জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?
Raja Surath Durga puja: পুজোর সময় এই জঙ্গলে বহু পুণ্যার্থী ছুটে আসেন। দুর্গাপুজোর চারদিন মহা সমারোহে পুজো হয়। প্রতি বছর পুজো আসে পুজো যায়, তবে তাকে কেন্দ্র করে বহু দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষের জমায়েত হয়।
দুর্গা, শক্তির মূর্ত প্রতীক। আমাদের বঙ্গদেশে তিনি পুত্রকন্যা নিয়ে সপরিবারে আসেন। রোগ, শোক-দুঃখ, অভাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে মানুষ দেবীর স্মরণ করে। উপাসনা করে। তবেই জীবন সার্থক হয়। দেবী সর্বশক্তিপ্রদায়িণী।
রাজা সুরথের দুর্গাপুজো কীভাবে হয়েছিল? বাংলার বিভিন্ন স্থানীয় লোককাহিনীতে রাজা সুরথ এর নাম পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বীর একজন রাজা। কোনো লোককাহিনীতে তাঁকে আবার অত্যাচারীও বলা হয়েছে। তবে তাঁর সমন্ধে খুব একটা বিশেষ জানা যায় না।
শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। রাজা সুরথ যোগ্য রাজার মতোই প্রজাদের সেবা করতেন। সব সময় তাঁদের সুরক্ষা দিতেন। এমনও ধারণা আছে উপযুক্ত শাসকের মতো পুত্রের চোখে প্রজাদের দেখতেন। যাতে তাঁরা শান্তিতে বসবাস করেন ও সন্তুষ্ট থাকেন। চন্দ্রবংশের রাজা ছিলেন সুরথ রাজ।

গড় চণ্ডী ধামে মন্দির, কাঁকসা
তবে রাজধর্ম পালনে খারাপ ও বলবান লোকের অভাব থাকে না। এরা সবসময় চায় ক্ষমতার হস্তান্তর। সেই লোকেদের আসুরী গুণের জন্যে রাজাকে কষ্ট দেয়। শোনা যায় সুরথের রাজধানীর নাম ছিল কোলা। সেখান থেকে তিনি বাংলার রাঢ় অঞ্চল বলিপুরে আশ্রয় নেন। প্রজা পালন ও শিষ্ঠাচার যথাযথ করেও নিজের রাজধানী পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- অতীতে দুর্গাপুজো ছিল ফসল কাটার উৎসব, কীভাবে বিলুপ্ত হল দুর্গাভোগ ধান?
রাজা সুরথের রাজধানী আক্রমণ করেন কাশ্মীর প্রদেশের রাজগণ। সুরথ রাজের সঙ্গে সেই রাজার এক ভীষণ যুদ্ধ বেঁধেছিল। এমন ঘটনায় বহু সৈন্য ও সাধারণ মানুষ মারা যান। রাজা সুরথ মহা বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। তবে নিজের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেও সুরথ হেরে গিয়েছিলেন। রাজা নিজ রাজধানীতে ফিরলে দেখেন লোভী দুষ্ট মন্ত্রী সৈন্য, ধনসম্পদ, রাজ্য সুযোগ বুঝে অধিকার করে নিয়েছেন। রাজ্যের প্রজারাও রাজাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। সমস্ত ঘটনার সঙ্গে তিনি রাজ্য আর পুনরুদ্ধার করতে পারলেন না। দীর্ঘ সময় অরণ্যে কাটিয়ে আসলেন মেধস মুনির আশ্রমে। এই বিষয়ে আরেকটি কাহিনী চালু আছে। প্রচলিত অনুসারে, সুরথ কর্ণাট দেশ জয় করবার জন্যে অভিযান করেছিলেন। বিজয় লাভের উদ্দেশ্যে সেই যাত্রা ব্যর্থ হয়। যা হাসিল করতে চেয়েছিলেন সেটি ব্যর্থ হওয়ার জন্যে প্রজারাও রাজাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি রাজ্য ত্যাগ করে গভীর অরণ্যে মেধস মুনির আশ্রমে আসেন। এখানেই তিনি শক্তি সাধনা করে। জানতে চান, কেমন ভাবে হয় সেই পুজো? যেটি ছিল পৃথিবীর প্রথম দুর্গাপুজো।

অতীতে এমনই এক শাল গাছের নিচে মেধস মুনি কঠোর তপস্যা করেন
না আছে রাজা, না আছে রাজত্ব কিন্তু আজও সেই পুজোর স্থান আছে। আর আছে অরণ্যে মেধস মুনির আশ্রম। মেধস মুনির সঙ্গে দেখা হয় সুরথ ও বৈশ্যর। সমস্ত ঘটনা রাজা বলেন মুনিকে। পুরাণ অনুসারে, মেধস মুনিকে বশিষ্ঠ ঋষি বলা হয়েছে। মুনি তাঁদের আশ্রমে বসে শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনা করেন। তিনি জানান, দেবীর আরাধনা ও ধ্যান করলে অভীষ্ট সিদ্ধ হবে। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য মাটি দিয়ে মাতৃপ্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন। ক্রমে ক্রমে দেবীর রূপ ফুটে উঠলো। শাস্ত্র মতে পুজো করলেন রাজা। সুরথ কৃপা লাভ করলেন দেবীর। রাজা স্বরাজ্য ফিরে পেলেন দেবীর কৃপায়। মার্কণ্ডেয় পুরাণে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। যা সমগ্র পৃথিবী ও বঙ্গদেশের প্রথম দুর্গাপুজো।
আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়
এবার জঙ্গলের পথে, দুর্গাপুর ও পানাগড়ের কাছেই কাঁকসার গড় জঙ্গল বা গড় চণ্ডীধাম। এই জঙ্গলের মধ্যেই প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন সুরথ। লাল নুড়ি পথ ধরে এগোলেই পায়ে পায়ে রহস্য। দু-দিকে অরণ্যের আদিম পরিবেশ। ভাগ্যে জুটলে দর্শন মিলতে পারে দুলকি চালে কয়েকটি হাতির। তবে খুব একটা এদের আনাগোনা নেই। জঙ্গলে উইয়ের ঢিপি, শাল, পলাশ, মহুয়া দুপাশে রেখে বেশ খানিকটা এগোলেই মহর্ষি মেধসের আশ্রম ও শ্রী শ্রী গড় চণ্ডী ধাম চোখে পড়ে। কাছেই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অজয় নদ। আর এখানে আছে এক পুরনো দেউল ও মাতা শ্যামরুপা দেবীর মন্দির। ইতিউতি অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা এখানে ঘুরে বেড়ান। সকলে এই জায়গায় একসঙ্গে বাস করেন। যেন গা ছমছমে এক রহস্যে ঢাকা পরিবেশ। সারা বছরই এখানে দুর্গাপুজো হয়। রাজা সুরথের আমলের এক প্রাচীর ও কিছু স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এখানে আছে। এক সময় এই মন্দিরে আসতেন দেবী চৌধুরাণী। তিনি এখানে সদলবলে এসে পুজো দিয়েছিলেন। দেবী চৌধুরাণীর নামে এখানে এক সুড়ঙ্গ আছে। পুজোর সময় এই জঙ্গলে বহু পুণ্যার্থী ছুটে আসেন। দুর্গাপুজোর চারদিন মহা সমারোহে পুজো হয়। প্রতি বছর পুজো আসে পুজো যায়, তবে তাকে কেন্দ্র করে বহু দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষের জমায়েত হয়। আজ স্মৃতিচিহ্নগুলো জঙ্গলের ভেতর সংরক্ষণের অভাবে বেশিরাগটাই হারিয়ে গিয়েছে। এই জায়গা প্রাচীন সংস্কৃতির এক অন্যতম বড় নিদর্শন।
Whatsapp
