরকারের পতন নিশ্চিত হয়ে পড়ে৷ প্রধান বিরোধী দলনেতা শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চান সকলেই। সোমবার ভোটাভুটির লড়াইয়ে জিতলেন শাহবাজ।

নাছোড় বিতর্ক

২০১৯ সালে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো মোট ২৩টি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শাহবাজের। তাঁর ছেলে হামজা শরিফের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লাহোর হাই কোর্ট থেকে শাহবাজকে গ্রেফতার করে ন্যাব। গত বছর এপ্রিল মাসে জামিনে মুক্তি পান। এর পর গত ৮ মার্চ তাঁর নেতৃত্বে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় পাক সংসদে।


ভারতের বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতি

শরিফের হাতে পাকিস্তান, এই অবস্থায় ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের ব্যবসায়িক উন্নতি সম্ভব বলেই মত দিয়েছেন কূটনীতিকরা। কারণ শরিফ সহ তাঁর পরিবার বরাবরই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর দাদার আমলে সেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। ভারতের স্টিল ম্যাগনেট সজ্জন জিন্দালের সঙ্গে শেহবাজের বড় ভাই নওয়াজ শরিফের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। শাহবাজ শরিফ নিজেও একটি ইস্পাত বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
এই ঘটনার উদাহরণ টেনে পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক উদ্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৩ সালে ভারত সফরের সময়, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শাহবাজ স্যার ক্রিক, সিয়াচেন, জল এবং কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলে ধরে যুদ্ধের বিরুদ্ধেই মত দিয়ে বলেন, যুদ্ধ কোনও বিকল্প পথ হতে পারে না, একমাত্র শান্তি আলোচনায় যে কোনও সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মত দেন তিনি।


ইস্যু কাশ্মীর

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বরাবরের জ্বলন্ত ইস্যুর নাম কাশ্মীর উপত্যকা। এই সমস্যাই জিইয়ে রেখেছে সীমান্ত অশান্তি। আলাপ-আলোচনা, বৈঠক, মধ্যস্থতা – অনেকভাবেই সমাধানের চেষ্টা চলেছে। শান্তিপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বহু। কিন্তু এত বছর ধরে তা অধরাই। এবার প্রতিবেশী পাকিস্তানের টালমাটাল পরিস্থিতিতে ফের কাশ্মীর ইস্যু উসকে উঠল। আর এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ। 

কুর্সিতে বসার আগে তিনি বলেন,`আমরা ভারতের সঙ্গে শান্তির সম্পর্ক চাই। তবে তা হবে তখনই, যখন কাশ্মীর সমস্যা সমাধান হবে।‘ নয়াদিল্লি অবশ্য এখনও শাহবাজ শরিফের মন্তব্যের কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

আরও পড়ুন-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ এবার কোন পথে?

কূটনৈতিক সম্ভাবনা

২২ কোটির বেশি মানুষ পাকিস্তানে বাস করে। এর পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে চিন এবং পূর্বে ভারত। এর মাঝে মধ্যে অবস্থিত পাকিস্তান। ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ইমরান খানের বক্তৃতা আরও বেশি আমেরিকা বিরোধী হয়ে উঠেছিল এবং তিনি চিন এবং সম্প্রতি রাশিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। যার মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি, যেদিন ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে সেখানে গিয়েছিলেন, তবে সেদিন লাভের লাভ কিছু হয়নি। খালি হাতে ফিরতে হয় ইমরানকে। এখন তো তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বও নেই। 
মার্কিন এবং এশীয় পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ঐতিহ্যগতভাবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। 

পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতে এই ঘটনার প্রভাব কী হবে? পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিবেশীরা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে তিনটি যুদ্ধ করেছে, যার মধ্যে ২টি কাশ্মীর নিয়ে। আফগানিস্তানের মতোই, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীই সংবেদনশীল এলাকায় নীতি নিয়ন্ত্রণ করে, এবং যুদ্ধবিরতির কারণে ২০২১ সালের পর থেকে প্রকৃত সীমান্তে উত্তেজনা তাদের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কে ইমরান খানের চরম সমালোচনা সহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অবিশ্বাসের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে কোনও আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক আলোচনা হয়নি। নতুন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে কূটনীতি কোন দিকে গড়ায়, সেই দিকে নজর নয়াদিল্লির।

More Articles