বরফের দেশেও দিব্যি ফলছে! কীভাবে চাষ করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামী এই আম?
World's Most Expensive Mangoes : হাজার হাজার টাকা দাম একটি আমের! কোথায় ফলানো হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামী এই আম?
কাঁচা আমে পাক ধরতে শুরু করেছে সম্প্রতি। দু একটা ঝড়ে বেশ কিছু পড়েও গিয়েছে। আর যেগুলো পড়েনি সেগুলিই রং পাকিয়ে ইতিমধ্যেই বাজারে আসতে শুরু করেছে। হিমসাগর, ফজলি, ল্যাংড়া, পেয়ারাফুলি, বোম্বাই, আলফানসো ইত্যাদি আরও কত কত ধরন। কোনটার দাম কেজি প্রতি ৫০ টাকা কোনওটা আবার ২০০! কিন্তু তাই বলে একটি আমের দাম প্রায় ২৫০০০ টাকা! এমনটা শুনেছেন আগে কখনও? শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি এই বিশ্বেই এমন একটি আমার চাষ করা হয় যার কেজি প্রতি দাম এমনটাই আকাশছোঁয়া। জানেন কী সেই আম? চাষই বা করা হয় কোথায়?
প্যাচপ্যাচে ঘাম, হাঁসফাঁস পরিস্থিতি, হাজারটা রোগ, মাত্রারিক্ত বিদ্যুতের বিল গরমকালের এই সবকটা খারাপ অনুষঙ্গের পাশে একমাত্র যেটা মনপসন্দ সেটা হল আম। সবকিছু খারাপকে উপেক্ষা করা যায় কেবল এই একটা স্বাদের জন্যই। আম নিয়ে অবশ্য জনতার চিরকালের আদিখ্যেতা। কিছুদিন আগেই মালদহের বাজারে ঝড় তুলেছিল শীতের আম! কমলালেবুর পাশেই জাঁকিয়ে বসেছিল খোদ গরমকালের এই ফল। একটা আম বিকিয়েছিল কড়কড়ে একশো টাকা দামে। কেজি কেজি কেনার সুযোগ না থাকলেও অন্তত এক পিস আম কিনে মন ভরিয়েছিলেন আম প্রিয় বাঙালি। কিন্তু আজ যে আমের কথা বল হবে, তার দাম মোটেই একশো দুশো টাকা নয়, হাজার হাজার টাকা দাম এক কেজি আমের। আক্ষরিক অর্থেই সোনার সমান দামে বিকোয় কেজি প্রতি আম।
আরও পড়ুন - টক ডাল থেকে মাছের টক, চাঁদিফাটা গরমে আজও বাঙালির ভরসা এই চিরন্তন রান্নাগুলি
যদিও দেশী আমের বাজারে ইনি বিদেশিনী। ২০১১ সাল থেকে জাপানের সবচেয়ে উত্তরের দ্বীপ, তুষারময় টোকাচি অঞ্চলে এই বিশেষ ধরনের ব্যয়বহুল আমের চাষ করে আসছেন নাকাগাওয়া নামের এক ব্যক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে দামী আম হিসেবে এতদিন মিয়াজাকির নাম বলা হতো। ফলে এই আমটির দাম সামনে আসায় সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রদ বদল হতে পারে।
হাকুগিন নো তাইয়ো, এটিই নাম এই বিশেষ আমের।যদিও এই আমচাষি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মানুষটি প্রথম থেকেই চাষ করতেন এমনটা নয়। একসময় পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে কাজ করতেন জাপানের হোক্কাইডো দ্বীপের বাসিন্দা হিরোইউকি নাকাগাওয়া। জীবনের প্রায় উপান্তে পৌঁছে তিনি স্থির করেন পেট্রোলিয়াম কোম্পানির কাজ ছেড়ে অভিনব চাষ শুরু করবেন। প্রথমে অবশ্য বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। এমন শীতের পরিবেশে আম উৎপাদন কীভাবে সম্ভব এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তো ছিলই। ৬২ বছর বয়সী নাকাগাওয়াকে তাই প্রথমে কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি।
প্রথমে মিয়াজাকি আমের আরেকজন আম চাষীর নির্দেশনায় কাজ শুরু করেন তিনি। তিনিই প্রথম তাঁকে সাহস দেন যে, শীতের সময়েও আমের ফলন সম্ভব। ফলে সেই একই প্রক্রিয়ায় নাকাগাওয়া তাঁর নিজের খামারও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পাশাপাশি তাঁর স্টার্টআপ নোরাওয়ার্কস জাপান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শীতকালেও কীভাবে আমের ফলন সম্ভব হল? কোন পদ্ধতির সাহায্যে পাক ধরালেন আমে?
নাকাগাওয়া এই সাফল্যের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদকেই মূলত ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা গিয়েছে। একদিকে হোক্কাইডোর বিখ্যাত তুষার এবং অন্য দিকে উষ্ণ প্রস্রবণ, তিনি এই দুইকেই সঠিক ভাবে ব্যবহার করেছে বিশেষ আম চাষের ক্ষেত্রে। একদিকে শীতকালীন সময় থেকে তুষার সঞ্চয় তা দিয়ে গ্রীষ্মকালে গ্রিনহাউসগুলিকে ঠান্ডা করেতেন, অন্যদিকে শীতকালে তিনি গ্রিনহাউস গরম করার জন্য ব্যবহার করতেন প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ।গ্রিনহাউজের ভেতরটা শীতল থাকায় আমের মুকুল আসে দেরিতে। অপরদিকে শীতকালে তিনি বসন্তের প্রাকৃতিক উষ্ণতায় গ্রিনহাউজকে উষ্ণ রাখেন। আর এভাবেই তিনি নির্দিষ্ট কোনও মরশুম ছাড়াই প্রায় ৫ হাজার আম সংগ্রহ করতে পারেন।
আরও পড়ুন - টকজলের বদলে পাকা আমের কাথ! অভিনব আম-ফুচকার বহরে চোখ কপালে উঠবে আপনারও
এমন অদ্ভুত পদ্ধতির কারণেই এই বিশেষ আমটি পাকে শীতকালে। ওই সময় পাকার মূল সুবিধাটি হল, বাতাসে সেইসময় বিশেষ পোকামাকড়ের উৎপাত থাকে না। ফলে কোনো কীটনাশক ছাড়াই দিব্যি ফলন হয়। তাছাড়া শীতকালে ফল তোলায় তাকে শ্রমিকের সংকটেও পড়তে হয় না। অথচ ভরা মৌসুমে পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় জাপানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কৃষিসহ প্রায় সব বিষয় বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও চাষ করার শুরুর সময় তিনি নিজেও জানতেন না যে একদিন এই আমি বিশ্বব্যাপী নাম করে উঠতে পারবে। প্রথম কয়েক বছরের ফলন সফল হওয়ার পর তিনি এই আমের ব্র্যান্ডকে ‘হাকুগিন নো তাইয়ো’ হিসাবে ট্রেডমার্ক করেন, যার বাংলায় অনুবাদ করলে হয় ‘তুষারের মধ্যে সূর্য’। বরফের দেশে এই সোনালী ফলকে এভাবেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তিনি।
সাধারণ আমের তুলনায় এতে প্রায় ১৫ ডিগ্রী ব্রিক্সের উচ্চ চিনির স্বাদ পাওয়া যায়। ফলে এটি মুখে দিলেই মাখনের মতো মসৃণ একটি খাবারের সমান স্বাদ উপভোগ করা যায়। নাকাগাওয়ার এই বিশেষ আমের গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছেন এশিয়ার সেরা মহিলা শেফ নাসতুকো সুজি সহ আরো অনেক নামজাদা রেস্তোরাঁর শেফেরাই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই কেক তৈরির সময় এই বিশেষ আম ব্যবহার করেন। শুধু জাপান নয়, বাইরে বদেশেও প্রচুর গ্রাহক রয়েছে এই আমার। পাশাপাশি হংকং-এর সিটি’সুপারের মতো উচ্চমানের খুচরো বিক্রেতাদের কাছেও এই আম পাঠানো হয়।