বিষাক্ত কাশির সিরাপে শিশুমৃত্যু! ভারতে মিলছে অবাধে, কীভাবে তিলে তিলে প্রাণ নেয় 'ওষুধ'

Cough Syrup Death: ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং এথিলিন গ্লাইকলের প্রভাবে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া, ডায়রিয়া, মাথা যন্ত্রণা, মূত্রত্যাগে সমস্যা, কিডনির ক্ষতি, এবং মানসিক সমস্যা দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে WHO।

গ্যাম্বিয়ায় কাশির সিরাপের প্রভাবে ৬৬ জন শিশুর মৃত্যুতে গত ৫ অক্টোবর সারা বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করেছিল ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শন বা WHO। ইতিমধ্যেই শিশুমৃত্যুর ঘটনায় গ্যাম্বিয়াতে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। মৃত শিশুদের অভিভাবকরা আইনি পদক্ষেপ করার কথা ভাবছেন, জানা যাচ্ছে বিবিসি-সূত্রে। গ্যাম্বিয়ার পাশাপাশি ভারতেও শুরু হয়েছে তদন্ত। WHO জানাচ্ছে, এই কাশির সিরাপে অগ্রহণযোগ্য মাত্রার ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং এথিলিন গ্লাইকল দূষক (Contaminant) হিসেবে রয়েছে।

তবে গ্যাম্বিয়া প্রথম নয়। গ্যাম্বিয়া ছাড়াও আফ্রিকার উপমহাদেশের আরেকটি দেশ নাইজেরিয়াও গণ-বিষক্রিয়ার শিকার হয় ২০০৯ সালে। এবং গ্যাম্বিয়ার মতো নাইজেরিয়াতেও অ্যাকিউট রেনাল ফেইলইওরের ঘটনা ঘটে। ১৯৪০ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি সারা বিশ্বে অন্তত দশটি গণহারে বিষক্রিয়া ঘটেছে কেবল ডাই-ইথিলিন গ্লাইকলের প্রভাবে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তরল বা ওয়েনমেন্ট-জাতীয় ওষুধে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল থাকার কারণে বিষক্রিয়া ঘটেছিল গণহারে। যার মধ্যে চিনের একটি ওষুধ নির্মাণকারী সংস্থার ওষুধ থেকে, একবার নয় তিনবার বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটেছে কেবল এই রাসায়নিকটির প্রভাবে। ২০০৯ সালে ‘জার্নাল অব পাবলিক হেলথ পলিসি’-তে প্রকাশিত একটি রিভিউ আর্টিকেল এমনই বলছে।

ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল আজ নয়, বরং বহুদিন থেকেই বিভিন্ন দেশে ওষুধের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ ড্রাগস, অর্থাৎ ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কাউন্টারে যে ওষুধগুলি কেনা যায়, সেই সমস্ত ওষুধে এই ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রায়শই থাকে, জানা যাচ্ছে ‘জার্নাল অব মেডিকেল টক্সিকোলজি’-তে প্রকাশিত ২০১০ সালের প্রতিবেদনে।

সেই প্রতিবেদন বলছে, চিন, মালেয়েশিয়া, তাইওয়ান থেকে বিপুল পরিমাণে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল আমদানি করে ওরাল মেডিসিন, গলা ও কাশির সিরাপ, চোখের ড্রপ, অয়েনমেন্ট, নাকের স্প্রে এবং অন্যান্য ওষুধে মেশানো হয়। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের রিপোর্ট বলছে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল আমদানিকারী দেশগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চিন। ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে সাঁইত্রিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ডাই- ইথিলিন গ্লাইকল আমদানি করেছে এই দেশ। তারপরেই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, জাপান এবং ভারতবর্ষ।

আরও পড়ুন- খ্রিস্টধর্মকে করে তুলতে চেয়েছিলেন ভারতীয়! ব্রিটিশদের চক্ষুশূল ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ‍্যায়

২০২০ সালে ভারত প্রায় সাত মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ডাই-ইথিলিন গ্লাইগল আমদানি করেছে। অন্যদিকে ২০২০ সালের রিপোর্ট বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবথেকে বেশি ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল রপ্তানি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই ক্রমানুসারে রয়েছে বেলজিয়াম, ব্রাজি়ল, জার্মানি, এবং ভারতবর্ষ।

ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল কী?

ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং এথিলিন গ্লাইকলের প্রভাবে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া, ডায়রিয়া, মাথা যন্ত্রণা, মূত্রত্যাগে সমস্যা, কিডনির ক্ষতি, এবং মানসিক সমস্যা দেখা যায়, বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে WHO। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল বর্ণহীন, গন্ধহীন, মিষ্টি স্বাদের একটি রাসায়নিক। যার প্রভাবে পেটের সমস্যা, কিডনির ক্ষতি এবং মূত্রত্যাগে সমস্যা হওয়া ছাড়াও পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথির এবং এনসেফেলোপ্যাথির মতো সমস্যা দেখা যায়। শুধু তাই নয় কোমা এবং মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে এই মারণ রাসায়নিক।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শনের সতর্কতা জারি

WHO সতর্কতা জারি করে জানিয়েছিল প্রোমেথাজা়ইন ওরাল সলিউশন, কোফেক্সমেলিন বেবি কাফ সিরাপ, মাকঅফ বেবি কাফ সিরাপ এবং ম্যাগ্রিড এন কোল্ড সিরাপ ওষুধগুলি নিম্নমানের রাসায়নিক দিয়ে তৈরি। WHO-এর বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যাচ্ছে, এই চারটি পণ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিকের কোনও রকম নির্দিষ্টকরণ বা স্পেসিফিকেশন এখনও অবধি দেয়নি এদের নির্মাণকারী সংস্থা হরিয়ানার মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (National Regulatory Authority) যতক্ষণ পর্যন্ত এই চারটি ওষুধকে পরীক্ষা না করে দেখছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই চারটি ঔষধি পণ্যের প্রতিটি ব্যাচকেই অনিরাপদ হিসেবে ধরে নিতে হবে।

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতি WHO-এর আবেদন

প্রোমেথাজা়ইন ওরাল সলিউশন, কোফেক্সমেলিন বেবি কাফ সিরাপ, মাকঅফ বেবি কাফ সিরাপ এবং ম্যাগ্রিড এন কোল্ড সিরাপ- এই চারটি ঔষধি পণ্যের প্রতিটি ব্যাচকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তদারকি করে, সেই ব্যাচের ওষুধগুলিতে ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং এথিলিন গ্লাইকলের উপস্থিতি যাচাই করে দেখার আবেদন রেখেছে WHO। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল এবং এথিলিন গ্লাইকল-মুক্ত কাশির সিরাপই যাতে বিক্রি হয়, সেই আবেদনও রেখেছে WHO কর্তৃপক্ষ।

WHO জানাচ্ছে, বিভিন্ন দেশে মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের যে সাপ্লাই চেইন রয়েছে, সেই দিকে যেন কড়া নজর রাখা হয়। কারণ সেই দেশের মানুষ, বিশেষ করে শিশুদেরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নাহলে বাড়বে। ৫ অক্টোবরের সতর্কতা নোটিশে WHO জানিয়েছে, যে সমস্ত ওষুধ সরবরাহকারী সংস্থা মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের এই ঔষধি পণ্যগুলি বেচবে তাদের যেন ওষুধ সরবরাহের অনুমতিপত্র থাকে।

আরও পড়ুন- সম্পূর্ণ নতুন মানুষ প্রজাতির সন্ধান এনে দিল নোবেল! যে রহস্যর সমাধান করল বিজ্ঞান

পাশাপাশি জ্ঞাতসারে কোনও দেশে যাতে এই ওষুধগুলি সরবরাহ ও বিক্রি করা না হয়, সেই আবেদনও রেখেছে WHO। জানানো হচ্ছে, কেউ এই ওষুধগুলির কোনওটি ব্যবহার করে থাকলে, যেন যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারি পরামর্শ নেন। “ভারতে কাশির সিরাপ বিক্রি করছি না আমরা”, নোটিশ মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের। এদিকে ৮ অক্টোবর মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড একটি নোটিশ জারি করে জানিয়েছে, তাদের পণ্যগুলি ভারতীয় বাজারে বিক্রি করছে না তারা। এবং তারা ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনেরাল অব ইন্ডিয়ার প্রোটোকল পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মেনেই নাকি এই পণ্যগুলি বানিয়েছে। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল যেখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, তারাও নামকরা সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত সংস্থা; তাও জানানো হয়েছে মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নোটিশে। শুধু তাই নয়, এই সংস্থাটির কাছে বাইরে ওষুধ রপ্তানির বৈধ অনুমতিও রয়েছে।

ওষুধনির্মাণকারী এই সংস্থাটির তরফে জানানো হয়েছে, তারা কেবল গ্যাম্বিয়াতেই এই চারটি কাশির ওষুধ বিক্রি করে। তবে রয়টার্স-সূত্রে জানা যাচ্ছে অন্য কথা। গ্যাম্বিয়া ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকাতেও ওষুধ রপ্তানি করে মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। বিবিসি সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত শুক্রবার অর্থাৎ ৭ অক্টোবর গ্যাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট অ্যাডামা ব্যারো জানিয়েছেন, এই ওষুধগুলির উৎস খতিয়ে দেখা হবে। এই ওষুধগুলিকে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে উপযুক্ত গবেষণাগার চালু করার পরিকল্পনাও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ব্যারো।

ভারতে গ্লাইকলের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু

২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের উধমপুরে কোল্ডবেস্ট- পি.সি. নামের ওষুধে খেয়ে মৃত্যু হয় ১২ জন শিশুর। ‘দ্য হিন্দু’ সূত্রে জানা যাচ্ছে সেই সময় গ্লাইকলের বিষক্রিয়ায় থেকে একাধিক শিশুর মৃত্যু ঘটে। ১৯৭৩ সালে চেন্নাইতে ১৪ জন শিশু, ১৯৮৬ সালে মুম্বইতে ১৪ জন শিশু এবং ১৯৯৮ সালে দিল্লির কাছাকাছি একটি অঞ্চলে ৩৩ শিশুর মৃত্যু হয় গ্লাইকলের বিষক্রিয়ায়।

More Articles