মায়ের জাত থেকে মাদারজাত! মাতৃত্ব দিয়ে মেয়েদের আসলে ঘুষই দেওয়া হয়

International woman's Day 2023: প্রতি নারীদিবসে ‘আমি নারী আমি পারি’ গোছের শব্দ তির এসে সোশ্যাল মিডিয়া ছ্যাঁদা করে দেবে। ‘আমি পারি’ তাঁদেরই ফলাও করে বলতে হয় যাঁদের ‘পারা’টা স্বীকৃতই নয়।

একটি অশ্রুতিমধুর শব্দ দিয়ে যে লেখার শিরোনাম শুরু হয়, তার ভেতরখানা সম্পর্কে হয় মানুষের ‘ইশশ ছিঃ ছিঃ’ কাজ করতে পারে, অথবা ‘উফফ রেবেল’ কাজ করতে পারে। আর যেটি কাজ করবেই, তা হল কৌতূহল। সম্প্রতি একটি মাল্টিপ্লেক্সে ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি’ দেখতে গিয়ে আলিয়ার গাঙ্গু চরিত্রটি যখন থুতু ফেলে ‘মাদারচোদ’ বলে গাল দিল, সিটি আর হাততালিতে হল ভরে গেল, এই এক অত্যন্ত কৌতূহল নতুন করে চাগাড় দিল। আরও দিন কয়েক আগে, পাকিস্তান ও ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের একটি ‘ওলেবাবালে’ জাতীয় ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরে ক্রিকেটের সমালোচনা বা প্রশংসার পরিবর্তে ‘ওরা মায়ের জাত’ জাতীয় ক্যাপশন খোদাই করা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলিও এই কৌতূহলের কারণ। আইসিসি ওমেন’স ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে গিয়ে পাকিস্তানের মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিশমাহ মাহরুফের ছ’মাসের কন্যা ফাতিমাকে ঘিরে আনন্দ করছেন, আদর করছেন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা। সহজ, সুন্দর দৃশ্য। সীমান্ত নেই, হিংসা নেই, প্রতিযোগিতা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি নেই। কিন্তু খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার প্রশংসা করতে গিয়ে সামনে এল মাতৃত্বই। মায়ের রূপ, মাতৃরূপেণ, মায়ের জাত, ওরা মা, মায়েরা সব পারে ইত্যাদি অত্যন্ত অগভীর শব্দবন্ধ দিয়ে কোথায় পৌঁছল ক্রিকেট প্রেমী অথবা মহিলাপ্রেমীরা? ক্রিকেটের চরম খারাপ মুহূর্তেও মহেন্দ্র সিং ধোনির মেয়েকে কোলে নিয়ে বাকিদের আনন্দের সময় ‘ওরা বাবার জাত’ বলে কোনও গর্ব প্রকাশ না করা কি পিতৃত্বকে খাটো করা নয়? 

শিরোনামের দ্বিতীয় ভাগটি ধার করা। সৌজন্যে শক্তিনাথ ঝা। উড়ান লিটল ম্যাগাজিনের অন্য রঙের রাধা সংখ্যায়, রাধা চরিত্রটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যৌনতা ও মাতৃত্ব বিষয়ে আলোচনা করার সময় ভারতের সেই সব দেবীদের কথা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন শক্তিনাথ, যারা স্রেফ মা হিসেবে খ্যাতি না পাওয়ায় পূজিত নন। শীতলা, কালিকা, মনসা অথবা যে দেবীদের সঙ্গে পুরুষ জড়িত নন তাঁরা সততই ‘ভয়ঙ্করী’। যে ভয়ঙ্করকে সুন্দরে বদলে দিতে পারলে সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয়ের মতো হেডকোয়ার্টার সামলানো পিতৃতন্ত্রের পক্ষে সহজতর হয়ে ওঠে। মাতৃত্ব দিয়ে আসলে মেয়েদের বড় রকমের একটা ঘুষ দেওয়া হয়। মুখ বন্ধের, ইচ্ছা বন্ধের এবং সর্বোপরি যৌথচেতনা ও আন্দোলন বন্ধের। যে স্বাভাবিক বায়োলজিক্যাল কারণে মহিলাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা রয়েছে তার সঙ্গে সামাজিক লিঙ্গ হিসেবে একজন মেয়ের বড় হয়ে ওঠা, শিক্ষা, জীবিকা এবং স্বপ্নকে গুলিয়ে দেওয়ায় সংখ্যাগুরুরা সফল, বলাই বাহুল্য। ‘মায়েরা সব পারে’ বলার মধ্যে যতখানি গৌরব আছে তা একটি উৎকৃষ্ট মানের মলম ছাড়া কিছুই নয়। যা দিয়ে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, ভোটাধিকার না থাকার অবজ্ঞা, নিজের ইচ্ছায় চাকরি না করতে পারা, রান্না জানার বাধ্যতা, সমান মাইনে না পাওয়া ইত্যাদির ঘা-কে আড়াল করা হয়। প্রথম কথা, মায়েদের সব পারতে হবেই বা কেন? যদি তিনি একই সঙ্গে রুটি বেলা এবং গোলকিপিংয়ে দক্ষ হন সেটি তাঁর নিজস্ব দক্ষতা। তার সঙ্গে পেট কেটে বের করে আনা মাতৃত্বের কী সম্পর্ক! এর সঙ্গে কোনও গৌরবও জড়িত নেই। বিশমাহ মাহরুফকে নিশ্চয়ই ওদেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছেন ‘মা কবে হবেন?’ এমনটা করাই রীতি। সানিয়া মির্জাকেও এই প্রশ্ন করা হয়, করিনা কাপুরকেও। চাঁদেই যাও বা পিচে, মাছের আড়তেই বসো বা সংসদে, এই কমন প্রশ্নটি আসলে চাঁদে যাওয়ার দক্ষতা, পিচে ঘামার অভ্যাস, মাছ বেচার কৌশল বা সংসদে যাওয়ার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিতই নয়। যেহেতু মহিলা, তাই মাতৃত্ব স্বাভাবিক অথবা যাই করে নাও মা তো হতেই হবে একদিন, এই ধারণাই প্রশ্ন আকারে বেরিয়ে আসে। কিন্তু যারা চাঁদেও যান না মাছের আড়তেও বসেন না, তাঁদের কী হবে? 

সন্তানের জন্ম দিতে দিতে যাতে বহু বছর কেটে গিয়েছে এবং যাবে তাঁদের কাছে মাতৃত্বের ‘অপশন’ নেই, বাধ্যতা আছে। মা হওয়ার বায়োলজিক্যাল প্রক্রিয়াটি এতখানিই গ্লোরিফায়েড যে এইটুকু পেয়ে কাতারে কাতারে মহিলা নিজের সব দক্ষতা, ইচ্ছা, সম্ভাবনা ফেলে ঘুষটুকু নিয়ে মেতে ওঠেন। উঠতে বাধ্য। পুতুলকে জামা পরানো, চুল আঁচড়ে দেওয়া, পুতুলকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানোর মতো খেলা শুধু তো ছোটোবেলার খেলা নয়, খেলার ছলে মাতৃত্বের প্রাথমিক পাঠ। যে খেলায় ছেলেদের আবার সক্রিয় কোনও ভূমিকাই নেই। মা হওয়া কঠিন বলতে বলতে কঠিনের প্রতি যে মোহ তৈরি হয় তাতে মহিলাদের মাতিয়ে দেওয়া সোজা। একটা কঠিন নিয়ে মেতে গেলে অন্য কঠিন কাজগুলো আর আবিষ্কার করতে হয় না, প্রতিযোগিতাও কমে। ইজ্জতের কাঙাল করে রাখা হয়েছে যে মহিলাদের, তাঁদের মাতৃরূপে পুজো করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলিয়ে দিতে পারলেই তাঁরা শান্ত। সর্বহারার মধ্যেও যারা সর্বহারা, তাঁদের খুব সামান্য দিয়েই সন্তুষ্ট করা যায়। তবে এত সোজা সমীকরণ নয়। গুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি সর্বগ্রাসী। ‘মাই লাইফ মাই চয়েস’ নামের একটি বুলি অথবা টোপ এতখানিই সুস্বাদু যে তার মধ্যে দিয়ে পাস করিয়ে নেওয়া হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক বহু আচরণ। আমার সিঁদুর পরতে ভালো লাগে তাই পরি, আমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব অন্য কেউ নিলে আমার ভালো লাগে তাই নিতে দিই, আমার বোরখা পরতে ভালো লাগে তাই পরি, আমার মা হতে ভালো লাগে তাই হই, আমার মনে হয় গালাগালি করলেই আমি আধুনিক তাই করি এসব ফিতাকৃমি হড়হড়িয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাপনে যাতে যুক্তির সমস্ত অভাব ‘চয়েস’ দিয়ে ঢাকা যায়। এই চয়েস প্রসঙ্গেই মাতৃত্বে ফেরা। 

মা হওয়া বা না হতে চাওয়া কোনওটাই সমস্যার না, মূল সমস্যা হল ‘মাতৃসত্ত্বা’ দিয়ে বিচার। মা শব্দের রাজনীতিটাই এমন যাতে ত্যাগস্বীকার বিষয়টিকে চূড়ান্ত মহান করা হয়। এই মহানুভব মা যদি অন্য কিছু করে থাকেন, যেমন চাকরি করা, চাঁদে যাওয়া বা অভিনয় করা বা সাহিত্যকর্ম বা যা কিছু একজন শ্রমজীবির করার কথা তাহলে সেই কর্মের প্রশংসা বা সমালোচনা দুই’ই মাতৃসত্ত্বার নিরিখেই করা হয়। সেখানে সার্থক হলেও মায়ের জয়, অসফল হলেও মাতৃত্বের ছায়ায় তার সাত খুন মাফ। পিতৃতন্ত্র যদি চায়, নায়িকা ‘মাদারচোদ’ বললেও হাততালি উঠবে, পিতৃতন্ত্র যদি চায় মেয়েরা ‘মায়ের জাত’ হয়েই আজীবন আন্দোলনচ্যুত হয়ে কাটিয়ে দেবে বিনা বাক্যব্যয়ে। মাতৃত্ব একটি সিউডো পাওয়ার পজিশন তৈরি করে, দেবীত্ব বললে তা অনেকটা লোকজ হয়। ছোটো থেকেই মাদার আর্কিটাইপের প্রতি যে মোহ বা লোভ ঘনীভূত হয়ে থাকে সেই স্থানে নিজেকে নিয়ে গিয়ে এই ছদ্ম ক্ষময়তায়ন ভোগ করার বাসনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দেবীত্ব তথা মাতৃত্ব আর রোজ দিন মজুরিতে মার খাওয়া শ্রমজীবি মহিলার বাস্তবতার মধ্যেকার ফারাক আছে। আমাকে সমানাধিকার নিয়ে সওয়াল করতে দেওয়া হচ্ছে তাই করছি, রাষ্ট্র আন্দোলন করতে দেয় তাই করতে পারি- এর মধ্যে কোনও ক্ষমতায়ন নেই। রাষ্ট্র হোক বা পিতৃতন্ত্র এক তুড়ি বাজিয়েই মায়ের জাতকে রড ঢুকিয়ে ফালাফালা করে দিতে পারে, আবার মায়ের জাতদের দিয়েই অন্যকে মাদারজাত করিয়ে ছদ্ম ক্ষমতায়ন ঘটাতে পারে।       

প্রশ্ন করার অভ্যাস মাতৃত্বের পরিপন্থী। প্রতি নারীদিবসে ‘আমি নারী আমি পারি’ গোছের শব্দ তির এসে সোশ্যাল মিডিয়া ছ্যাঁদা করে দেবে। ‘আমি পারি’ তাঁদেরই ফলাও করে বলতে হয় যাঁদের ‘পারা’টা স্বীকৃতই নয়। মহিলাদের সমান অধিকার নিয়ে লড়ার কথা বা সাম্যবাদের আন্দোলন এই কারণেই গোঁত্তা খায়। শ্রেণিবদ্ধ লড়াইয়ে জায়গায় এই ছদ্ম ক্ষমতায়নের ঘুষ দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের মুখ বন্ধই করা হয়, এটাই সংখ্যাগুরুর রাজনীতি। অর্ধেক আকাশ বলতেই অর্গ্যাজম হয়ে যায় যাঁদের তাঁদের আসলে নিজস্ব আকাশের স্বপ্ন দেখতেই দেওয়া হয় না। একটা গোটা আকাশ পেতে যে আন্দোলন দরকার তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মতো টোপ বেড়েই যাচ্ছে। অল্পে খুশি থাকাটাও আসলে মাতৃত্বেরই ত্যাগ সিন্ড্রোম।

More Articles