কোথায় মোদির 'আত্মনির্ভর'তা? কেন নিউজিল্যান্ডের ২০,০০০ কেজি উল লাগল সংসদের কার্পেটে?

New Parliament Carpet Controversy: ২০,০০০ কেজি নিউজিল্যান্ডের উল দিয়ে নতুন পার্লামেন্টে একটি বিশেষ কার্পেট তৈরি করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'ভোকাল ফল লোকাল'। মানে নিজের জিনিসের জন্য ফলাও করে প্রচার করো। দেশ সমৃদ্ধ, তাই দেশের মানুষকে হতে হবে আত্মনির্ভর। খামোখা অন্য পণ্য উৎপাদনের জন্য বাইরের দেশের উপর নির্ভর করা কেন। আমদানি নয়, নিজের দেশের উৎপাদিত পণ্য দিয়েই দেশজ উৎপাদন বাড়াতে হবে। অথচ দেশের নয়া সংসদ ভবন গড়তে গিয়ে 'আত্মনির্ভর' রইলেন না নরেন্দ্র মোদি। পুরনো বৃত্তাকার আকৃতির সংসদ ভবনের জায়গায় ৬৫,০০০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে নতুন ত্রিভুজাকার সংসদ ভবন গড়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২৮ মে রবিবার বিনায়ক দামোদর সাভারকারের জন্মবার্ষিকীতে নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনও করেছেন। নানা বিতর্ক ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে হইচই ফেলেছে। বিতর্ক স্তিমিতও হয়েছে। তবে দু'টি বিষয় নিয়ে সমালোচনা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আনুমানিক ৯৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই নতুন সংসদ ভবনে একটি কার্পেট নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেন?

কার্পেট তৈরি করতে গিয়ে নিউজিল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়েছে উল! ২০,০০০ কেজি নিউজিল্যান্ডের উল দিয়ে নতুন পার্লামেন্টে একটি বিশেষ কার্পেট তৈরি করা হয়েছে। দেশে তো পর্যাপ্ত উল উৎপাদন হয়। তা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে উল আমদানি কেন? কেন সংসদ ভবনের বেলা 'লোকাল'-এর জন্য 'ভোকাল' হলেন না মোদি?

আরটিইআই অ্যাক্টিভিস্ট সাকেত গোখলে বলছেন, "একদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন ভোকাল ফর লোকাল যার অর্থ হচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত, আর অন্যদিকে সরকার নতুন সংসদের জন্য নিউজিল্যান্ডের থেকে উল আমদানি করাকেই পছন্দ করছেন। সাকেত জানান, ভারতীয় উলের রপ্তানি ভারতের মোট রপ্তানির ৭% নিয়ে গঠিত। উল শিল্পে ৩২ লাখেরও বেশি ভারতীয় কাজ করে। তাহলে নিউজিল্যান্ড থেকে উল আমদানি করে ভারতীয় উল উৎপাদকদের কেন বঞ্চিত করা হয়েছে? প্রশ্ন উঠছেই।

"প্রায় ৩১৪ টি তাঁত এবং ৯০০ জনেরও বেশি তাঁতি এই কার্পেট বুনেছেন ৫ মাস ধরে," জানান মাস্টার তাঁতি গণেশ মৌর্য। লোকসভার কক্ষে ময়ূর পালকের মোটিফের কার্পেট তৈরি করেছে। ৩৮ টি শেড ব্যবহার করা হয়েছিল এর একটি ওম্ব্রে তৈরি করতে। অন্যদিকে রাজ্যসভার কক্ষের কার্পেটের মোটিফ জাতীয় ফুল পদ্ম। হালকা গোলাপি থেকে গভীর লাল রঙের এই কার্পেট। দর্শক এবং মিডিয়া গ্যালারির জন্য আবার রয়েছে আলাদা কার্পেট। ৭০% এরও বেশি তাঁতিই স্থানীয় এবং বাকিরা প্রতিবেশী রাজ্যের। তাছাড়া ১২০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দুই সভার বিভিন্ন নকশা।

নতুন চারতলা সংসদ ভবনটিতে ১,২৭২ জন সংসদ সদস্যের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার মধ্যে লোকসভায় ৮৮৮ জন সদস্য এবং রাজ্যসভায় ৩৮৪ জন সদস্যের ধারণক্ষমতা রয়েছে। পুরনো সংসদ ভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।

উলের পাশাপাশি নতুন পার্লামেন্টের ভেতরে নির্মিত ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণায় নির্মিত ম্যুরাল নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই ম্যুরালে দেখানো হয়েছে গৌতম বুদ্ধর জন্মস্থান লুম্বিনি। এটি আধুনিক ভারতের সীমানার বাইরে এবং নেপালের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম। এই ম্যুরালে বর্তমান আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলাঙ্কাকে পূর্ব ভারতের অংশ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই খবরের পর সর্বপ্রথম নেপালে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গত সপ্তাহেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহালের ভারত সফরের আগে, দেশটির রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে বিষয়টি ভারতে উত্থাপন করার এবং ম্যুরালটি সরিয়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করেন। ম্যুরাল বিতর্কের মধ্যেই নেপালের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরটি ছিল বেশ অস্বস্তিকর। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রকও ম্যুরালটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

কাঠমাণ্ডু ও ইসলামাবাদের পর ঢাকার রাজনৈতিক মহলেও এই ম্যুরালের বিষয়টি সদ্য উত্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের মতে, “ম্যুরালটি প্রাগৈতিহাসিক অশোকান সাম্রাজ্যের বিস্তারকে চিত্রিত করেছে সুতরাং রাজনীতির সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক নেই, যদিও ব্যাপারটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।” ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে বাংলাদেশ বিদেশ মন্ত্রকের তরফে ম্যুরাল বিষয়ে ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।

নতুন সংসদের ভিতরের একটি বিভাগ হচ্ছে আর্ট গ্যালারি। এই গ্যালারিতে ভারতের ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা এবং ভারতের ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের ভাস্কর্য প্রর্দশিত হয়েছে। এই ‘অখণ্ড ভারত’ ধারণার ম্যুরালটিও আর্ট গ্যালারি বিভাগেই নির্মিত। নতুন সংসদ ভবনের আর্ট গ্যালারিতে ৩৫০ জনেরও বেশি কারিগরের কাজ প্রদর্শিত হয়েছে । প্রদর্শিত ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে- রাম, লক্ষ্মণ, সীতা, ইন্দ্রদেব, বুদ্ধ, চাণক্য, আওরঙ্গজেব, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, বিনায়ক দামোদার সাভারকার, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু, বিআর আম্বেদকর প্রমুখ। এছাড়াও রয়েছে অশোক চক্রের ভাস্কর্য, মুদ্রার ভাস্কর্য, সমুদ্র মন্থন ভাস্কর্য ইত্যাদি।

তবে নতুন সংসদ ভবনের কোথাও মহাত্মা গান্ধিকে সেইভাবে রাখাই হয়নি। পুরনো সংসদ ভবনে স্থাপিত মহাত্মা গান্ধির ১৬ ফুট উঁচু মূর্তিটি তাড়াহুড়ো করে প্রধান দরজা থেকে ৩ নম্বর দরজার দৃশ্যমান জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি সংসদে পুরাণ, রামায়ণের দাপটের পাশে জাতির জনক যে ফিকে পড়বেন, এ তো জানা কথাই।

More Articles