মা কালীকে বলতেন 'গুড মর্নিং ম্যাডাম', বর্ণময় চরিত্র ছিলেন ডিরোজিওর শিষ্যরা

তাঁদের কার্যাবলি আপাতদৃষ্টিতে নৈরাজ্যবাদী মনে হলেও বাংলার সমাজজীবনে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।

ভারতের ইতিহাসে উপেক্ষিত এক নায়ক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এন্টালি অঞ্চলে এক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অবিশ্বাস্য প্রতিভাবলে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র ১৭ বছর বয়সেই হিন্দু কলেজে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি একাধারে কবি, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোলেন নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল দল। প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলোর বিরুদ্ধে ছিল তাঁদের আন্দোলন। এই আন্দোলন নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত ছিল।

 

ডিরোজিওর উদ্যোগে প্রকাশিত 'ক্যালাইডোস্কোপ' পত্রিকা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল। এছাড়া তিনি 'হেসপেরাস' ও 'ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট' নামে দু'টি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মানিকতলায় 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' নামে একটি বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন, এটির উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মনে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানো। 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন'-এর মুখপত্র ছিল 'এথেনিয়াম'। এতে স্ত্রীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তাঁর ছাত্ররা তাঁর সমবয়সিই ছিল প্রায়।

 

ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়), রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব প্রমুখ। তাঁর প্রত্যেক ছাত্র কীর্তিমান এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা, স্বদেশপ্রেম, যুক্তিবাদ প্রভৃতি থাকা সত্ত্বেও ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারেননি, তাঁদের আধুনিকতা দেশবাসীর কাছে 'উচ্ছৃখল', 'সমাজবিচ্ছিন্ন উগ্রবাদী' ইত্যাদি আখ্যা পেয়েছিলেন তিনি। এর পিছনে কারণও অনেক ছিল। ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতেন। তাঁরা ব্রাহ্মণদের উপবীত ছিঁড়ে ফেলতে বলতেন, নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করতে বলতেন, পুরোহিতদের লক্ষ‍্য করে চেঁচিয়ে বলতেন, 'আমরা গোমাংস খাই', কালীঘাটের মন্দিরের সামনে গিয়ে মা কালী কে উদ্দেশ্য করে বলতেন 'গুড মর্নিং ম্যাডাম'। তাঁরা গঙ্গাজলের পবিত্রতা মানতেন না। এসব নানা কারণে সমাজ তাঁদের ব্রাত্য করে রেখেছিলে।

 

আরও পড়ুন: এখন ভূতের ডেরা! রায়পুর রাজবাড়ির ইতিহাস আজও বিস্মিত করবে

 

ডিরোজিওর অনুগামীদের হিন্দুধর্ম-বিরোধী বিভিন্ন মতামত ও কার্যকলাপ হিন্দুসমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সমাজসংস্কারের বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব ৬-১ ভোটে অনুমোদিত হয়। আসল কথা, প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীল হিন্দুদের চাপে হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে চাকরি থেকে পদচ্যুত করেন। ডিরোজিও ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বহিস্কৃত শিক্ষক। বহিস্কৃত হওয়ার ফলে ডিরোজিও চরম অর্থকষ্টে পড়েন এবং এর কিছুদিন পরেই রোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহামানব ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ২৩ ডিসেম্বর মাত্র ২২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। শোনা যায় শোভাবাজারের রাজা ডিরোজিওকে নিমন্ত্রণ করে অত্যন্ত অপমান করেছিলেন এবং অভুক্ত অবস্থায় একমাত্র বোনের হাত ধরে ডিরোজিও সেখান থেকে ফিরে এসেছিলেন। এর কারণ ছিল, সতীদাহ থেকে একটি মেয়ের জীবন বাঁচানো। খাদ্যাভাবে, বিনা চিকিৎসায় ,অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে ডিরোজিও প্রাণ ত্যাগ করেন।

 

তিনি ঈশ্বর মানতেন না, কখনও গির্জায় যেতেন না। গির্জা ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধ অভিমতের কারণে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করতে বাধা দেওয়া হয়, তার ফলে, গোরস্থানের বাইরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ইতিহাস বলে, যখন ডিরোজিও মারা যাচ্ছেন, তখন তাঁর বাসস্থানের বাইরে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছিল। তাঁর বোনের নামেও বদনাম করা হয়, তাঁরই ছাত্র দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে জড়িয়ে। কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা সমাজ তখন বোঝেনি, একজন ইঙ্গ-পর্তুগিজ ছেলে বাংলার কুসংস্কার দূর করার জন্য, জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য কী করতে চেয়েছিলেন। তার বিনিময়ে বিনা চিকিৎসায়, চরম অভাবের তাড়ণায় মৃত্যু বরণ করতে হল।

Henry Louis Vivian Derozio

 

ডিরোজিও ছাত্রদের অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী ও সত্যসন্ধানী হওয়ার পরামর্শ দিতেন। ইয়ং বেঙ্গলের যুক্তিবাদ ভুল ছিল কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু তাঁরা বিভিন্ন কুপ্রথা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান, খ্রিস্টান পাদ্রিদের গোঁড়ামি, স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে সমতাহীনতা, দাসপ্রথা, নারী নির্যাতন, সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণবিধি, মরিশাসে ভারতীয় কুলি প্রেরণ, ভারতীয় বিচার ও পুলিশি ব্যবস্থা, বেগার খাটানো, কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও অন্যান্য বিষয়ে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার ছিলেন। তবু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কোনও সংগঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। তাঁদের কিছু চিন্তাধারা এবং কর্মসূচি ছিল নেতিবাচক। হিন্দু ধর্ম বা পাশ্চাত্য সভ্যতা- কোনওটি সম্পর্কেই তাঁদের কোনও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না বলে মত রজনীপাম দত্তর মতো মার্কসবাদী ইতিহাসবিদদের, একই সঙ্গে অনিল শীল 'গজদন্ত মিনার'-এর বাসিন্দা বলে কটাক্ষও করেছেন এঁদের। ফলে, তাঁদের আন্দোলনের কোনও জনসমর্থন ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক বা যোগসূত্র তৈরি হয়নি। অভিজাত পরিবারের কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরা বক্তৃতা ও পুস্তিকার মাধ্যমে তাঁদের আন্দোলনকে সচল রাখতেন। আন্দোলনের ভালো দিক থাকা সত্ত্বেও সুচিন্তার অভাবে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন অকালে বিনষ্ট হয়। ডিরোজিওর মৃত্যুর পরেও তাঁর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ 'ইয়ং বেঙ্গল'-এর ছাত্রদল পরবর্তীকালে ডিরোজিওর আন্দোলনকে সচল রাখতে চেষ্টা করেন। ভারতীয় 'নবজাগরণ'-এ এঁরা সকলে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। ডিরোজিওর অনুগামীরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মত প্রকাশ করে তাঁদের মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পত্রিকা হল: 'জ্ঞানান্বেষণ', 'এনকোয়ারার', 'বেঙ্গল স্পেকটেটর', 'হিন্দু পাইওনিয়ার' প্রভৃতি। ডিরোজিওর ছাত্রগণ কয়েকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, 'সাধারণ জ্ঞানোপার্জনী সভা' (১৮৩৬), এছাড়া রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর জন্য তাঁরা ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে 'বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন।

 

দেশের দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক-শ্রমজীবী মানুষের জন্য তাঁরা কোনও আর্থিক নীতির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেননি।কৃষক ও শ্রমজীবীদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা ছিল না, এই বিষয়ে তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ইয়ং বেঙ্গল সদস্যরা সীমাহীন প্রগতিশীলতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু এতটা প্রগতি সাদরে গ্রহণ করার মতো পরিবেশ তখনও সমাজে তৈরি হয়নি। অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক পরিকাঠামো, সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, ঘরে ঘরে বাল্যবিধবা- এইরূপ কুসংস্কার এবং ভয়ংকর সময়ের মধ্য দিয়ে তখন দেশ চলছে। তাই তাঁদের বক্তব্য জনসমর্থন লাভ করেনি ডিরোজিওর মৃত্যুর পর এই আন্দোলনের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে পড়লে, তাঁর অনুগামী বেশ কিছু যুবক আবার চিরাচরিত ঐতিহ্যে ফিরে যান। অনেকেই সরকারি চাকরি অথবা ব্যবসায় মন দেন। তবে একথা সত্য, ডিরোজিওর ছাত্রগণ দিকপাল ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের কাজকর্মের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে সমকালে এবং পরবর্তীকালে নানা মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। অনেকের মতে, তাঁরা ছিলেন উচ্ছৃঙ্খল,আবার অনেকে তাঁদের মধ্যে 'নবজাগরণের ঊষালগ্ন' দেখতে পেয়েছিলেন। ডেভিড কফ তাঁদের 'ভ্রান্ত পুঁথিপড়া বুদ্ধিজীবী' বলে অভিহিত করেছেন। সুমিত সরকার বলেন যে, "সামান্য বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের উপর এর প্রভাব ছিল শূন্যের কোঠায়।" নানা সমালোচনা সত্ত্বেও জাতীয় জীবনে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর অবদান কখনও অস্বীকার করা যায় না। তাঁদের কার্যাবলি আপাতদৃষ্টিতে নৈরাজ্যবাদী মনে হলেও বাংলার সমাজজীবনে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।

 

More Articles