অস্কারের মঞ্চে সঞ্চালককে থাপ্পড় মনে করাচ্ছে ঋতু-মীরের বাকযুদ্ধ

রসিকতার নানান ধরন। বিভিন্ন অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের হাস্যরস গড়ে ওঠে। এবং সমস্ত কৌতুকেই কারো না কারো প্রতি ব্যঙ্গ করা হয়। কিন্তু সেই ব্যঙ্গের স্বাধীনতা কতদূর? এই নিয়েই প্রশ্ন উঠছে ৯৪ তম অস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনায়। ‘কোডা’-র অস্কার জেতা বা আফ্রো-আমেরিকান অভিনেতা আরিয়ানা ডেবস বা ট্রয় কসটুরের ঐতিহাসিক পুরস্কার জয় এবারের আলোচনার মূল বিষয় না। সমস্ত কিছু উজ্জ্বল ঘটনা এবার একটি বিতর্ককে ঘিরে ম্লান হয়ে গিয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা উইল স্মিথ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ক্রিস রককে প্রকাশ্য মঞ্চে থাপ্পড় মারেন। এই নিয়ে সরগরম সমস্ত নেটদুনিয়া। কেউ দিচ্ছেন পক্ষে মত কেউ বিপক্ষে। তবে আসল ঘটনা কী হয়েছিল?

উইল স্মিথের স্ত্রী জেদা পিঙ্কেট স্মিথ দীর্ঘদিন ধরে অ্যালোপিসিয়ায় আক্রান্ত। সে ব্যাপারে কোনো দিন কোনও রাখঢাক করেননি জেদা। বরাবরই এ নিয়ে সরব তিনি। এই অসুখে মাথার চুল ক্রমে কমে আসে। সেই অসুখের ইঙ্গিত করেই কৌতুক করেছিলেন ক্রিস। কিন্তু প্রিয়জনের অসুখ নিয়ে মশকরা সহ্য করতে পারেননি স্মিথ। তিনি মঞ্চে উঠে একটি থাপ্পড় কষান ক্রিসকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তারপর ক্রিসের নোংরা মুখে জেডার নামোচ্চারণ পর্যন্ত করতে বারণ করেন তিনি বার দুয়েক। এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সারা বিশ্ব। স্মিথের বছর তেইশ বয়েসী ছেলে বাবার এই আচরণ উদযাপন করে টুইটারে। জেদাও সমস্ত অ্যালোপিসিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে কোনও অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দেন এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যদিও তা পরে ডিলিট করে দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করছেন, স্মিথ যা করেছেন ঠিক করেছেন। টোটা রায়চৌধুরী যেমন এ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। আবার অনেকেই একে হিংসার স্বাভাবিকীকরণ বলে মনে করছেন।

‘ওয়ান ট্রি হিল’ খ্যাত সোফিয়া বুশ লেখেন, “হিংসা কোনও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়। শারীরীক নিগ্রহ তো নয়ই। আর জেদাকে এই নিয়ে দ্বিতীয় ক্রিস প্রকাশ্য মঞ্চে ব্যঙ্গ করলেন ক্রিস। বিশেষত এবার অ্যালোপিসিয়া নিয়ে মজা করা হল। কারোর অসুস্থতা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা অত্যন্ত অনৈতিক। ইচ্ছাকৃত ভাবে মজা করা তদুপরি নিষ্ঠুর।” কমেডিয়ান কেথি গ্রিফিন লেখেন, “মঞ্চে কমেডিয়ানকে থাপ্পড় মারা অত্যন্ত বাজে একটি সংস্কৃতি। উইল স্মিথ এ কাজ করলে পৃথিবীর সমস্ত কমেডিয়ানই এরপর কমেডি ক্লাবে আক্রান্ত হবেন, ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল।”

এই ধরনের নানা মত দেখা যাচ্ছে। কেউ স্মিথকে মহিমান্বিত করছেন, কেউ আবার তাঁর অস্কার কেড়ে নেওয়া হোক বলে দাবি তুলছেন। কিন্তু আসল সমস্যাটা কী? সেই হিংস্রতা। ক্রিসের কৌতুকাক্রমণ ছিল আদতে হিংস্র। ঠিক তেমনই হিংস্র ছিল স্মিথের পালটা আক্রমণ। ফলে উভয় ক্ষেত্রেই হিংসা স্বমহিমায় রয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে ঋতুপর্ণ-মীর ব্যাখ্যান।

এদেশের মানুষ সাহেবি শিক্ষায় সমকামকে অসুখ বলে এসেছে দীর্ঘদিন। এখনও বেশিরভাগ মানুষ তাই মনে করেন। তবে এখন আইন সমকামীদের পাশে রয়েছে। ঋতুপর্ণের সময় পথ ছিল আরো কঠিন। তারপর খ্যাতির শীর্ষে বসে সমকামীদের প্রতিনিধিত্ব করা আরো অনেক অনেক কঠিন সে সময়। মীর দীর্ঘদিন বহু জায়গায় ঋতুপর্ণের মিমিক্রি করেছে। এমন কি নিজের শোয়ে ঋতুপর্নকে ডেকেও করেছে। ঋতুপর্ণ কিন্তু মীরকে শারীরীক আক্রমণ করেননি। তখন ‘ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে তাঁর নিজস্ব শো হত। সেখানে মীরকে ডাকলেন। ডেকে মীরকে বুঝিয়ে বললেন, মানুষ ঋতুপর্ণের এই মিমিক্রি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। বরং মিমিক্রিকে তিনি ফ্ল্যাটারি বলে মনে করেন। কিন্তু সেই দায় শুধু মাত্র মানুষ ঋতুপর্ণের উপরই বর্তায়। এই মিমিক্রি দেখে যদি গে কম্যুনিটির কেউ আহত বোধ করেন, সে দায় মীরের উপর সম্পূর্ণ বর্তায়। অর্থাৎ প্রতিনিধি ঋতুপর্ণের এ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। একটা গোটা কম্যুনিটিকে তাদের বিশেষ কিছু অঙ্গভঙ্গী নকল করে অপমান করলে সেটা সমস্যাজনক। মীরের প্রাথমিক আপত্তি ঋতুপর্ণের যুক্তিজালের সামনে টেকে না। 

এছাড়াও যৌন সুড়সুড়ি-মূলক কথা দিয়ে নারীসুলভ পুরুষদের দিনের পর দিন অপমান করা, এবং তাকে পুঁজি করে ব্যবসা করার বিরুদ্ধেও সেই অনুষ্ঠানে প্রতিবাদ জানান ঋতুপর্ণ। এবং পরিস্কারই বলেন মীরকে বাড়িতে ডেকে নিভৃতে এই কথাগুলো মীরকে তিনি বলতেই পারতেন, কিন্তু তাতে ব্যাপারটা ব্যক্তিগত পর্যায়েই থেকে যেত। আর ব্যক্তি ঋতুপর্ণর যে সমস্যা নেই মীরের মিমিক্রি নিয়ে তা তো তিনি বারবারই বলেছেন। তবে যাঁদের তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন, দর্শকদের মধ্যে নারীসুলভ পুরুষ যাঁরা রয়েছেন, যাঁরা মীরের এই আচরণে আহত হন নিরন্তর, তাঁদের প্রতিবাদ একটা কন্ঠ পাবে। না, কেউ অন্তত কথাগুলো বলছে। এবং সমস্ত ব্যাপারটাই হয় ক্যামেরার সামনে অত্যন্ত সুচারুভাবে, ঋতুপর্ণ মীরকে বোঝান, মীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেনে নেন। এই যে পদ্ধতি, সভ্যসমাজ প্রভাবশালী মানুষদের কাছ থেকে তা অনেক বেশি আশা করে। ক্রিস রকের মতো স্বনামধন্য কমেডিয়ানেরও এ কথা খেয়াল রাখা উচিত, যে ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমা ততদূর যতদূর পর্যন্ত তা অন্যের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে। প্রকাশ্য মঞ্চে কারো অসুখ নিয়ে রসিকতার মতো হিংস্রতার উদযাপন না করাই ভালো। উইল স্মিথেরও সমগ্র বিশ্বের সামনে শারীরীক নির্যাতন স্বাভাবিকীকরণ করা একেবারেই উচিত নয়। 

সৌভাগ্যের বিষয়, দু'জনেই প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন দুজনের কাছে। আজ সেই পারস্পরিক ভুল স্বীকারের অনবদ্য বক্তব্য দুটি নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রিস স্বীকার করেছেন একটা নির্দিষ্ট সীমা কমেডিয়ানদের অতিক্রম করা উচিত নয়। তা করে ফেলছেন বলে তিনি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, স্মিথের কাছে, জেদার কাছে ও সমগ্র স্মিথ পরিবারের কাছে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। আবার উইল স্মিথও স্পষ্ট লিখেছেন, কোনো ভাবেই হিংসাকে যথার্থ বলা যায় না। তিনি যা করেছেন তা অত্যন্ত নিন্দনীয়, এবং তার কোনও জাস্টিফিকেশন হয় না। ক্রিসের কাছে, অ্যাকাডেমির কাছে তিনি এ হেন আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।

More Articles