ক্রেতা তালিকায় রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল! কলকাতায় যেভাবে জনপ্রিয় হল আতর

Old Attar Shop: রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, সুভাষচন্দ্র থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ, মুজিবর রহমান, লিয়াকৎ আলি সবাই এখান থেকে আতর নিয়েছেন কখনও না কখনও। সুভাষচন্দ্র বসুর হয়ে আতর নিতে আসতেন কখনও বসু বাড়ির লোকেরা।

ব্যস্ত শহরের ধুলোমাখা রাজপথ। ততোধিক জনবহুল রাস্তা। বিরতিহীন গাড়ির শব্দ আর হাজার কোলাহল মিলে যায় বেলাশেষের আজানের সুরে। অজস্র ছোট-বড় দোকান রাস্তার দুইপাশে। পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। জামা-কাপড়ের দোকান, খাবারের দোকান, জারদৌসি টুপি আর  নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান চারপাশে। বিরিয়ানি এগরোল আর মশলার দোকানের চেনা  সুবাস মিলেমিশে যায় বাতাসে। ভিড়ের গন্ধে এমনই মিলে যায় তা, যে আলাদা করে আর চেনা যায় না। এই সব পেরিয়ে নাখোদা মসজিদের গা ঘেঁষে ফুটপাথ ধরে হাঁটা পথচারী থমকায় আলাদা এক ঘ্রাণে। ভেলভেটের মতো মসৃণ আর গাঢ় এই গন্ধের উৎস সন্ধানে চোখে পড়ে ভিড়ের মধ্যে আলাদা এক দোকান। যার কাউন্টারে সাজানো নানা রঙের শিশি বোতল থেকে পড়ন্ত বেলার আভা পড়ে ছিটকে বেরোচ্ছে বাহারি রঙয়ের আলো। এখান থেকেই আতরের ঘ্রাণ ভেসে আসছে বাতাসে। ছড়িয়ে পড়ছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। বহু পুরনো আতরের এই দোকানগুলি শহরের সম্পদ। 

দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো এই দোকানগুলি যখন শুরু হয় চিৎপুরের  রাস্তায় তখনও গ্যাসবাতি বসেনি।কেরোসিন বাতির কম আলোয় দেখা যায় না ভাল করে। তাই দোকানগুলি খুলত একেবারে সাতসকালে। তখনই হাঁকডাকে জমজমাট হত বাজার। ফজরের নামাজ পড়ে এসে দোকানের সামনে জল ছিটিয়ে রাস্তা ভিজিয়ে শুরু হতো বেচাকেনা। আধা আলোর সকালে মৃদু বাতাস মনোরম হত আতরের ঘ্রাণে। দোকানগুলির  ঝাঁপ পড়ত ছ’টা বাজতে না বাজতেই। বাইরের আলো তখন আস্তে আস্তে মরে আসছে। ‘তাজ মার্কা সুরমা আউর কাজল’ এমনিই এক দোকান। সুরমা কাজলের সঙ্গে সঙ্গে আতরের জন্যও বিখ্যাত এই দোকানটি।

১৮৮২-তে উত্তরপ্রদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন জিয়াউদ্দিন হাজি। এখানে এসে সুরমার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এর কিছুদিন পরেই আতরে মন পড়ে তাঁর। শুরু হয় এর ব্যবসাও। কনৌজ থেকে আসত আতর, এখনও আসে সেখান থেকেই। কী নেই এঁদের সুগন্ধের সম্ভারে! তার মধ্যেও বেশি বিক্রি হয়, গুলাব, কস্তুরী, বেলি, রজনীগন্ধা, হেনা মুশক উদ আর চন্দন। যখন দোকান প্রথম শুরু হয় তখন থেকেই চাহিদা বেশি এগুলির। যে সব প্রবীণ মানুষ এই দোকানের জিনিসের নিয়মিত ক্রেতা তাঁরা এখনও এই দোকানে আসেন এগুলি কিনতে। নবীন প্রজন্মের পছন্দ আলাদা। তাঁরা কেনেন, দরবার, ফিরদৌস সালমা, আয়াতি, পর্তুগাল গাজি বা ক্যাসানোভা। ১০ গ্রাম বা এক ভরি হেনা আতরের দাম ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। কস্তুরীর দাম ২০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা। ভাল উদের আতর আসে আসাম থেকে। যে কাঠ থেকে উদ পাওয়া যায়, তার দাম অত্যন্ত বেশি বলে খাঁটি আতরের দাম দশহাজার টাকা থেকে ১লাখ টাকার কাছাকাছি। তবে এক হাজার টাকাতেও উদের আতর পাওয়া যায়। মুসলমানরা মনে করেন তাঁদের নবীর গায়ের গন্ধ ছিল উদের মতো। সেইজন্যই এই আতরের চাহিদাও বেশি।

আরও বলেন- জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?

দুবাই থেকে আসে আতর সদৃশ্য শিশিতে বন্দী হয়ে। তিন-চার হাজার টাকাও সেই আতর বিক্রি হয়। ক্রেতাদের আতরের পছন্দ বদলে যায় ঋতুভেদেও। গরম আর বর্ষায় তাঁদের পছন্দে বেলি, গোলাপ, জুঁই। শীতে বেশি বিক্রি হয় হেনা, উদ কস্তুরী কেশর শামামা। বিক্রি কেমন আতরের? খানিকটা হতাশা  জামালুদ্দিন হাজির গলায়। দোকান শুরু হওয়ার পর ষষ্ঠ প্রজন্মের মানুষ তিনি। বললেন, ‘লকডাউনের আগে বিক্রিবাটা মন্দ ছিল না। কিন্তু এখন বাজার অনেকটা ঠান্ডা। তাও রমজানের সময় এখনও খানিকটা চাঙ্গা হয় বাজার। বারবার নামাজ পড়েন মানুষ। সেই সময় স্নান করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয় গায়ে সুগন্ধি দিয়ে মসজিদে যান তাঁরা।‘ তবে নতুন প্রজন্মের কাছে আতরের চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়ছে বলে জানালেন তিনি।

কলকাতায় আতরের দোকানের রাজা, হাজি খুদাবক্স নবী বক্স। কলুতলা আর রবীন্দ্রসরনীর সংযোগে পুরনো এই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে হঠাৎ পিছিয়ে যেতে হয় বহুবছর। দোকানের তাকগুলিতে সাজানো আতরেরর শিশিগুলি থেকে আসা মিষ্টি গন্ধে দোকানের আশপাশে সুবাসিত। লখনউয়ে যখন নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই সময় জান মহম্মদ তাঁর ছেলে হাজি খুদাবক্সকে নিয়ে সেখানকার এর পাট চুকিয়ে চলে এলেন কলকাতা। এই শহর তখন দেশের রাজধানী। মনে ইচ্ছা ছিল বড় জায়গায় এসে নিশ্চিন্তে ব্যবসা করবেন। কলকাতায় আতরের ব্যবসার সেই শুরু তাঁদের। এই দোকানের ক্রেতাদের নামের তালিকা চমকে দেয়। মালিকানার সপ্তম প্রজন্ম নিয়াজুদ্দিন আল্লা বক্স জানালেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, সুভাষচন্দ্র থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ, মুজিবর রহমান, লিয়াকৎ আলি সবাই এখান থেকে আতর নিয়েছেন কখনও না কখনও। সুভাষচন্দ্র বসুর হয়ে আতর নিতে আসতেন কখনও বসু বাড়ির লোকেরা। কখনও শাহ নওয়াজ খান। সুগন্ধের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল নেতাজীর।

জেল থেকে মেজবৌদি বিভাবতী দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন,’’ গন্ধ ও গানের অভাব মাঝে মাঝে বড় বোধ করি। কিন্তু উপায় কী? নজরুল ইসলামের পছন্দের আতর ছিল গোলাপ, মুস্ক আর অম্বর। নজরুলের লেখাতেও গোলাপের আতরের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা জানা যায়।। গোলাপের সুগন্ধে মুগ্ধ যে কবি লিখেছিলেন, ‘ওরে গোলাপ নিরিবিলি নবীর কদম ছুঁয়েছিলি, তাঁর কদমের খোশবু আজো তোর আতরে জাগে’, সেই কবির জন্য  এই দোকানের গোলাপের আতর নেওয়া হত। ঠাকুর বাড়ির লোকেরা নিতেন গোলাপ, বেল আর জুঁইয়ের আতর। কলকাতার বাবুদেরও বিশেষ পছন্দ ছিল এই দোকানের আতর। প্রতি রাতে বউবাজার বা জানবাজারে বাইজি বাড়ি যাওয়ার আগে সন্ধ্যায় বাবুরা আসতেন দোকানে। নিয়াজুদ্দিন বলছিলেন, এঁদের আতর পছন্দ করাতে গিয়ে দোকান বন্ধ করতে দেরি হয়ে যেত মাঝেমাঝেই। বাবুরা আগে চাকর বা কোচোয়ানের গায়ে দিয়ে দেখতেন কোন আতরের গন্ধ কেমন? শেষে মনোমত গন্ধ পেলে গিলে করা পাঞ্জাবির হাতায় চুনোট করা ধুতিতে আতর ঢেলে রওনা হতেন বারাঙ্গনার বাড়িতে। বাবুর দাক্ষিণ্যে খানিকটা আতর লাভ করে  কোচোয়ানরা তুলোয় করে তা গুঁজে রাখত কানের পিছনে।

সুকুমার রায় তাঁর বাবু কবিতায় চমৎকার ছবি এঁকেছেন এঁদের,

'অতি খাসা মিহি সুতি
ফিনফিনে জামা ধুতি
চরণে লপেটা জুতি জরিদার
এ হাতে সোনার ঘড়ি
ও হাতে বাঁকানো ছড়ি
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার’।


শুধু গায়ে দেওয়া নয়, শৌখিন বাবুরা ঘরও মুছতেন আতর আর গোলাপ জল দিয়ে। বারাঙ্গনাদের সঙ্গে দোল খেলার সময় আবিরের মধ্যে মিশেয়ে দিতেন সুগন্ধী। দোকানের পুরনো রিসিট বলছে সেই সময় ১২ এমএল আতরের দাম ছিল দুই আনা থেকে চার আনা। এখন ১২ এম এল আতরের দাম ২৫০ টা থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে ২৫ হাজারের আতরের চাহিদা মুম্বাই হায়দ্রাবাদে বেশি। এখন  রুহ খস, মুস্ক শামামা অম্বর কেনেন মানুষ। শামামায় থাকে জাফরানের গন্ধ। মুস্কের গন্ধও অনেকটা মশলার গন্ধের মতো। কিছু আতরের গন্ধ হয় চন্দন কাঠের গন্ধের মতো। এই আতরের দাম বেশ বেশি। ১২ এমএল অর্থাৎ এক ভরির দাম ৬ হাজার টাকা। নিয়াজুদ্দিন বললেন, ‘আগে এই দোকানের বেশ কিছু আতর  তৈরি হত বেঙ্গল কেমিক্যালের পাশে বিরাট এক ফুলের বাগানের ফুল থেকে। প্রচুর চাঁপা, জুঁই, বেল, গোলাপ, ফুটত সেইখানে। সেই বাগান  হাতছাড়া হয়েছে কবেই। এখন আতর আসে কনৌজ থেকে। আতর তৈরিতে সময় লাগে দুই থেকে তিন সপ্তাহ। আগর গাছ থেকে তৈরি উদের আতর প্রস্তুত হতে সময় বেশি লাগে’। কথা বলতে বলতে হাসি খুশি দিলদার স্বভাবের এই বিক্রেতার মুখে মেঘ জমল। বললেন, ‘আগে ফুলের গন্ধের আতরের চাহিদা ছিল বেশি। তাই ফুলের নির্যাস দিয়ে তৈরি হত সুগন্ধি। এখন সেই সময় আর নেই।  কৃত্রিম গন্ধ বেশি পছন্দ মানুষের’।

আরও বলেন- নোট দিয়ে সিগারেট, আতর দিয়ে ঘর মোছা, কলকাতার যে ‘বাবুগিরি’ আজও অবাক করে

মসজিদ লাগোয়া আরও একটি দোকানের মালিক দেখিয়ে দিলেন আতর কীভাবে ব্যবহার করতে হয়? কব্জিতে তর্জনী ঘষে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন,  গায়ে দেওয়ার আগে গন্ধ শুকতে নেই নাকি এই জিনিসের। তাতে আতরের খুশবু অধরা রয়ে যায়। ত্বকের সংস্পর্শে এলে তবেই আতরের গন্ধ বোঝা যায়। বিক্রি কেমন আতরের? গলায় হতাশার সুর বিক্রেতার। বললেন ‘দেশি বিদেশি পারফিউম এসে যাওয়ায় আতরের বাজার কমে গিয়েছে। আগে পুজো থেকে ঈদ যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে ভাল বিক্রিবাটা হত। এখন আর সেই জিনিস নেই। ভাল আতর বানাতেও সময় লাগে অনেক। দামও বেশ বেশি। আতর নিয়ে প্রচার প্রায় নেই। নেই বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য। আতরের কথা ভুলে গিয়েছেন মানুষ। এখন বডি স্প্রে থেকে পারফিউম কিনতে বেশি পছন্দ করছেন তাঁরা। "খুশবুদার এই আতরপট্টির বাইরেও পাওয়া যায় এই জিনিস। বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশনের পাশে ‘অল-হালাল ইতর’-এ পাওয়া যায় কদম ফুলের গন্ধের আতর। বাগবাজারে গুপ্তা পারফিউমে পাওয়া যায় চম্পা চামেলি শিউলি গন্ধী আতর। এ ছাড়াও অনলাইনে পাওয়া যায় এই জিনিস। অ্যামাজনে বিশ্ববাংলার আতর পাওয়া যায়। চিৎপুর প্যাকের দাম ১৬০০ টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে থাকে রোজ, আয়াতি, স্যান্ডেল, হোয়াইট মুস্ক। এছাড়াও কেশর আর জুঁইয়ের গন্ধে পাওয়া যায় রূহানি। দাম ৪৯৯ টাকা। তবির পাওয়া যায় ল্যাভেন্ডারের গন্ধে। এর দামও ৫০০ টাকার কাছাকাছি। আরও নানা নাম আর দামে পাওয়া যায় আতর।

লখনউ থেকে  যখন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় চলে আসেন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন নবাবি তহজিব আর সংস্কৃতি। আতরের গন্ধ ছেড়ে আসা রাজপাটের স্মৃতি ফিরিয়ে দিত তাঁকে। তিনিই এই শহরে জনপ্রিয় করেন এই সুগন্ধিকে। সে সুবাস মুছে যেতে বসেছে কলকাতার বুক থেকে। বিক্রেতারা ব্যবসা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টায় নতুন প্রজন্মের পছন্দের চকলেট, স্ট্রবেরি ক্যারামেল গন্ধের আতর আনছেন বাজারে। সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে আগের আতরগুলি আবার জনপ্রিয় করার। পুরনো সব হয়ত ফেরানো যাবে না। কিন্তু মিঠে গন্ধের মৌতাতে যদি এভাবেও মেতে থাকে কলকাতা তাহলেও সেটা প্রাপ্তি তো বটেই।

More Articles