হিজাব নয়! কর্নাটক থেকে ইরান, আন্দোলনের মূল মন্ত্র নারীস্বাধীনতা
Hijab Movement: প্রশ্নটা আসলে হিজাবের নয়, প্রশ্নটা নারীস্বাধীনতার।
কর্নাটকের স্কুল-কলেজে হিজাব পরার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় দ্বিধাবিভক্ত। কর্নাটকে একদিকে যত জোরালো হয়েছে হিজাব পরার দাবি, ইরানে হিজাব না পরার অধিকার নিয়ে ততই সরব হচ্ছে নারীরা। এই দুই অধিকারের লড়াইই কেন জরুরি, তা ইরানের ইতিহাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
বিগত প্রায় একমাস ধরে ইরানের বাতাসে ভাসছে বারুদের গন্ধ। ইরানের রাজধানীর পথ অবরোধ করে অবস্থান করে চলেছেন অসংখ্য মানুষ, আর ইতিমধ্যেই পুলিশের দফায় দফায় চালানো গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন নব্বই জন আন্দোলনকারী। সম্প্রতি ইরানের সরকারি টিভি চ্যানেল অবধি হ্যাক করেছে আন্দোলনকারীরা। স্ক্রিনজুড়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলি খোমাইনির ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, “তোমার হাত থেকে আমাদের তরুণদের রক্ত ঝরে পড়ছে”। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ কিছু বোঝার আগেই সারা বিশ্বে এই হ্যাকিংয়ের খবর ছড়িয়ে যায়। মাত্র ১৫ সেকেন্ড চ্যানেল হ্যাক করার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীরা সমগ্র ইরানবাসীর কাছে পক্ষান্তরে তাদের এই যুদ্ধে যোগদানের জন্যই আবেদন জানিয়েছেন বলেও অনেকের ধারণা। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন সবকিছুই ভাইরাল হয়, বিশ্বের কোথায় কী ঘটে যাচ্ছে, তা এখন শত চেষ্টার পরেও লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় শাসক গোষ্ঠী, প্রতিবাদের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে আর এইভাবেই বিপ্লব এখন দীর্ঘজীবী হয়।
আরও পড়ুন: কর্নাটক থেকে ইরান, হিজাব বিতর্কই মেলালো দুই দেশের মুসলিম নারীদের?
শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নির্মিত আইনবলে একজন মুসলিম নারী তাঁর চুল ঢেকে রাখতে বাধ্য। ২২ বছরের মাসা আমিনির তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে কিছুদিন আগেই এক তরুণী এই আইনের চূড়ান্ত বিরোধীতার প্রতীকরূপে নিজের চুল কেটে, তা দিয়ে পতাকা বানিয়ে উড়িয়েছিলেন ইরানের মাটিতে– এই ছবির সঙ্গে বোধহয় ইন্টারনেটের দৌলতে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত হয়েছি। এই প্রতীকী ভাবমূর্তিকে জিইয়ে রাখার জন্য তুর্কির বিখ্যাত গায়িকা মেলেক মোসো একটি অনুষ্ঠান চলাকালীন, স্টেজেই সকল দর্শকের সামনে নিজের চুল কেটে ইরানীয়দের এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন, আবার এই আন্দোলনের জাল ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের মাটিতেও। উত্তরপ্রদেশের অনুপমা ভরদ্বাজ নামে একজন মহিলা চিকিৎসক নিজের চুল কাটার একটি ছবি পোস্ট করেছেন। তাঁর এই ছবি সামনে আসতেই দেশজুড়ে ইরানের এই আন্দোলন খানিক হলেও আলাদা মাত্রা লাভ করেছে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ইরানের হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে এখন শামিল হয়েছে স্কুল পড়ুয়ারাও, ইরানের ইতিহাসে এই ঘটনা প্রথম। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় তো বটেই, রাস্তা-ঘাটে অথবা স্কুলে যাওয়ার পথেও স্কুলগামী নাবালিকাদের ভিড় থেকে ভেসে আসছে শাসক-বিরোধী হুংকার, তাঁরাও নিজেদের হিজাব খুলে মাসা আমিনি-র হত্যার বিচার চাইছে আজ।
মহিলাদের স্বাধীনতা হননের এই ভ্রান্ত আদর্শে ইরানের সমকক্ষেই অবস্থান করে তালিবান-অধ্যুষিত আফগানিস্তান। ইরানের এই আন্দোলন বিশ্ববাসীকে আরও একবার কোথাও গিয়ে হয়তো অনেক বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে তালিবান রাজের কথা, নারীদের প্রতি ঘটে চলা অত্যাচার, অবিচারের কথা। ২০২১ সালে আফগানিস্তানের মাটি থেকে আমেরিকা নিজেদের সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরেই যখন তালিবানরা রাজধানী কাবুল দখল করল, তারপর নিজেদের সুরক্ষার তাগিদে কাবুলের রাস্তায় নেমে এসেছিলেন দেশের মহিলারা, এবং সেদিনও স্বৈরাচারী তালিবান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিরোধিতার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই হিজাব। মুসলিম সমাজে বরাবরই আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র হিসেবে মহিলাদের হাতে উঠে এসেছে তাঁদের একটুকরো কাপড়। কখনও তা না পরা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিপত্তি, কখনও আবার হিজাব পরার অধিকার ছিনিয়ে নিতে রাস্তায় নেমেছে ইরানের মহিলা সমাজ।
হ্যাঁ, ইরানের ইতিহাসে এমনও দিন গেছে যখন শাসক, সমগ্র মুসলিম সমাজকে ধর্মীয় গোঁড়ামির হাত থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বলপূর্বক মহিলাদের হিজাব কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে আমেরিকা যুক্তরাজ্যের হাত ধরে ইরানে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল রেজা শাহ, তিনি ছিলেন পার্সিয়ান কসাক বিগ্রেডের কম্যান্ডার। তাঁর হাত ধরেই ইরানে পাহালভি রাজবংশের সূচনা হয়। ইউনাইটেড কিংডম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হওয়ার দরুন তিনি চেয়েছিলেন ইরানের ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে। ক্ষমতায় আসার কিছু বছরের মধ্যেই তিনি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কারে সচেষ্ট হন এবং এই সময় থেকেই তিনি ইরানে ইসলামিক আইনের পরিবর্তে পশ্চিমি আইন প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। তাঁর এই অতি পশ্চিমি ধ্যানধারণা থেকেই শুরু হয় সমস্যা। ইসলামিক গোঁড়ামি থেকে ইরানকে মুক্ত করতে গিয়ে তিনি সমস্ত প্রচলিত পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, নিষেধাজ্ঞা বর্তায় মহিলাদের হিজাব এবং বোরখার ওপরেও। সমাজসংস্কারের এই আগ্রাসী নীতি স্বাভাবিকভাবেই সেদিনকার ইরানবাসী ভাল চোখে নেয়নি। অবশেষে মহিলাদের হিজাব রোধ করার জন্য রেজা ১৯৩৬ সালে প্রবর্তন করেন কাসফ-ই-হিজাব। 'কাসফ-ই-হিজাব’-এ বলা হয়, যদি কোনও মহিলা হিজাব পরিধান করেন, তবে তা অপসারণের সম্পূর্ণ অধিকার দেশের পুলিশের রয়েছে। মুসলিম সমাজে নারীদের প্রতি রক্ষণশীল রীতিনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনিই সেদিন হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের স্বাধীনতা-হননকারী। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর এই পশ্চিমি ভাবধারার কারণেই ১৯৬৩ সালে ইরানের নারীদের ভোটাধিকার লাভ করেছিল। তিনিই মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৩ থেকে বাড়িয়ে ১৮ করেছিলেন এবং গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণা করেছিলেন।
কিন্তু মহিলাদের পোশাকের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার কারণে ইরানের মহিলারা সেদিন রেজার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন হিজাবের অধিকার দাবি করে। প্রশ্নটা আসলে হিজাবের নয়, প্রশ্নটা নারীস্বাধীনতার। ধর্মীয় মৌলবাদ পৃথিবীর যে স্থানে মাথাচাড়া দিয়েছে, সেখানেই নিষেধাজ্ঞা পালনের সমস্ত দায়ভার বর্তেছে নারীদের ওপর। সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে এককথায় পদদলিত করাই যেন হয়ে উঠেছে শাসক শ্রেণির প্রধান উদ্দেশ্য। আধুনিক পৃথিবী মানুষকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রর ভুয়ো পাঠ পড়ালেও সমাজের নারীদের মর্যাদা এবং স্বাধীনতা আজও কল্পনাতীত। এই কথা যেমন আজকের ইরান অথবা আফগানিস্তানে সত্যি, তেমনই সত্যি ভারতের কর্নাটকে।