মোদির ক্ষমতার উৎস! আজ কালো টাকা তত্ত্বকেই নাকচ করছে বিজেপি?
Modi Once Promised to End Black Money: গত দশ বছরে কত টাকা বিদেশে গিয়েছে, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। ফলে কালো টাকার যে তত্ত্বকে কেন্দ্র করে এত রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য আজও অধরা।
২০১৪ সালের নির্বাচন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন দেশজুড়ে প্রচার চালাচ্ছেন এক নতুন স্বপ্ন দেখিয়ে। দেশের মানুষ তখন দুর্নীতিতে ক্লান্ত, কেলেঙ্কারিতে অতিষ্ঠ। সেই সময়ই মোদি বারবার বলছিলেন, বিদেশে থাকা ‘কালো টাকা’ দেশে ফিরিয়ে আনলে প্রতিটি ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়া সম্ভব। তাঁর এই প্রতিশ্রুতি এমনভাবে জনমানসে আলোড়ন তুলেছিল যে, অনেকের কাছে মনে হয়েছিল এ যেন নতুন এক স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক।
কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরে এক দশক পেরিয়ে গেল। আজ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। ২০১৪-র সেই দাবির সঙ্গে আজকের সরকারি অবস্থানের কোনো মিলই নেই। লোকসভায় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত দশ বছরে কত অপ্রকাশিত আয় বা কালো টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কোনো সরকারি হিসাবই নেই। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজে যে বিষয়টিকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে এনেছিলেন, তাঁর সরকারই আজ বলছে, আইনেই ‘কালো টাকা’ বলে কোনো কিছু নেই।
সাংসদ মালা রায় লোকসভায় জানতে চেয়েছিলেন, বিদেশে কত টাকা লুকিয়ে রাখা আছে, সরকার কি তার হিসেব জানে? উত্তরে অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরি স্পষ্ট বলেন, সরকারের কাছে কোনো হিসেব নেই। তিনি আরও জানান, আইনে ‘কালো টাকা’ শব্দটিই নেই। আইনে বিবেচনা করা হয় শুধু বিদেশে থাকা অপ্রকাশিত আয় ও সম্পদের বিষয়টি। এ যেন এক রাজনৈতিক পরিহাস। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘কালো টাকা’ শব্দটি গত দশকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির নেতারা। কিন্তু আজ তারাই বলছেন, আইনেই এই শব্দ নেই। ফলে ২০১৪ সালে যে প্রতিশ্রুতিতে ভর করে জনসমর্থন কুড়িয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতিতে আজ আর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
আরও পড়ুন
নোটবন্দির মতোই ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলের প্রচার! অপরাধমুক্ত রাজনীতিই লক্ষ্য?
বিদেশে থাকা লুকোনো সম্পদ শনাক্ত ও কর আদায়ের জন্য ২০১৫ সালে কেন্দ্র চালু করে ব্ল্যাক মানি অ্যাক্ট। তখন ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল এককালীন ঘোষণার সুযোগ। সে সময়ে মাত্র ৬৮৪ জন তাঁদের বিদেশি সম্পদের কথা জানিয়ে দেয়, যার মূল্য ছিল মোট ৪,১৬৪ কোটি টাকা। এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার কর ও জরিমানা হিসেবে পেয়েছিল ২,৪৭৬ কোটি টাকা। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, এত বছরে শুধুই কি এই ৬৮৪ জনের লুকোনো সম্পদ ছিল? দেশজুড়ে কালো টাকার যে বিতর্ক, রাজনৈতিক বক্তৃতায় যে বিপুল অঙ্কের লুকোনো সম্পদের কথা শোনা যায় তা কতটা সত্যি? এসব প্রশ্নের উত্তর আজও অনিশ্চিত।
সবচেয়ে বড় সত্য হলো, গত দশ বছরে কত টাকা বিদেশে গিয়েছে, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই। ফলে কালো টাকার যে তত্ত্বকে কেন্দ্র করে এত রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য আজও অধরা। কালো টাকা আনার প্রতিশ্রুতির পর মোদি সরকারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল ২০১৬ সালের নোটবন্দি। ৮ নভেম্বর রাত ৮টায় দেশবাসীকে জানানো হয়, সেই রাত থেকেই ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জানান, দুর্নীতি, নকল নোট ও কালো টাকার রমরমা বন্ধের জন্যই এই কঠোর সিদ্ধান্ত। ঘোষণার পর দেশজুড়ে এক অভাবনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ দেশের অর্থনীতিকে কার্যত এক রাতেই রিসেট করে দেওয়া হলো। অন্যদিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে উঠে আসে, বাতিল হওয়া প্রায় সব নোটই ব্যাঙ্কে জমা পড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান, তাঁরা সহজেই টাকা সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নোটবন্দির পরদিন থেকেই শুরু হয় বিপর্যয়। দিনমজুরদের মজুরি বন্ধ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে বিপাকে পড়ে যান। ১০ নভেম্বর ব্যাঙ্ক খোলার পর দেখা যায়, এটিএম ও ব্যাঙ্কে অস্বাভাবিক লম্বা লাইন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে মানুষ নতুন নোট পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। এই লাইনে দাঁড়িয়েই বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ মারা গিয়েছেন। বেহালার কল্লোল রায়চৌধুরী নামের এক ব্যাক্তি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়।শহরের মধ্যবিত্ত হয়ত কোনো ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিল, কিন্তু ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল ভয়াবহ। ডিজিটাল পেমেন্ট তখনও সবাই ব্যবহার করতেন না। ফলে লেনদেন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এতসব কিছুর পর অবশেষে সরকারই বলছে, ‘কালো টাকা বলে কিছু নেই’!
এদিকে, নোট ছাপানো, পরিবহন ও নিরাপত্তায় সরকারের অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল হাজার হাজার কোটি টাকা।পুরনো নোট জমা পড়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে সুদ বাবদ আরও ১৮ হাজার কোটি টাকা দিতে হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে। অর্থাৎ ব্যয় হয়েছে বিপুল, লাভের হিসাব শূন্য।
আরও পড়ুন
নোটবন্দির জুজু, কেন হঠাৎ দু’হাজারের নোট তুলে নিচ্ছে RBI?
বলতেই হয়, মোদি সরকারের দাবির মতো গোদি মিডিয়াও তখন পুরো দমে প্রচার করেছিল কালো টাকা ধরা পড়বে, দুর্নীতি কমবে। কিন্তু গোদি মিডিয়া কখনও প্রচার করেনি কালো টাকার মালিকরা টাকা আগেই সিস্টেমে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন, তারা এখনও কালো টাকার হিসেব না থাকা নিয়েও কোনো প্রাইমটাইম শো করছে না। গোদি মিডিয়া কখনও এও বলেনি যে নোটবন্দিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষই।
এতে রাজনৈতিকভাবে বিজেপিও লাভবান হয়, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে তাদের বিশাল জয় আসে ২০১৭ সালে। ফলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, নোটবন্দির অর্থনৈতিক ক্ষতি থাকলেও এর রাজনৈতিক লাভ বিজেপি পেয়েছে। এখন তাঁদের সাম্প্রতিক বক্তব্য কার্যত মোদি সরকারের সেই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে, যার উপর ভর করে বিজেপি ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল।
আজ যখন সরকার নিজেই জানাচ্ছে ‘কালো টাকা’ বলে কিছুই নেই, তখন ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতি, নোটবন্দির উদ্দেশ্য, গোদি মিডিয়ার প্রচার সবই প্রশ্নের মুখে পড়ে। নিশ্চয়ই বিষয়টি ভবিষ্যতেও আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে, কারণ ভারতের অর্থনীতি, সমাজ, এবং রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে কালো টাকা ঘিরে এই প্রতিশ্রুতিই। প্রধানমন্ত্রী কি তবে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? রাজনৈতিক স্বার্থেই বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছিল? প্রশ্ন উঠছেই।

Whatsapp
