যৌন হেনস্থা রুখতে কড়া আইন, আদৌ ভারতকে শিশুর বাসযোগ্য করতে পারল পকসো?
10 Years of POCSO: ২০১২ সালের নভেম্বরে শিশু নির্যাতন আইন প্রণয়ন করা হলে দেখা যায়, শিশু ধর্ষণের প্রতিবেদনের সংখ্যা তার পরের বছরে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে৷
২০১৮ সালের সেই ঘটনা। তোলপাড় হয়েছিল বিশ্ব। এক ঝটকায় নাড়িয়ে দিয়েছিল দেশের সুস্থ বিবেক বোধ। জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলার রাসানা গ্রামে আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন এক মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক ও দুই স্পেশাল পুলিশ কর্মকর্তা। শিশু আসিফাকে এক সপ্তাহ ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করেন, পরে আসিফাকে পাথর ছুড়ে হত্যার আগে আবারও ধর্ষণ করা হয়। পরের বছর কাশ্মীরের কাঠুয়ায় বহুল আলোচিত আট বছরের শিশু আসিফা বানু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় আট আসামির মধ্যে ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় আদালত। ‘তথ্যপ্রমাণ’ না থাকায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এক কিশোর আসামিকে। অপরজনের ‘বয়স নিয়ে বিতর্ক’ থাকায় বিচার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তখনও দেশে পকসো আইন ছিল। অথচ, দেশজুড়ে চলা পকসো মামলাগুলোর বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, আইন ও তার বাস্তবায়নের মধ্যে ঠিক কতটা ফারাক। দেখা যাবে, এই আইনের অধীনে বেশিরভাগ মামলাই বিচারাধীন। অভিযুক্তের খালাস পেয়ে যাওয়ার হার অত্যন্ত বেশি।
দ্য প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস (POCSO) আইন ১০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। শিশুদের যৌন নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত এই আইন। ‘পকসোর এক দশক’- এই শিরোনামে এই আইনকে আজ বিশ্লেষণের সময় এসেছে।
প্রশ্ন ১, এই আইনে কতটা বিচার মিলেছে?
প্রশ্ন ২, এই আইন কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে?
প্রশ্ন ৩, বিচারের দেরি হওয়া কতটা ঠেকানো গিয়েছে?
আরও পড়ুন- হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, ২০১২ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতের ২৮ টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৪৮৬ জেলায় মোট ২,৩০,৭৩০টি পকসো মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। এই মামলার আইন, নথি, প্রয়োগ যাবতীয় সব বিষয় eCourt থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখান থেকেই বকেয়া মামলা এবং আদালতের নির্দেশ সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পকসোর আওতায় ৪৩.৪৪% বিচার শেষ হয়েছে অভিযুক্তকে খালাস করার মধ্যে দিয়ে। দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ১৪.০৩%। এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার চেয়ে খালাসের সংখ্যা সাত গুণ বেশি। পশ্চিমবঙ্গে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার চেয়ে খালাসের সংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি। কেরলে খালাস এবং দোষী সাব্যস্তর মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি নয়। সেখানে মোট মামলার মধ্যে খালাস হয়েছে ২০.৫%। আর দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মোট মামলার ১৬.৪৯%।
কেন পকসো আইন?
পকসো কী এবং এই আইন কেন ২০১২ সালে তৈরি হয়েছিল? ভারতের সংবিধানে শিশুদের অধিকার রক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন আছে। কিন্তু, সেটা যথেষ্ট ছিল না। তার মধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ার শিশু অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে ভারত অংশ নিয়েছে। তাতে স্বাক্ষর করেছে। যেমন, শিশু অধিকারের কনভেনশন, প্রোটোকল অন দ্য চাইল্ড অন দ্য রাইটস কনভেনশন, শিশুদের বিক্রি, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো রুখতে ভারত বাকি বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছে। কিন্তু, সেই পাল্লা দিতে গিয়ে বারবার যথেষ্ট শক্তিশালী আইনের অভাব দেখা গিয়েছে। আর, তাই পকসো তৈরি করা হয়। এরপরও ভারতে শিশুদের সুরক্ষা তলানিতে, রমরমিয়ে চলছে যৌন নিপীড়ন, নিজের পরিমণ্ডলে সুরক্ষিত নয় শিশুকন্যারা।
২০১২ সালের আগে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের জন্য কোনও বিশেষ আইন ছিল না৷ শুধু তাই নয়, যৌন নির্যাতনের বেশ কিছু ধরন, যা শিশু নির্যাতনের সমান, তার কোনও অন্তর্ভুক্তি তৎকালীন আইনে না থাকায় এ বিষয়ে পুলিশের তৎপরতাও ছিল কম৷ আইন হওয়ার পর যে তৎপরতা বেড়েছে এ কথা কি জোর গলায় বলা যায়? সোশ্যাল ট্যাবু, সামাজিক অশিক্ষা, পরিবারেই শিশু নিরাপত্তাহীন হওয়ায় শৈশব ছেয়ে আছে অন্ধকারে। ২০১২ সালের নভেম্বরে শিশু নির্যাতন আইন প্রণয়ন করা হলে দেখা যায়, শিশু ধর্ষণের প্রতিবেদনের সংখ্যা তার পরের বছরে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে৷ লিঙ্গ-নিরপেক্ষ এই নতুন আইনের আওতায় শিশু নির্যাতন ছাড়াও অন্যান্য ধরনের নির্যাতনও রয়েছে৷
শিশুদের যৌন নিপীড়নের লজ্জাজনক রেকর্ড রয়েছে ভারতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটে শিশুকন্যার পরিচিত লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা কোনও নিকটজনের মাধ্যমে। সর্বশেষ যে বছরের তথ্য পাওয়া যায়, সেই ২০১৭ সালে ভারতে ১০,২২১ জন মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে তথ্য সামনে এসেছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউমান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতে কয়েক হাজার শিশু প্রতিবছর ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আর এই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন করছেন শিশুটির খুব পরিচিত মানুষরাই। যৌন নিপীড়নের পরে পুলিশের কাছে কিংবা বিচারব্যবস্থার সামনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে তৃতীয়বারের মতো মানসিকভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে ওই শিশুদের। হিউমান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা প্রাদেশিক সরকারগুলো শিশুদের ওপরে যৌন নিপীড়ন রুখতে খুব সচেষ্ট নয়।
আরও পড়ুন- বিষাক্ত কাশির সিরাপে শিশুমৃত্যু! ভারতে মিলছে অবাধে, কীভাবে তিলে তিলে প্রাণ নেয় ‘ওষুধ’
হিউমান রাইটস ওয়াচ এও জানিয়েছে, প্রথমত শিশুরা যৌন নিগ্রহের ব্যাপারটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। যদি বা বাবা-মাকে তারা ঘটনাটা বলতেও পারে, বাচ্চাদের কথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। কারণ অনেকক্ষেত্রে খুব চেনা লোকজনরাই অত্যাচার করছেন। মায়েরা যখন ওই সব চেনা মানুষজনকে চেপে ধরছেন, তখন মায়েদের উপরেও অত্যাচার চলছে– এরকম ঘটনাও সামনে এসেছে।
হিউমান রাইটস ওয়াচের তরফে বলা হয়, পুলিশ আর বিচারব্যবস্থার জেরার সামনে পড়ে ফের শিশুদের হেনস্থা হতে হচ্ছে। আর সেই আতঙ্কে অনেকে সত্যি ঘটনা গোপন করে যাচ্ছে। পকসো এই শিশুদের সমস্যার কতটা সুরাহা দিতে পেরেছে? শিশুদের ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের ঘটনার তদন্ত করার ক্ষেত্রে পুলিশ আর বিচারব্যবস্থার অনেক বেশি সংবেদনশীল হওয়া দরকার বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি। তারা জানিয়েছে, সব স্তরেই সচেতনতার অভাব রয়েছে।
মানবাধিকার কমিশন এভাবে সরব হওয়ায় দিল্লি পুলিশের মহিলা ও শিশু রক্ষা দফতর স্বীকার করেছে এমন ধরনের ঘটনা ঘটেই থাকে। এই ব্যাপারে পুলিশের আরও বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা। শিশুদের ওপরে যৌন নিগ্রহ রোখার জন্য খুব কড়া আইন রয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ রাজ্যই সেইসব আইন প্রয়োগই করছে না বলে অভিযোগ। অভিযুক্তরা খালাস পাচ্ছে, বিচার ঝুলে থাকছে, আর আসিফার মতো শিশুরা হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের ব্যাধির আঁস্তাকুড়ে। যে ব্যাধি খোদ সমাজ লালন করছে।