এপ্রিলেই নির্বাচন! জল্পনার অবসান ঘটিয়ে যে বার্তা দিলেন ইউনূস
Muhammad Yunus : ভাষণে তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। মাঝেমাঝে এমন কথাও শুনেছি যে এ বন্দর নাকি বিদেশিদেরকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বহুবার ওই দেশের জনগণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দাবি তুলেছে। চাপের মুখে পড়েই অন্তর্বর্তী সরকারকে আশ্বাস দিতে হয়েছে। অবশেষে আজ (৬ জুন শুক্রবার) বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় জানিয়েছেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের যে কোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। ভাষণে আর কী কী বিষয়ে বলেছেন ইউনূস?
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ছিল বিএনপি। তবে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছিলেন বারবার। শুক্রবারের ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ দেবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে এর আগে বহুবার প্রশ্ন তুলেছে দেশটির অন্যতম প্রধান দল বিএনপি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। গত ২ জুন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে এই নিয়ে বৈঠকও করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, "আমরা এমন নির্বাচন চাই যা দেখে অভ্যুত্থানের শহিদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে, তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরণীয় থাকুক।" প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, "আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।"
তাঁর কথায়, "এখানে মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে যতবার গভীর সঙ্কটে পড়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে," বলেন তিনি।
মায়ানমার নিয়ে ভুল তথ্য
প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেছেন, মায়ানমারকে মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। দেশবাসীকে ভুল তথ্যে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।" তিনি আরও বলেন, "আমরা লক্ষ্য করেছি রাখাইনের জন্য বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে দিয়েছে বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, এটি সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প।" তাঁর কথায়, "যারা অসত্য কল্পকাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম,"।
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে গুঞ্জন
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিদের হাতে দেওয়া হচ্ছে বলে গুঞ্জন শোনা যায়। এতে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। দেশজুড়ে সমালোচনা আন্দোলন-বিক্ষোভ হতে দেখা গিয়েছিল। এই নিয়েও আজ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেন, "চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। মাঝেমাঝে এমন কথাও শুনেছি যে এ বন্দর নাকি বিদেশিদেরকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।" চট্টগ্রাম বন্দরকে "বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড" বলে উল্লেখ করে তিনি ব্যাখ্যা করেন, "বর্তমানে এই হৃৎপিণ্ড অতি দুর্বল। এখন যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় তাকে রেখে দিলে আমাদের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই হৃদপিণ্ডকে বড়ো করতে হবে। মজবুত করতে হবে।" তাঁর কথায়, "অভিজ্ঞদের সাহায্য লাগবে"।
প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, "আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তারা বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তারা ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা-সহ বিশ্বজুড়ে বন্দর পরিচালনা করে। তাদের কাজ বন্দর ব্যবস্থাপনা করা, আমাদের লক্ষ্য হলো বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া।" তিনি এও বলেন যে, "আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ৩১ সালের মধ্যে আমরা বন্দরের কাজ শিখে ফেলি এর পরবর্তী ৫ বছরে অর্থাৎ ৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর এই কোম্পানিগুলো চালায় তাদের বহু বন্দর এই বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে।"
সংস্কার
ক্ষমতা পাওয়ার ১ মাসের মধ্যেই সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিস, বিচার-বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার সব মিলিয়ে ৬টি আলাদা কমিশন গঠন করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি সংস্কার কমিশন (স্বাস্থ্যবিষয়ক, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকারিক, নারী বিষয়ক) যুক্ত করা হয়েছিল। এই ১০টি কমিশনের কোথায় কী সংস্কার হওয়া প্রয়োজন সেই নিয়ে কাজও শুরু হয়েছিল। শুক্রবারের ভাষণে তিনি বলেন, মোট ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে এক হাজারেরও ওপর সংস্কার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, "মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে ৫৪ টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯ টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।"
হত্যাযজ্ঞের বিচার
অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, শুধু জুলাই-অগস্টের হত্যাকাণ্ডেরই নয়, গত দেড় দশক যে অপকর্ম করেছে হাসিনা সরকার সে সব কিছুর বিচার হবে। শুক্রবারের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেন,
হাসিনা সরকার পতনের পর তাদের পক্ষের ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। তাঁর দাবি, "গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে"। তিনি জানান এই নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। এরপর তিনি বলেন, "ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বিচার পর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এতে করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে।" আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি 'জুলাই সনদ' প্রস্তুত করে দেশবাসীর সামনে আনা হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।
পদে পদে বাধা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নানামুখি অপপ্রচারে লিপ্ত।" তাঁর কথায়, "তারা সবসময় চাইবে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জাতীয় ঐক্যের শক্তিকে পরাভূত করতে, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে লাইনচ্যুত করতে এবং বাংলাদেশকে পুনরায় করায়ত্ব করতে।" তিনি আরও বলেন, "আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। এখন আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে। পরাজিত শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা ওত পেতে বসে আছে আমাদের ছোবল মারার জন্য, আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য। আমরা তাদের কিছুতেই এই সুযোগ দেব না"।
সুষ্ঠভাবে দেশটির নির্বাচন-সহ বাকি প্রতিশ্রুতি পূরণ হবে কিনা সেটাই এখন দেখার।