সমুদ্রের বুকে একা ১৩৩ দিন, পুন লিম-এর অবিশ্বাস্য লড়াই-কাহিনি
133 Days at Sea: লিমের ধরা মাছ কেড়ে নিতে দল বেঁধে আসত সামুদ্রিক পাখিরা। সেই পাখি শিকার শুরু করলেন লিম। এমনও হয়েছে প্রবল তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পাখির কাঁচা রক্ত পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন তিনি।
১৯৪৩ সালের এক উজ্জ্বল দিন। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন ব্রাজিলের কয়েকজন মৎসজীবী। হঠাৎ তাঁদের একজন দিগন্তরেখার কাছাকাছি অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ করেন। চেঁচিয়ে বাকিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তীর থেকে মাইল নয়েক দূরত্বে একটা কালো দাগ এবার নজরে পড়ে তাঁর সঙ্গীদেরও। জিনিসটা কী, তা খতিয়ে দেখতে নৌকায় চেপে রওনা দেন তাঁরা। জিনিসটার কাছাকাছি পৌঁছে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাঁরা দেখেন, আট ফুটের সরু একটি কাঠের পাটাতনে এক ক্ষীণকায় চিনা মানুষ নাচছেন, তারস্বরে গান গাইছেন আর মাথার উপর নিজের ছেঁড়া জামা তুলে বন বন করে ঘোরাচ্ছেন। দৃশ্যটা এতটাই অপরিচিত, যে প্রথমটায় থতমত খেয়ে যান মৎসজীবীরা। লোকটার গায়ের চামড়া কড়া রোদে প্রায় ঝলসে গিয়েছে, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন পেটে কিছু পড়েনি, অথচ উৎসাহ দেখ! কী প্রবল আনন্দে লোকটি তখন নাচছিল, গান গাইছিল─তা সে'সময় তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। দিনকয়েক পরে, এক দোভাষীর সাহায্যে তাঁরা জানতে পারেন, লোকটির নাম পুন লিম। এবং লোকটি সাগরের বুকে ওই কাঠের ভেলাটি সম্বল করে ১৩৩ দিন কাটিয়েছেন। আজ পুন লিমের সেই অবিশ্বাস্য কাহিনি শুধুমাত্র আপনাদের জন্য।
পুন লিমের জন্ম চিনের দক্ষিণ কেন্দ্রীয় উপকূলের হেইনান দ্বীপে ১৯১৮ সালের ৮ মার্চ। মৎসজীবী পরিবারে বড় হওয়ায় খুব অল্প বয়সেই সাঁতারে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন পুন। তাঁর যখন বছর দশেক বয়েস, তাঁকে নিয়ে পরিবার চলে এল মালয়েশিয়ায়। সে'খানেও মাছব্যবসার কাজকর্ম করতেন পুন। ১৯৪২ সাল নাগাদ লিমের কাজ জোটে চাইনিজ মার্চেন্ট মেরিনে। এসএস বেনলোমন্ড নামে একটি ব্রিটিশ জাহাজ তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়ায় মালপত্র সরবরাহ করত। সেই জাহাজে স্টুয়ার্টের কাজ পেলেন লিম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। চারিদিকে যুদ্ধের করাল ছায়া। জাহাজের কর্মচারীরা একরকম আতঙ্কেই থাকত। সে'বছরই ২৩ নভেম্বর বেইটিশ নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার বেনলোমন্ডের উপর হামলা চালাল এক জার্মান ডুবোজাহাজ। এমনিতেই বেনলোমন্ডের গতি অত্যন্ত কম। বিশালাকৃতি চেহারা নিয়ে মন্থরগতি জাহাজটি অস্ট্রেলিয়ার পথে পাড়ি দিয়েছিল। আশেপাশে মিত্রপক্ষের কোনও জাহাজও ছিল না। সেই সুযোগ নিয়ে জার্মান ইউ-বোটটি টর্পেডো ছোঁড়ে বেনলোমন্ডে। ডুবোজাহাজের আক্রমণ সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেয়নি জাহাজের কর্মচারীদের। শেষ মুহূর্তে সামলাতে পারেননি নাবিকেরাও। ফলে জাহাজটি ঘায়েল হয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে। সলিল সমাধি হয় প্রায় সব যাত্রীরই। বেঁচে যান কেবলমাত্র পুন। সলিল সমাধি সম্ভবত তাঁর নিয়তিতে ছিল না।
জাহাজ ডোবার আগের মুহূর্তে একটি লাইফ জ্যাকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন লিম। তাই সম্বল করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক নাগাড়ে ঘণ্টা দুয়েক সাঁতরে তাঁর শরীর যখন ক্লান্ত, তখন সেই আট ফুট বাই আট ফুট পাটাতনটি দেখতে পান লিম। এই আশ্রয়ই একরকম তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। কিছুটা জিরিয়ে সবার আগে কী কী খাবার রয়েছে সঙ্গে একবার দেখে নেন লিম। জাহাজ থেকে কিছু মালপত্র জোগাড় করেছিলেন। ৪০ লিটার পানীয় জল, সুগার কিউবের একটি বস্তা, কয়েক টিন শুকনো বিস্কুট, চকোলেট, একটি ইলেকট্রিক টর্চ ইত্যাদি ছিল তাঁর সংগ্রহে। পরার মতন কিছু কাপড়ও ছিল সঙ্গে। কিন্তু আদিগন্ত নীল জল। কোনও ডাঙা চোখে পড়ছে না। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কোনও পরিমাণ খাদ্য-পানীয়ই যথেষ্ট নয়। কাজেই লিম বুঝতে পারছিলেন, যদি বাঁচতে হয়, তাঁকে মাথা খাটাতে হবে।
আরও পড়ুন : মমিতে লুকিয়ে অবিশ্বাস্য রহস্য! মিশরের এই সম্রাটকে নিয়ে যে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি
কয়েকদিন অপেক্ষা করেই লিম বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না। মহাসমুদ্রের মাঝে তাঁর একমাত্র আশ্রয় এই পাটাতন। পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। খাদ্য ফুরিয়ে আসছে। বাঁচতে গেলে শরীর সুস্থ রাখতে হবে। লাইফ জ্যাকেটে করে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করতে শুরু করলেন লিম। তারপরে ইলেকট্রিক স্টোভের তার বের করে পাটাতনের পেরেক দিয়ে তৈরি হল বঁড়শি। মাছ ধরার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিলই। সমুদ্রের মাছ ধরে খিদে মেটালেন লিম। এ'ভাবে দিনের পর দিন কেটে গেল। প্রায় মাস চারেক সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকলেন লিম। সামুদ্রিক ঝড় তাঁর আশ্রয় তছনছ করে দিত মাঝে মাঝেই। আবার নতুন উদ্যম নিয়ে শুরু করতেন। পানীয় জল পাওয়া যেত না দিনের পর দিন। অচেতন হয়ে এসেছে শরীর। এমন সময় মাথায় আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর। লিমের ধরা মাছ কেড়ে নিতে দল বেঁধে আসত সামুদ্রিক পাখিরা। সেই পাখি শিকার শুরু করলেন লিম। এমনও হয়েছে প্রবল তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পাখির কাঁচা রক্ত পান করে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন তিনি।
তার উপর ছিল হাঙরের উৎপাত। এক সময় বাধ্য হয়েই হাঙর শিকার করতে শুরু করলেন লিম। পাখির মাংস দিয়ে হাঙরের জন্য টোপ ফেলতেন। একদিন সেই টোপ গিলল একটি হাঙর। টেনে তাকে পাটাতনের উপর তুললেন লিম। এতটাই বেপরোয়া হয়ে পরেছিলেন, আধভর্তি জলের জাগ দিয়ে পিটিয়ে হাঙরটিকে মেরে ফেললেন তিনি। তারপর হাঙরের পাখনা খেলেন তারিয়ে তারিয়ে। চিনের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি পদ হাঙরের পাখনা।
১৩৩ দিন পরে যখন তাঁকে উদ্ধার করা হয়, লিম জানিয়েছিলেন, জলের রঙ আকস্মিক ভাবে বদলে যেতে তিনি আঁচ করেছিলেন কাছেপিঠেই কোথাও ডাঙা রয়েছে। সেই তিন মৎসজীবীদের দৌলতেই প্রাণে বাঁচেন লিম। প্রায় কুড়ি পাউন্ডের মতো ওজন কমে গিয়েছিল তাঁর। ব্রাজিলের এক হাসপাতালে মাসখানেক চিকিৎসা চলে। সুস্থ হয়ে ব্রিটেনে ফিরে যান লিম। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন ভদ্রলোক। ৭২ বছর বয়েসে ব্রুকলিনে মারা যান পন লিম। সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে যিনি নিজের জীবন ছিনিয়ে এনেছিলেন।