প্রতি ৩ জনে ১ জন ডাক্তারই অনিরাপদ! হাসপাতালের ভয়াবহ পরিস্থিতি ফাঁস সমীক্ষায়
Doctors Unsafety in Hospitals: কিছু ডাক্তার জানিয়েছেন, হাসপাতালে এতই অনিরাপদ বোধ করেছেন তারা যে, আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার কথাও ভেবেছেন।
কর্মক্ষেত্রে মহিলারা নিরাপদ কিনা এই সংক্রান্ত সমস্ত বিতর্কের মাঝে অবাক করা এক সমীক্ষা প্রকাশ্যে এসেছে। IMA অর্থাৎ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এই সমীক্ষার উত্তরদাতাদের এক-তৃতীয়াংশই, যাদের বেশিরভাগই মহিলা, তারা জানিয়েছেন রাতের শিফটের সময় প্রচণ্ড অনিরাপদ বোধ করেছেন তারা। যথেষ্ট ভয় পেয়েছেন। এতটাই ভয় যে কেউ কেউ নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার প্রয়োজনও অনুভব করেছিলেন। এই সমীক্ষা জানাচ্ছে, ৪৫% উত্তরদাতা জানিয়েছেন রাতের শিফটের সময় 'ডিউটি রুম' পাননি তারা। আরজি কর হাসপাতালে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার পর ডাক্তারদের রাতের শিফটের সময়কার নিরাপত্তাজনিত সমস্যার মূল্যায়ন করতেই ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অনলাইনে এই সমীক্ষাটি করে।
আইএমএ বলছে, ৩,৮৮৫টি প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন তারা। এটি এই বিষয়ে ভারতের বৃহত্তম গবেষণা বলেও দাবি করেছে আইএমএ। কেরল স্টেট আইএমএ-র রিসার্চ সেলের চেয়ারম্যান ডঃ রাজীব জয়দেবন এবং তাঁর দল সমীক্ষার ফলাফলগুলিকে একত্রিত করেছেন। আইএমএ-র কেরল মেডিকেল জার্নালের অক্টোবর সংখ্যাতে প্রকাশিত হবে এই সমীক্ষাটি।
আইএমএ জানাচ্ছে, ২২টিরও বেশি উত্তরদাতারা এই সমীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের কম এবং এদের মধ্যে ৬১ শতাংশই ইন্টার্ন বা স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ। সমীক্ষায় মহিলাদের সংখ্যা ৬৩ শতাংশ। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, অনেক ডাক্তারই অনিরাপদ (২৪.১ শতাংশ) বা খুব অনিরাপদ (১১.৪ শতাংশ) বোধ করেছেন। মোট উত্তরদাতাদের এক-তৃতীয়াংশই অনিরাপদ বোধ করছেন, এদের মধ্যে মহিলারাই সংখ্যায় বেশি।
আরও পড়ুন- “আপনার মেয়েকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে এসেছি”, ধর্ষিতার বাবা-মাকে ৩ বার ফোনে কী কী বলা হয়?
২০-৩০ বছর বয়সী ডাক্তারদের মধ্যেই এই অনিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে এবং এই ডাক্তারদের মধ্যে বেশিরভাগই ইন্টার্ন এবং স্নাতকোত্তর পাঠরত। ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, রাতের শিফটের সময় তারা ডিউটি রুম পাননি। যারা ডিউটি রুম পেয়েছেন তারা তুলানামূলক বেশি নিরাপদ বোধ করেছেন।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ভিড়, গোপনীয়তার অভাব এবং দরজায় তালা না থাকার কারণে ডিউটি রুমও অপর্যাপ্ত। ফলে ডাক্তাররা বিকল্প বিশ্রামের জায়গা খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। যারা আবার ডিউটি রুম পেয়েছেন তারা জানিয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংযুক্ত কোনও বাথরুম পর্যন্ত ছিল না। অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে (৫৩ শতাংশ) এই ডিউটি রুম ওয়ার্ড বা ক্যাজুয়ালিটি এলাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত।
কীভাবে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানো যায় সেই সম্পর্কেও পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল ওই সমীক্ষায়। উত্তরদাতারা জানিয়েছেন, প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা কর্মীদের সংখ্যা বাড়ানো, সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো, সঠিক ও পর্যাপ্ত আলো বসানো, কেন্দ্রীয় সুরক্ষা আইন (সিপিএ) কার্যকর করা, অ্যালার্ম বসানো এবং তালা সহ সুরক্ষিত ডিউটি রুমের মতো মৌলিক সুবিধার ব্যবস্থা হলে খানিকটা নিরাপদ বোধ করবেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন- সন্দীপ ঘোষদের বাড়বাড়ন্তে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র হাত? এই প্রভাবশালীরা আসলে কারা?
সারা দেশের ডাক্তাররাই, বিশেষ করে মহিলারা রাতের শিফটের সময় অনিরাপদ বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন। আরজি করের ঘটনার পরে স্বাস্থ্য পরিষেবার যুক্ত কর্মীদের নিরাপত্তা এবং পরিকাঠামো উন্নত করার বিষয়টিতে তাই বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, নিরাপদ, পরিষ্কার এবং ব্যবহারযোগ্য ডিউটি রুম, বাথরুম, খাবার এবং পানীয় জল নিশ্চিত করার মতো মূলগত পরিকাঠামোর পরিবর্তন অপরিহার্য। রোগীর যত্নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগ এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণও প্রয়োজন যাতে ডাক্তাররা রোগী ও রোগীর পরিবারের থেকে ভয় না পান, যাতে নিজেদের কাজে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে পারেন।
কিছু ডাক্তার জানিয়েছেন, হাসপাতালে এতই অনিরাপদ বোধ করেছেন তারা যে, আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার কথাও ভেবেছেন। একজন ডাক্তার স্বীকারও করেছেন যে, তিনি সবসময় তার ব্যাগে ছুরি এবং গোলমরিচের স্প্রে বহন রাখতেন কারণ তাঁদের ডিউটি রুমটি অন্ধকার এবং নির্জন করিডোরের শেষ প্রান্তে অবস্থিত ছিল। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, রোগী সামলাতে গিয়ে মাতাল বা মাদকে আসক্ত লোকদের কাছ থেকে মৌখিক এবং শারীরিক হেনস্থার শিকার তারা হয়েছেন। একজন ডাক্তার বলেছেন, ভিড়ে ঠাসা ইমার্জেন্সিতে বারবার লোকজনের খারাপ স্পর্শ পেয়েছেন তিনি। বিশেষ করে ছোট হাসপাতালগুলিতে অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে কর্মীও সীমিত এবং নিরাপত্তাও নেই।
মজার বিষয় হলো, বেশ কয়েকজন ডাক্তারই জানিয়েছেন নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে গেলে হাসপাতালের প্রশাসকদের তরফ থেকে উদাসীনতা ছাড়া কিছুই পাননি তারা। সবাই অজুহাত দিয়েছেন যে, সিনিয়ররাও একই রকম পরিবেশে কাজ করেছেন। অথচ এই ধরনের হিংসা মূলত জুনিয়র ডাক্তারদেরই সহ্য করতে হয় কারণ তাঁরাই রোগী সামলান হাসপাতালগুলিতে।
সারা দেশজুড়েই ডাক্তাররা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে হিংসা নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সুরক্ষা আইনের আহ্বান জানিয়েছেন যাতে বিমানবন্দরের মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে হাসপাতালেও। নিরাপদ কাজের পরিবেশ হলে রোগীর যত্নও নিশ্চিত হয়।