ভূস্বর্গের নীচে ৫৯ লক্ষ টন 'সাদা সোনা'র আবিষ্কার! রাতারাতি ভাগ্য বদলাচ্ছে কাশ্মীরের

Lithium Deposits in Jammu and Kashmir: জম্মু কাশ্মীরের রিয়াসি বেল্টে ৫.৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম ভাণ্ডারের আবিষ্কার বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম সংগ্রহের মধ্যে একটি হতে পারে।

সারা দেশ এবার থেকে তবে কাশ্মীরমুখী? রাষ্ট্র বহু যুগ থেকেই কাশ্মীরের দিকে তাকিয়ে, বর্তমান সরকার আরও বেশি করে কাশ্মীরকে বিবিধ উপায়ে নিজেদের রাজনৈতিক তাস করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তবে সম্প্রতি কাশ্মীরে এমন এক বিষয়ের খোঁজ মিলেছে যা দেশকে তো বটেই, বিশ্বকেও আগ্রহী করে তুলবে ভূস্বর্গের প্রতি। ইলেকট্রিক ভেহিকেল শিল্পের বিরাট ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে ভারতের সবচেয়ে অশান্ত এই রাজ্য। দ্য জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ৯ ফেব্রুয়ারি দেশকে সাড়া জাগানো এই খবরটি জানিয়েছে। এই প্রথম জম্মু ও কাশ্মীরে ৫.৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম রিজার্ভের আবিষ্কার দেশকে বিশ্বব্যাপী আলোচনার মঞ্চে নিয়ে এসেছে।

লিথিয়াম একটি অ-লৌহঘটিত ধাতু এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির অন্যতম প্রধান উপাদান। লিথিয়াম নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই নানা সন্ধান চালিয়েছে জিএসআই। এই বিশাল সন্ধান সেই গবেষণারই ফসল বলা যায়। জীবাশ্ম জ্বালানি কমছে, পাশাপাশি এই জ্বালানি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর তাও নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দূষণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশই গ্যাসোলিন-জ্বালানির ইঞ্জিন থেকে সরে আসছে ব্যাটারির দিকে। আর এই ধরনের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত লিথিয়াম, নিকেল এবং কোবাল্টের চাহিদা বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। ইলেকট্রিক গাড়ি, মোবাইল ফোন বা সোলার প্যানেলের ব্যাটারিতে লিথিয়াম ব্যবহার করা হয়। ভারত এই জাতীয় অনেক খনিজই যেমন লিথিয়াম, নিকেল এবং কোবাল্টের ক্ষেত্রে আমদানির উপরেই নির্ভরশীল।

দেশেই এই বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম মেলায় তাই এক ধাক্কায় বেশ এগিয়ে গিয়েছে ভারত। "এই প্রথমবার, লিথিয়ামের ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে তাও আবার জম্মু ও কাশ্মীরে,” উচ্ছ্বসিত কেন্দ্রীয় খনি সচিব বিবেক ভরদ্বাজ। পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত সরকার লিথিয়াম সহ বিভিন্ন খনিজ সুরক্ষিত করার জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, জম্মু কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও খনির সম্পূর্ণ মালিকানা পাবে। খনি মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশি বলছেন, "স্বনির্ভর হওয়ার জন্য, দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খনিজ খুঁজে বের করা এবং তার উপযুক্ত প্রক্রিয়াকরণ করা।"

আরও পড়ুন-ন্যানো ইভি থেকে শুরু করে মার্সিডিজ! মুম্বইয়ের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ায় রতন টাটার এই গাড়িরা

লিথিয়াম খনি আবিষ্কার শুধুই দেশের সরকার নয়, বিজ্ঞানী মহলকেও বেশ আগ্রহী করে তুলেছে। জম্মু ও কাশ্মীরের বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী অধ্যাপক শাকিল রমশু গ্রেটার কাশ্মীরকে বলেছেন, “জম্মু কাশ্মীরের রিয়াসি বেল্টে ৫.৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম ভাণ্ডারের আবিষ্কার বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম সংগ্রহের মধ্যে একটি হতে পারে। এটি জম্মু ও কাশ্মীরের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশের বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।"

শাকিল রমশুর কথায়, ভারত বিশ্বে লিথিয়ামের অন্যতম প্রধান উত্পাদক হয়ে উঠছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা ৩০ শতাংশ বাড়াতে বদ্ধপরিকর রাষ্ট্র। এর মধ্যেই এই লিথিয়ামের আবিষ্কার দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির উত্পাদনকে দ্রুত বাড়তে পারে। ভারত বর্তমানে উত্পাদন শিল্পের জন্য লিথিয়াম আমদানির উপর ১০০ শতাংশই নির্ভরশীল এবং তাই এই খনিজের আবিষ্কার দেশের শিল্পক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

ভারত বর্তমানে সমস্ত লিথিয়াম এবং লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি আমদানি করে মূলত হংকং, চিন, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম থেকে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত এই আমদানিতে ২৬,৭০০ কোটি টাকারও বেশি খরচা করেছে ভারত।

লিথিয়াম খনিজকে বলা হয় 'সাদা সোনা'। বিশ্বব্যাপী ব্যবহার এবং শিল্পে প্রয়োগ ও চাহিদা বাড়ার কারণে লিথিয়ামের দাম সম্প্রতি বহুগুণ বেড়েছে। তাই দেশে আবিষ্কৃত বিপুল পরিমাণ সাদা সোনা জম্মু কাশ্মীরের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে এক অন্য দিশা দেখাবে। দেশের শিল্পখাতে লিথিয়ামের ব্যবহার দেশের বৈজ্ঞানিক নানা গবেষণাকেও বাড়াবে।

বিজ্ঞানী মহলের একাংশের দাবি, লিথিয়ামের আবিষ্কারটি ভারতকে ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণেও সাহায্য করবে। গ্রেটার কাশ্মীরকে শাকিল রমশু বলেছেন, ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষ্য পূরণেও সাহায্য করবে এই লিথিয়াম কারণ, আশা করা যায় যে, দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার ডিজেল এবং পেট্রোলের জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণকে উল্লেখযোগ্যভাবেই হ্রাস করবে৷ সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিও ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের আলো দেখবে।

আরও পড়ুন- ‘হাউজফুল’ কাশ্মীর! ৩২ বছরে কী কী ঘটল কাশ্মীরের সিনেমাহলে?

প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত জলবায়ু সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মতো জনবহুল দেশ বৈদ্যুতিক যানবাহনে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করে কারণ এগুলি কার্বন নির্গমন কমিয়ে দূষণ কম করে। ভারতকেও পরিবেশ বাঁচাতে সেই পথেই হাঁটতে হবে। তবে লিথিয়াম আকরিকের খনন এবং অনুসন্ধানের এক বড় প্রভাবও পড়বে পরিবেশে, যাকে সামাল দিতে খনিজ উত্তোলনে সর্বাধুনিক পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

ভূ-বিজ্ঞানী আব্দুল মজিদ বাট জানিয়েছেন, বছর দশেক আগে তিনি জম্মুর বাল্লিগঙ্গাকাটরায় ম্যাগনেসাইটের সন্ধান চালাচ্ছিলেন। বিশাল তাপমাত্রার ওভেনে পোড়া ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এটি। ঘটনাচক্রে তখন তিনি লিথিয়ামের উপস্থিতির সম্ভাবনার কথাও জানান। কিন্তু সেই সময় উপযুক্ত গবেষণাগারের অভাবে সেই সন্ধান আর এগোয়নি।

বর্তমানে চিলিতে বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম আকরিক মজুদ রয়েছে, ৮ মিলিয়ন টন। তারপরেই অস্ট্রেলিয়ার ২.৭ মিলিয়ন টন, আর্জেন্টিনার ২ মিলিয়ন টন এবং চিনের ১ মিলিয়ন টন লিথিয়ামের সন্ধান জানে বিশ্ব। ভারতের এই বিপুল ভাণ্ডার তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে অনেকখানিই এগিয়ে দেবে বলে বিশ্বাস বিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদদের।

More Articles