১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া! কোন পথে সুদান?

Sudan Massacre: দারফুরের অনেকেই মনে করেন, আরএসএফ ও তাদের মিত্র মিলিশিয়ারা অঞ্চলটিকে পুরোপুরি আরবদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে।

সুদানের উত্তর দারফুর প্রদেশের শহর এল ফাশারে আবারও সহিংসতা। সুদানের সরকারি বাহিনীর শেষ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই শহরটিও সম্প্রতি দখল করেছে আধাসামরিক গোষ্ঠী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)। এর পরেই উঠে এসেছে ভয়াবহ গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ। অভিযোগ, র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস এল ফাশারে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, বহু মানুষকে বন্দি করা হয়েছে। শহরের রাস্তাগুলি মৃতদেহে ভরে গিয়েছে। সরকার বলছে, এই সবই যুদ্ধাপরাধ এবং র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-কে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

এল ফাশার দখলের আগে এই শহর প্রায় ১৮ মাস ধরে র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস দ্বারা ঘেরাও ছিল। খাদ্য, ওষুধ বা সাহায্য কিছুই পৌঁছোচ্ছিল না। এখন শহরের প্রায় সব এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে উত্তর দারফুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। অনেকেই বলছেন, নিহতের সংখ্যা অন্তত দুই হাজার, তবে আসল সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।সুদানের সরকার আরও অভিযোগ তুলেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-কে সহায়তা দিচ্ছে। তাই যদি ইউএই এই যুদ্ধের মধ্যস্থতা করে, তাহলে তারা কোনো আলোচনায় অংশ নেবে না বলে জানানো হয়েছে। তবে ইউএই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এল ফাশারে এখন একেবারে 'ব্ল্যাকআউট' অবস্থা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সাহায্য পৌঁছানো অসম্ভব, আহতদের চিকিৎসা নেই। হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিচ্ছে, কিন্তু সেখানেও খাবার ও ওষুধের ঘাটতি ভয়াবহ। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, দারফুরে এ ধরনের সহিংসতা নতুন নয়। কিন্তু এল ফাশারের গণহত্যা সুদানের গৃহযুদ্ধকে আরও ভয়ঙ্কর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক সমাজ যদি দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে এই অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

কেন সুদানের এই পরিস্থিতি?

সুদানে এখন যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার শুরু ২০১৯ সালে। সেই বছর সেনাবাহিনী দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। আল-বশির ১৯৮৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন এবং প্রায় ৩০ বছর দেশ শাসন করেন। তাঁর শাসনে দুর্নীতি, দমননীতি ও দারিদ্র্যতা বাড়তে থাকে। ফলে ২০১৯ সালে সারা দেশে বড় বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের চাপেই সেনাবাহিনী আল-বশিরকে সরিয়ে দেয়। তার পর সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতা নেয়, কিন্তু সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায়। পরে সেনা ও বেসামরিক নেতাদের নিয়ে যৌথ সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আবারও সেনা অভ্যুত্থান ঘটে, এবং সেই সরকারও ভেঙে যায়। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন দুই নেতা— জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (সেনাবাহিনীর প্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট) এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো (হেমেডটি' নামে পরিচিত এবং আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর প্রধান)।

আরও পড়ুন

সেনার কাছে শরীর বিকোলে তবেই মিলবে খাবার! যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদান যেন আস্ত নরক

একদা দু’জন মিত্র ছিলেন। ২০১৯ সালে আল-বশিরকে সরানো এবং ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে তাঁরা একসঙ্গে কাজও করেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়— দেশ কে চালাবে এবং আরএসএফ বাহিনীকে সেনাবাহিনীর অধীনে আনা হবে কি না, তা নিয়ে। আরএসএফ-এর প্রায় এক লাখ সৈন্যকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েই মূলত এই দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। হেমেডটি মনে করেন, এতে তাঁর ক্ষমতা কমে যাবে। অন্যদিকে বুরহান মনে করেন, আরএসএফ আলাদা থাকলে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব দুর্বল হবে। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই ২০২৩ সালের এপ্রিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। ১৫ এপ্রিল ২০২৩-এ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী খার্তুম-সহ বিভিন্ন অঞ্চলে। আরএসএফ কিছুদিনের মধ্যেই রাজধানীর একটি বড় অংশ দখল করে নেয়। প্রায় দুই বছর পর, ২০২৫ সালের মে মাসে, সেনাবাহিনী আবার খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। সম্প্রতি পশ্চিম দারফুরের গুরুত্বপূর্ণ শহর এল ফাশের আরএসএফ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর সেখানে নতুন করে গণহত্যা ও নির্যাতনের খবর মিলছে। ওয়াকিবহাল মহল বলছে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট চলছে সুদানে। খাদ্য, ওষুধ, আশ্রয়— কোনো কিছুরই যথেষ্ট যোগান নেই। যুদ্ধ থামার কোনো সম্ভবনা না থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।

আরএসএফ যোদ্ধা কারা?

সুদানের আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস গঠিত হয় ২০১৩ সালে। শুরু থেকেই এই বাহিনীকে ঘিরে বিতর্কের শেষ নেই। দেশ ও বিদেশ, উভয় জায়গাতেই তাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। জানজাবিদ মিলিশিয়া থেকে গড়ে ওঠে এই বাহিনী। এরা দারফুর অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অনেক মানুষ হত্যা ও নির্যাতন করেছিল। এদের নেতা ছিলেন জেনারেল মহম্মদ হামদান দাগালো (‘হেমেডটি’ নামে পরিচিত)। সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির আন্তর্জাতিক সমালোচনার পরও জানজাবিদ সরকারি স্বীকৃতি দেন। পরে তারা 'বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস' নামে সরকারি বাহিনীতে পরিণত হয়। কয়েক বছর পর বশিরই তাদের দিয়ে আরএসএফ গঠন করেন। বাহিনীর প্রধান হন দাগালো। কিন্তু পরে দাগালো নিজেই আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি সামরিক সরকারের উপ-প্রধান হন এবং আরএসএফ-কে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। এরপর আরএসএফ শুধু দেশের ভেতর নয়, বিদেশেও সক্রিয় হয়— ইয়েমেন ও লিবিয়া যুদ্ধ-এ অংশ নেয় এবং সুদানের সোনার খনিগুলোর দখল নেয়। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে প্রতিবাদকারীদের উপর গুলি চালিয়ে ১২০ জনের বেশি মানুষ হত্যার অভিযোগও রয়েছে।

বর্তমানে আরএসএফ দেশটির বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। জুন মাসে তারা লিবিয়া ও মিশর সীমান্ত এলাকা দখল করে, আর অক্টোবরে দারফুরের এল ফাশের শহর দখল নেয়। এখন তারা সুদানে নিজেদের সরকার গঠনের দাবি তুলেছে। দুই পক্ষের ক্ষমতার লড়াই এখন গোটা দেশকে পরিণত করেছে ধ্বংসস্তূপে। সহিংসতা ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের ফলে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্ভিক্ষ, লাখ লাখ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এখনও অবধি প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, অনেকেই প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘ বলেছে, সুদান বিশ্ৱের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে।

আরও পড়ুন

বুভুক্ষু প্রায় ছ’লক্ষ! দু’বছর যে যে ভয়াবহতা দেখছে সুদান

সুদানের উত্তর ও পূর্বের বড় অংশ এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনীকে মিশর সাহায্য করছে। কারণ, দুই দেশের সীমান্ত সংযোগ ও নীল নদ ঘিরে তাদের পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান লোহিত সাগরের পাশে থাকা পোর্ট সুদান শহরকে তাঁর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তবে পোর্ট সুদান এখনও নিরাপদ নয়। এ বছরের মার্চে আরএসএফ সেখানে ড্রোন হামলা চালায়। একই মাসে সেনাবাহিনী দারফুর শহর পুনর্দখল করলেও তখন শহর প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এর পর সেনারা গেজিরা অঞ্চলও দখলে নেয়। কিন্তু অক্টোবরে আরএসএফের হাতে দারফুরের এল-ফাশের শহর দখল হয়ে যাওয়াকে সেনাবাহিনীর বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

দারফুরের অনেকেই মনে করেন, আরএসএফ ও তাদের মিত্র মিলিশিয়ারা অঞ্চলটিকে পুরোপুরি আরবদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে। ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আরএসএফ এমনকি এক বছরের শিশুদেরও যৌন নির্যাতন করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, আরএসএফ ও তাদের সশস্ত্র সহযোগীরা দারফুরের আরব নয় এমন জাতিগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা চালিয়েছে। জাতিসংঘের তদন্তে দেখা গিয়েছে, শুধু আরএসএফ নয়, সুদানের সেনাবাহিনীও যুদ্ধে জড়িত। কিছু আরএসএফ সেনা আরব নয় এমন নারীদের জোর করে ‘আরব সন্তান’ জন্ম দিতে বাধ্য করার হুমকি দিয়েছে। এখন এল-ফাশের অঞ্চলে চলা সহিংসতার কারণে সেখানে থাকা প্রায় আড়াই লাখ আরব নয় এমন মানুষের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে।

সুদান উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ, যার আয়তন প্রায় ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার। দেশটির অধিকাংশ মানুষ মুসলিম, এবং প্রধান ভাষা আরবি ও ইংরেজি। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সুদান ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি, যদিও এটি স্বর্ণ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ছিল। প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষের গড় আয় বছরে ৭৫০ ডলারেরও কম। দীর্ঘ সংঘাতের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

More Articles