অন্তরালে থাকার সময় কার সঙ্গে দেখা করতেন সুচিত্রা সেন!
Suchitra Sen: সুচিত্রা প্রশ্ন করলেন, “উতু কোথায়?” সুপ্রিয়া জানালেন, উত্তম শুটিং-এর কাজে বাইরে রয়েছেন। ‘‘ইশ! শ্যুটিংয়ে গিয়েছে? উতুকে এখন ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল।’’
চিরকালই রহস্যের আড়াল নিয়ে চলাফেরা করেছেন বাংলা সিনেমার এক এবং অদ্বিতীয় মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। অর্ধশতাব্দী আগে থেকেই নিজেকে আলোর বৃত্ত থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী। যখন তিনি মধ্যগগনে, তখন সেটেই তাঁকে নিয়ে যেসব মিথের জন্ম হয়েছিল, এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি সেইসব গল্পকে আরও পুষ্ট করেছে। সুচিত্রা সেনের মতো ‘এনিগমা’-র অনুুপস্থিতির লেশও বাঙালির মনে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে গেছে, আরও অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছে তাদের। কিন্তু লাইমলাইটে থেকেও যিনি নিজেকে রহস্যে মুড়ে রাখতে ভালবাসতেন, সহ-অভিনেতারা পর্যন্ত যাঁকে বুঝে উঠতে পারতেন না, অন্ধকার, নিভৃত জীবন বেছে নেওয়ার পর তাঁর যে ছিঁটেফোঁটাও নাগাল পাবে না সাধারণ মানুষ– এটাই স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন এই নিয়ে নানাবিধ গবেষণা চলেছে। জীবনীকার গোপালকৃষ্ণ রায় এই নিভৃত যাপনের অন্যতম সঙ্গী। কাজেই টুকটাক খবর তাঁর মাধ্যমেই যা জানা গিয়েছে এই সময়ের। তার বাইরে তেমন কোনও তথ্য নেই। ফলে, কৌতূহল মানুষের রয়েই গেছে।
গোপালকৃষ্ণ রায়ের সঙ্গে সুচিত্রার ঘনিষ্ঠতার ঘটনাটি বড় অদ্ভুত। গোপালবাবু তখন ইউএনআই-এর নামকরা সাংবাদিক। সেই সত্তরের দশকে অনস্ক্রিন চুম্বনের দৃশ্য কতটা গ্রহণযোগ্য– তা নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক শুরু হয়। এই বিষয়ে সত্যজিৎ, মৃণাল, উত্তম, সৌমিত্র– সিনেজগতের তারকারা কে কী বলছেন, সেই মতামত জানতে কিছু প্রশ্ন পাঠান গোপালবাবু। সেই তালিকায় মহানায়িকাও ছিলেন। বাদবাকি মোটামুটি সবাই এই বিষয়ে খোলাখুলি মতামত রাখলেও, কোনও মত প্রকাশ করেননি সুচিত্রা। অনেকদিন অপেক্ষার পর তাঁকে ফোন করেন গোপালবাবু। ফোন তুলে কটাক্ষ করে মহানায়িকা গোপালকৃষ্ণ রায়কে বলেছিলেন, “এত সহজে তো আপনাকে চুমু দিতে পারব না।” শুনে একটু বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন গোপালবাবু। অপ্রস্তুতের একশেষ। পরে ব্যাপারখানা বুঝে সামলে নিয়ে বলেন, তাহলে মহানায়িকার মতামত ছাড়াই তাঁর এই প্রতিবেদন ছাপা হবে। লেখা কারও জন্য আটকে থাকবে না। তাই হয়েছিল। এই ঘটনার পরে গোপালবাবুর সঙ্গে আলাপ শুরু হয় সুচিত্রার। তা পরিণত হয় বন্ধুত্বে। যে-সময় জগৎ থেকে নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছেন, তখনও গোপালবাবুর প্রায়ই আনাগোনা ছিল তাঁর বাড়িতে। তখন বরং বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছিল। বৃদ্ধ বয়সে প্রায়ই আড্ডার জন্য নিজের বাড়িতে গোপালবাবুকে ডেকে নিতেন নায়িকা। তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন যখনতখন। সেই সম্বন্ধে গোপালবাবু এক জায়গায় বলছেন, “বয়স হলেও তাঁর দাপট তখনও কমেনি একটুও। অটুট ছিল তাঁর সেই বিখ্যাত খামখেয়ালি মেজাজ। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে পর্যন্তও আমাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই এদিকওদিক বেরিয়ে পড়তেন। অবশ্যই নিজেকে লুকিয়ে। বারণ করলেও শুনতেন না। ওঁর এক প্রিয় দর্জির দোকান ছিল। সেখানে হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয়ে দিব্যি গল্প জুড়ে দিতেন।”
আরও পড়ুন- ক্ষমা চাইতে হয়েছিল খোদ সুচিত্রা সেনকে! স্বর্ণযুগের অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ছিল আড়ালেই
সিনেমার সেটে সুচিত্রার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অকল্পনীয়। একবার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় মেক আপ করছেন। একজন এসে খবর পাঠালেন, সাবিত্রীকে সুচিত্রা ডেকে পাঠিয়েছেন। সাবিত্রীর এদিকে অর্ধেক মেক আপ হয়েছে। যান কী করে? একবার সেকথা বলারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু আপত্তি ধোপে টিকল না। সুচিত্রাকে ভয়ও করেন খুব। অত্যন্ত মুডি। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি যেতে হবে। কখন যে রেগে কেলেঙ্কারি বাধাবেন, তার ঠিক নেই। অগত্যা ওই অবস্থাতেই গেলেন সাবিত্রী। তখন থেকেই সুচিত্রার মেক আপ রুমের উপরে একটি বড় মা কালীর ছবি লাগানো থাকত। আধ্যাত্মিকতার লক্ষণ কিছু কিছু ফুটে উঠছে তখনই। সাবিত্রীকে বসতে বললেন। আপত্তি জানিয়ে সাবিত্রী বললেন, “রমাদি, এই অবস্থায় কীভাবে বসি বলো তো!” সে আপত্তিও উড়িয়ে দিয়ে সুচিত্রা বললেন, “আরে থাক না, যতক্ষণ আমি না যাচ্ছি, ফ্লোরে শুটিং তো আর শুরু হচ্ছে না।” তারপরে অনেক গল্প। মাঝে সাবিত্রীর কাছ থেকে মিষ্টি পান চেয়েও খেলেন। সাবিত্রীর বয়ানে, ওই একজনই তাঁকে ‘সাবি’ বলে ডাকতেন। সাবুও না, সাবিত্রীও না। পরে নিজের মেক আপ সম্পূর্ণ করে আয়নায় নিজের গালে নিজে হাত দিয়ে ঠোনা মেরে বললেন, “সুচিত্রা, শুধু রূপেই করে খেলি। সাবির মতো অভিনয় তো আর করতে পারলি না!” সাবিত্রীর একথা সমর্থন করেছেন গোপালকৃষ্ণ রায়ও। তিনি জানান, সুচিত্রা সাবিত্রীর অভিনয়-ক্ষমতাকে রীতিমতো ঈর্ষা করতেন। ঠাকুরের কাছে সাবিত্রীর মতো অভিনয়-ক্ষমতাও চাইতেন।
আবার সেই মানুষই এতটা মুডি, সাবিত্রী ফোন করলেও ফোন ধরতেন না। কাজেই একটু দূরে দূরেই থাকতেন সহ-অভিনেতারা। সুচিত্রাকে বোঝা ছিল অত্যন্ত দুরূহ। গোপালবাবু এও উল্লেখ করেছিলেন, মহানায়িকার মনের মধ্যে একটা প্রতিহিংসার ভাবও ছিল। ওঁকে একবার জনৈক প্রযোজক খুব অপমান করেন। মহানায়িকা হওয়ার পর কড়ায়গণ্ডায় তার শোধ নিয়েছিলেন সুচিত্রা। তাঁকে দিয়ে জুতো পর্যন্ত তুলিয়েছিলেন। কী, না একবার মই বেয়ে বই পাড়ার একটা দৃশ্য শ্যুট করার সময় তাঁর জুতো খুলে যায়। তখন তিনি সেই প্রযোজককে বলেন, “প্লিজ আমার জুতোটা একটু যদি বাড়িয়ে দেন।” বয়স্ক ভদ্রলোক নিজে হাতে তাঁর জুতো তুলে দিয়েছিলেন। একথা নিজের মুখেই জীবনীকারকে বলেছিলেন সুচিত্রা। অপমান সহ্য করতেন না কখনওই। আর এই মেজাজের জন্যেই তাঁকে ভয় করে চলত সবাই।
একবার ‘গৃহদাহ’-র সেটে এক ফোটোগ্রাফার বিনা অনুমতিতে মুনমুনের একটা ছবি তোলায় হুলুস্থুলু কাণ্ড করেছিলেন। শুটিং পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজের মতের কাছে স্বামী, মেয়ে কাউকেই কোনওদিন তোয়াক্কা করেননি। এই চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর ছিল। মুনমুন সিনেমায় নামার পর মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। মেয়ে এসে ফিরে ফিরে চলে যেত। কথা বলতেন না সুচিত্রা। গোপালবাবুর মনে হয়েছিল, জেদ এবং তেজ– এই দুইই সুচিত্রাকে সুচিত্রা করেছিল। প্রসঙ্গত, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রাজ কাপুর, এমনকী, সত্যজিৎ রায়কেও।
আরও পড়ুন- সুচিত্রা বলতেন ‘দুষ্টু ছেলে’, ডার্লিং মুনের প্রেমে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম আমি…
সুচিত্রা কৌতুকপ্রিয়ও ছিলেন। একবার সারাদিন বৃষ্টি। উত্তমের বাড়িতে ফোন করলেন। ময়রা স্ট্রীটের বাড়িতে তখন সুপ্রিয়া একা। তিনিই ফোন ধরলেন। সুচিত্রা প্রশ্ন করলেন, “উতু কোথায়?” সুপ্রিয়া জানালেন, উত্তম শুটিং-এর কাজে বাইরে রয়েছেন। ‘‘ইশ! শ্যুটিংয়ে গিয়েছে? উতুকে এখন ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল।’’ কথার ধরন শুনেই সুপ্রিয়া বুঝে ফেলেন, ঠাট্টা করছেন সুচিত্রা। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলেন, শুটিং শেষ করে উত্তম বাড়ি ফিরলেই তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেবেন উত্তমকে। এবার সুচিত্রার অবাক হওয়ার পালা। রাগলেন না কেন সুপ্রিয়া? উত্তরে সুপ্রিয়া বলেছিলেন, “রমাদি, আমি তোমাকে খুব ভাল করে চিনি!” বাস্তবিকই উত্তমকে সুচিত্রার মতো বুঝতে খুব কম লোকই পারতেন। রমা এবং উত্তমের মধ্যে যে বন্ধুত্ব ছিল, তা কখনও কখনও অল্প ফ্লার্টিংয়ের পরিসরে ঘোরাঘুরি করলেও নির্দিষ্ট সীমারেখা লঙ্ঘন করেনি কখনও– এ তথ্য সুপ্রিয়ার জানা ছিল। শুধু সুপ্রিয়া নয়, সেই সময়ে সিনেমার সঙ্গে জড়িত বহু লোকই এই ব্যাপারে অবগত ছিলেন।
শেষজীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রতি ঝোঁক প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছিল সুচিত্রার। যেন গৃহী সন্ন্যাসিনী। খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। অল্প কিছু আসবাব ছিল তাঁর ফ্ল্যাটে। প্রাসাদসম বাড়ি বিক্রি করে মেয়ে এবং মা মুখোমুখি দুটো ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। সৎসঙ্গে থাকতে চাইতেন। ধর্ম সংক্রান্ত পড়শোনা আর পূজাপাঠই ছিল সুচিত্রার জীবন। বিভিন্ন ধর্মের বই পড়তেন মহানায়িকা। ভরত মহারাজের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বেলুড় মঠের সঙ্গে আজীবন তাঁর সম্পর্ক ছিল। সমস্ত জল্পনা কল্পনার থেকে দূরে নিজের ভবিষ্যত নিজে বেছে নিয়ে অভিনয়ের মতো পিতৃতান্ত্রিক জগতে নারী প্রতিনিধিত্বের যে বলিষ্ঠ উদাহরণ রেখেছিলেন মহানায়িকা, তা সমগ্র ভারতবর্ষে বিরল।