অপমানিত হতে পারো, তবু হেরে যেয়ো না
কেউ এসে বাড়ি বয়ে অপমান করে চলে গেল বলে তুমিও গড়িয়াহাটের মোড়ে তরুণ ছেলেটির পিছুডাক উপেক্ষা করে গেলে। সামান্য একটা সার্ভে করত হয়তো! ওয়াটার পিউরিফায়ার বা ধোঁয়াহীন চিমনি নিলে তোমার জীবন কতখানি বদলে যেতে পারে, একাত্ম আন্তরিকতা ও যত্নে বোঝাত তোমাকে। তুমি দেখলে না। পায়ে মাড়ানো ফুচকার শালপাতার মতোই তাই ছেলেটির চকচকে চোখের আশার দিকে ছুঁড়ে দিলে তোমার দৃষ্টিবিহীন অবজ্ঞা। গোলপার্কের বুড়ো ভিখিরির দিকেও তাকালে না চোখ তুলে। তাকালে দেখতে পেতে কতখানি মায়া নিয়ে তার জ্বলাপোড়া মাংসপিণ্ডের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে পরম মমতায়। অথচ রি রি ঈর্ষায় শুকনো খড়ের মতো নিজস্ব হিংসার আগুনে ঝাঁপ দিতে দিতে ঠিক দেখে নিলে প্রাক্তন প্রেমিকের কোনো হবু প্রেমিকার ছবিতে ছেয়ে গেছে কিনা ঢাকুরিয়ার হোর্ডিং! ব্রিজের পাশের ছাতিমগন্ধী হাওয়ার অনুপস্থিতিও তোমায় বিস্মিত করলে না আজ। অনেক অনেক দিন পরে ঘরে ফিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে হল না নিজেকে। না থাকা সোফায়, আলমারিতে, খাটের পাশে, ড্রেসিং টেবিলে গুছিয়ে থাতিয়ে রাখলে না তোমার ভাঙা ভাঙা কাচের গুঁড়োগুলোকে। যতখানি সূক্ষ্ম হলে চোখের আড়ালে মুহূর্তে খেয়ে ফেলা যায় তিলবিন্দু রক্ত, ততখানি সূক্ষ্মতা থেকে সরে গেছ বহুকাল। অপমানকারীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাগশেষে পেরেছ তার তাকানো নামিয়ে দিতে। তবু শান্ত হতে তো পারনি! সেই যদি বিনা বাক্যব্যয়ে নতমুখ মেনে নিলে তার কথা, তবে কেন গেলে অমন শরীর উত্তপ্ত করা সীমাহীন বাদানুবাদে! এর চেয়ে যাকে প্রতিপক্ষ ঠাওরালে, তারই দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দেওয়া সহজ হত না কি? এই তুমিই তো প্রার্থনার মতো সহজ বিশ্বাসে একদিন ভাবতে প্রতিটা মানুষের কিছু নিজস্ব সময়ের আয় থাকবে। অব্যয়, অনন্য সময়। মানুষটি থাকবে সবারই সঙ্গে। কিন্তু মাঝে মাঝেই সরে যাবে ক্ষণিকের সঞ্চয়ে। একান্ত এক কোণ। বিশ্ববিদ্যার মুকুট ছাদের বারান্দার কোণটুকু যেন। আশেপাশেই একটা দুটো মানুষ থাকবে, যারা বুঝবে এখন তোমার ভিড় জমানোর সময়। আড়াল করে রাখবে তোমার চেয়ে থাকাটুকু। দিনের শেষে তুমি জানবে প্রিয় মুখের হাসি শুনলে, একলা থাকার দিনেও তোমাকে ঘিরে ভিড় হয়ে যায়। এখনও। অথচ সে ভিড়ের মাঝে দুধভাত বয়সের হাতে আঁকা ঘড়ির ছাপ আর নেই। ফিরবেও না কখনও!
নিজেকে যেমন তুমি ভাব, যখন বুঝতে পার, কাঁটা সরে গেছে সেই ঘর থেকে, অদম্য বমনেচ্ছায় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে আসে? ডানা ঝাপটায় ঝড়ে ভাঙা শালিখের মতো! একজন উড়ে গেছে বলে সমস্ত মানুষের চোখে, সে আজ হয়েছে যেন অভিশাপের মতো। কপালে আঙুল ঠেকানো কোনো প্রার্থনায় অধিকার নেই আর তার। পোকা খুঁটে খুঁটে সমস্ত জীবন শুধু পেটের দায়িত্বভার নেওয়া। অথচ শান্তি নেই। শান্তির চিহ্নমাত্র নেই। পরিবর্তে চারপাশে শুধু মশা আর ছারপোকাদের টহলদারি। তোমারই রক্ত। তবু তাদের মিলিত অগ্রগতিতে টেনে এনে ফেলে দেয় বাইরে। বুঝি, মৃত মশাদের প্রতি অনুকম্পায় নয়। পুরোনো ক্ষতের উপর সদ্যজা রক্তছাপ এখনও তেমনই ফিনকি তোলে পাঁজরায়। আয়নায় দেখে নাও চেনা দাগেদের বেড়ে যাওয়া মৌজা, শালিজমি, বাস্তুভিটে! দাগের আবার অতীত-ভবিষ্যৎ কী? যে দেখে সে ঘুরে আসে অনুমানে তার নিজস্ব যন্ত্রণার দেশ! তোমারই ব্যথা তখন যেন মন্ত্রীর ছেলের গাড়ি। চলে যায় কৃষকদের বুকের মানচিত্রকে ফালাফালা করে। কিংবা তোমার কোনো ক্ষত, সদ্যপোড়া মেয়েটার ভেতরে ঢুকে আরেকবার টেনে আনে চুল্লির আগুন। বাবাকে দাহ করে শূন্য ঘরে ফিরল যে ছেলে, তোমার আগুন তার মুখেও সিগারেট ধরিয়ে দেয়। আগুন। আগুন থেকে আসে ধোঁয়া। ধোঁয়া থেকে আসে চোখ জ্বালা। কাঠপিমড়ের জ্বালা। বিষ আছে না! হোক না সামান্য। তবু যন্ত্রণার ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়ার আনন্দে দাঁত কিড়মিড়ানি আর হাসি। এই চকচকে চোখ দেখলে তুমি ভয় পেতে না! সত্যি বলছি তোমার সঙ্গে কুস্তি করে তো পারব না। ছেলেবেলার রূপকথা আর সুকুমার রায়ের দেওয়া অব্যর্থ ওষুধ আছে। তাই আজও হাসি। শহর কাঁপানো হাসি। বাইক চেপে পাশ দিয়ে যায় ছেলেগুলো। ইশারায় ডাকে আর কাঁধ থেকে টেনে নেয় ওড়নার টান। সেফটিপিন ঘুরে গিয়ে কাঁধের চামড়ায় টোকা দেয়। নাহলে কি বুঝতে বলো, তোমার গোপনের দায়িত্ব তার এতখানি! কষ্টের দিনে সেফটিপিন দিয়ে নাক ফুটিয়েছ কখনও নিজে হাতে? বা ফোটাবে বলে ভেবেছ নিজের পায়ে? পায়ের তলায় তিল থাকলে বিদেশযাত্রা! আর ক্ষত থাকলে? তবু, সূর্যের মুখে তাকিয়ে কেঁদো না। রাতের মুখে বুলিয়ে দাও আগুন। রাতের মুখাগ্নি হলে তোমার লেখায় যেন যন্ত্রণারা তর্পণ পায়। ঘট ফেলে দিলে পিছনে তাকাতে নেই আর। বন্ধুর কানে কানে মা বলে, খুকু কি পিছন ফিরে তাকায়? দৃষ্টিতে উত্তর বেঁধে বন্ধু বলে, যা পাচ্ছিস সবই এখন সময়ের দোকানে ধার। হাসি আর সারা শহর ছাতিমের গন্ধে ভেসে ওঠে। হাঁটি আর স্রোতের মতো পাশ দিয়ে ভাসে খেলনার সংসার, ছেঁড়া বই আর শোলার থালা। হাসি আর মনে করি, নতুন কোনো পথের বাঁকে ছাতিমগন্ধী হাওয়ার আবিষ্কার, যতখানি হাসি মাখায় ওষ্ঠরঞ্জনে, তার চেয়ে এখন কী আর বেশি পেতাম বলো তোমার সান্নিধ্যে!
তাই এভাবেই দিন যাবে। লেখার একটা দুটো অক্ষরে যন্ত্রণা গুঁজে দিতে দিতে ঠেকনা দিয়ে রাখা হাসিমুখগুলোর দিকে। কী আর? এরকম আরও ক'টা রাত তো আয়নায় প্রবোধ দিতেই যাবে। আত্মহত্যার রাস্তা তো খুব সোজা। অধিক জ্ঞানের দোষে বাছতে পারবে না। ততদিন খুন করো! খুন করে চলো। যদি কোনো সঙ্গী পাও আততায়ী রাস্তায়, তোমার সমস্ত শাড়ি তাকে বোলো... অচেনা কোনো ফুলওয়ালিকে দিয়ে দিতে। আমার জন্য কেউ কি একটা ছাতিমগুচ্ছ রাখবে! হাতে করে আনবে আমার দিকে?
এসবই আসলে জারজ মেয়ের এপিটাফ! জন্মদিন এলে কেউ যেন ভাবে তোমারই কথা ভেবে, আর সে কখনও কোনো কবিতা লিখবে না!
হাসতে দাও আমায় অথবা আমায় শক্তি দাও নিঃশব্দে চলে যাবার মতো...