ওয়াও মোমো || গ্যারেজ থেকে শুরু, আজ কোটির ব্যবসা, অসাধ্যসান যে পথে
নেপালের কলকাতা নাকি কলকাতার নেপাল! কলকাতা-নেপাল মিলেমিশে একাকার। আর এই দুইয়ের মিলনের নেপথ্যে রয়েছে সাগর।কেমন রহস্যের গন্ধ আসছে না! এতকথা শুনে মনে মনে নিশ্চিত ভাবছেন তবে কি নতুন করে কোনও ভূ-আন্দোলনে মিলে গেল এই দুজায়গা? না না তেমন এখনও ঘটেনি। আসলে এক্ষেত্রে মিলনের মাধ্যম হল একটি খাবার। ময়দার আস্তরণের মধ্যে মাংস বা সবজির পুর দিয়ে তৈরি এই খাবারকে আমরা 'মোমো' নামেই চিনি।এটি আদতে নেপালের সবচেয়ে চেনা খাবার হলেও এই মুহূর্তে কলকাতাবাসীর প্রিয়তম। কলকাতায় এই মোমোকে জনপ্রিয় করে তোলার অন্যতম কান্ডারী যিনি তাঁর নাম সাগর দারিয়ানি। সাগর 'ওয়াও মোমো'- র প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার। কলকাতার মোমোপ্রেমীদের কাছে 'ওয়াও মোমো' নামটাই যথেষ্ট। তবে একদিনে গড়ে ওঠেনি ইমারত। তিলে তিলে এক সাধারণ গড়ে তুলেছেন এই ব্র্যান্ড। আজ যারা সামান্য পুঁজি নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে পারেন ওয়াও মোমোর যাত্রাপথের বর্ণনা জানলেই।
শুরুর দিন
দেশভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে কলকাতায় চলে আসেন চার্টাড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হরকিষণ দারিয়ানি।কলকাতায় সিন্ধি সংগঠনের সূত্রে দারিয়ানি পরিবারের সাথে আলাপ অর্জনদাস রেলওয়ানির। সৌহার্দের সম্পর্ক আত্মীয়তার বন্ধনে পরিণত হয় রেলওয়ানি পরিবারের মেয়ের সাথে দারিয়ানি পরিবারের ছেলের বিয়ে হলে।এই সম্পর্কের জেরেই ১৯৮৮ সালে জন্ম হয় সাগরের। ছোট থেকেই নাকি শিল্পপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সাগর।
কলকাতায় দারিয়ানি পরিবারের রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসা। পরিবারিক এই ব্যবসাতেই নাকি সেলসের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন সাগর।সেই স্কিল নাকি তাঁকে এখনও সাহায্য করে বলেই মত সাগরের। ছোটবেলায় দোকানে কেউ শার্ট কিনতে এলেই তাঁকে প্যান্টও কিনিয়ে দিতেন সাগর। তাঁর কথায়,' আমি তখন মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। সুতরাং ছোট বয়সেই আমি পাকা সেলসম্যান হয়ে উঠেছিলাম '।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কমার্সের ছাত্র সাগর কোর্সের শেষ পরীক্ষায় মোক্ষম বুঝেছিলেন তাঁর দ্বারা অঙ্ক হবে না। তাই ক্যাট দিয়ে এমবিএ বা চার্টার অ্যাকাউন্ট হওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। পরীক্ষার রাতগুলিতে বন্ধুরা একসাথে পড়তে বসলে প্রায়ই রাত হয়ে যেত। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তো খিদেও। ফলে অনেক সময়ই রাতের দিকে বন্ধুরা মিলে স্যান্ডুইচ, চাউমিন বানাতেন। সেই দলেই এক নেপালি বন্ধু বিনোদকুমার হুমাগাই মোমো বানাতে পারতো। পরে সেই বিনোদকে সাথে নিয়েই ওয়াও মোমো খোলেন সাগর।
সাগরের কথায় মানুষ যদি পিৎজা, বার্গার এতো ভালোবেসে খায় তবে মোমো কেন নয়? এই ভাবনা থেকেই ২০০৮ সালে ওয়াও মোমো-র সাথে পথচলা শুরু করেন সাগর এবং বিনোদ।
তিলে তিলে বেড়ে ওঠা
মাত্র ৩০ হাজার টাকা দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন তাঁরা। বিজ্ঞাপন বা রঙিন লিফলেট ছাপানোর পয়সাই ছিল না। শুরুর দিকে যাদবপুরের বাড়ির গ্যারেজ ঘরই ছিল দোকান। সাউথ সিটির স্পেন্সরসে ছয় বাই ছয়ের একটা জায়গা পেতেই সেই ব্যবসা আমূল বদলে গেল।২ হাজার টাকার ব্যবসায় টার্নওভার বেড়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ টাকা। কিছু দিনের মধ্যেই তা হয়ে যায় ১১ লক্ষ টাকা।তবে শুরুর দিনগুলিতে মলে আসা লোকদের কাছে গিয়ে একবার তাঁদের মোমো খাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন সাগর। তাঁর কথায়, যে সময় ব্যবসা শুরু করেছিলাম তখন এক্সাইড মোড়ে ১০ টাকা প্লেট মোমো বিক্রি হতো। আমরা ৪৫ টাকা প্লেট নিয়ে এলাম। তবে আমরা বিশ্বাসী ছিলাম যে আমাদের মোমোর স্বাদ একবার পেলেই মানুষ এসে দোকান থেকে মোমো কিনে খাবেন।আমরা ভালো জিনিস দিতেই আর ভাবতে হয়নি '।
এই মুহূর্তে কলকাতা শহরের বুকে ৮০ টি আউটলেট রয়েছে ওয়াও মোমোর। কলকাতার বাইরে ১৭ টি শহরে ৩৮৩ টি ঠিকানায় পৌঁছে গেছে এই সংস্থা।২০১১ সালে ব্যাঙ্গালোরের ফোনিক্স মলে আউটলেট খোলেন তাঁরা।সেই ছোট্ট দোকানই চেন্নাই ও পুণের মত শহরে বাজার ধরতে সাহায্য করেছিল এবং এর মধ্যে দিয়েই আমরা মলভিত্তিক আউটলেট শুরুর দিকে পা বাড়িয়েছে। শুধু আউটলেটের সংখ্যা বেড়েছে তেমন নয় ভিন্নরুপে মানুষের সামনে মোমোও নিয়ে এসেছেন তাঁরা। ১৭ রকমের প্রায় ১১ স্বাদের মোমো রয়েছে দেশের মোমোপ্রেমীদের জন্য। পাশাপাশি বাজারে এসেছে ' ওয়াও চায়না' ব্র্যান্ড।এই আউটলেটগুলিতে পাওয়া যায় চাইনিজ খাবার। সাগরের কথায়,'খাওয়ারটা ভালো বানানোই আমাদের মূল মন্ত্র'।
ব্যবসায় লগ্নি
সবকিছু ঠিকঠাক চললেও সাগর যেভাবে এই সংস্থাকে কল্পনা করছিলেন সেই রূপ দিতে পারছিলেন না। সমস্যা দূর হয় ২০১৫ সালে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট নেটওয়ার্কের থেকে পাওয়া ১০ কোটি টাকায়। অ্যাঞ্জেলের লগ্নি এই সংস্থাকে লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে সাহায্য করেছিল।২০১৭ সালে ডিমনিটাইজেশনের সময় ব্যবসা খানিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছিল। তবে সেই সময় লাইটহাউস ফান্ড এই সংস্থায় অর্থলগ্নি করে।২০১৯ সালে টাইগার ইনভেস্টমেন্টের মত সংস্থা এই সংস্থায় লগ্নি করলে ওয়াও মোমো বিদেশের বাজারেও ছড়িয়ে পড়ে।
কঠিন সময় পেরিয়েছে ওয়াও মোমো
২০১৭ সালে ডিমনিটাইজেশন হলে বিক্রি কমে যেতে শুরু করে। মানুষ সারাদিন ব্যাংকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে, দোকান ফাঁকা। সাগরের মতে, 'আমরা সে সময় মার্কেটিং ও ব্যবসার পদ্ধতি বদলে ফেলি। সেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই মানুষের থেকে অর্ডার নিয়ে সেখানেই ডেলিভারী করি।এই অন্যরকম ভাবনাই প্রতিকূলতাকে সুযোগে বদলে দেয়। অন্যান্য কোম্পানিগুলি তখন ক্ষতির পরিমাণ অনুসন্ধান করছিল কিন্ত আমরা লাভ করেছি '।
২০১৯ সালে করোনা নিয়ে এল সবথেকে কঠিন সময়। সাগরের কথায়,' ২০১৯ এর মার্চ মাস অবধি সবকিছুই ভালোভাবে এগোচ্ছিল, একদম বলিউড সিনেমার মত।কিন্তু করোনার ধাক্কায় প্রথম একমাসেই ৬ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় কোম্পানি। এগারো বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করলেও ক্ষতি হয়নি কখনই।তাই আমাদের কাছে এই ক্ষতির পরিমাণ ছিল মারাত্মক'। কিন্তু হোম ডেলিভারি বাঁচিয়ে দেয় এই সংস্থাকে। মহামারী পরিস্থিতিতেও মাসে ৮ লাখের বেশি হোম ডেলিভারী করেছে ওয়াও মোমো।
সাগরের মতে, এই অভূতপূর্ব সাফল্যের কৃতিত্ব আসলে ওয়াও মোমোর প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলির। অন্যান্য সংস্থা তাঁদের ব্র্যান্ড তৈরিতে যতটা গুরুত্ব দেয় ততখানি গুরুত্ব দেয় না পণ্যের গুণমানের ওপর। নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে সাগর বলেছেন,' খাবারের জিনিস প্রস্তুত সংক্রান্ত ব্যবসা করতে চাইলে ক্রেতাই হল সর্বশেষ কথা এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাই তাঁদের চাহিদার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে'।