৪৬ বছরে ৫ বার দুর্ঘটনার শিকার করমণ্ডল এক্সপ্রেস! কেন?

Coromandel Express Accidents: আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে এরকমই একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, একটি ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল এক মালগাড়ির।

তিনটি ট্রেন- দু'টি যাত্রীবাহী এবং একটি মালবাহী। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব ধ্বংস। তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছে ২৮৮ জনের। আহত প্রায় ৯০০ জন। তবে এই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকবে জানা নেই। নিহতের সংখ্যার নিরিখে, করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের গাইসাল (১৯৯৯) ও জ্ঞানেশ্বরী (২০১০) ট্রেন দুর্ঘটনার সমকক্ষ। হাওড়ার শালিমার স্টেশন থেকে চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল ১২৮৪১ আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২৩ কামরার ট্রেন। সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট নাগাদ যখন এই দুর্ঘটনা ঘটে, তখন যেন একেবারে দেশলাই বাক্সের মতো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে গোটা করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেঙ্গালুরু-হাওড়া যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের দু'টি কামরাও। এই তথ্য সকলেরই জানা। কিন্তু কেন ঘটল এই ঘটনা? তদন্ত সাপেক্ষ বিষয় তো বটেই, তবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই মিলবে একাধিক কারণ। জানা যাবে, করমণ্ডলে মারাত্মক দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়।

দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংকেতে বিভ্রাটের তথ্যই উঠে আসছে। আর সিগনালিংয়ে গড়বড়ের ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। ভারতের রেল কর্তৃপক্ষের তদন্ত দলের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শালিমার থেকে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে মূল লাইন দিয়ে চলে যাওয়ার সংকেত দেওয়ার পর আবার সেই সংকেত তুলে নেওয়া হয়। ট্রেনটি তখন স্টেশন এলাকার অতিরিক্ত লাইন অর্থাৎ লুপ লাইনে উঠে পড়ে। আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মালবাহী ট্রেন। ফলে সরাসরি ধাক্কা লাগে এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়ে করমণ্ডল।

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে এরকমই একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, একটি ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল এক মালগাড়ির। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬১ জন যাত্রী। ২৮ জানুয়ারি ১৯৮২ সালে আগ্রা ক্যান্টনমেন্টে ঘটা এই দুর্ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল পুরো ভারত। ভোর ৪:১৫ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের সেকেন্দ্রাবাদ থেকে দিল্লিগামী দক্ষিণ এক্সপ্রেস সিগনালের ভুলে চলে যায় লুপ লাইনে। সেই লাইনেই ধীরগতিতে চলছিল একটি মালগাড়ি। অন্যদিকে, প্রায় ৭০ কিলোমিটার গতিতে ছিল দক্ষিণ এক্সপ্রেস। ফলে, মুখোমুখি ধাক্কায় একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যায় দক্ষিণ এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনসহ বেশ কিছু কামরা। ১৪টির মধ্যে ১০টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন- বাংলা থেকে বিশ্ব- ইতিহাসের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা যা আজও ভুলতে পারেনি কেউ

প্রথম বগিগুলোই বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই দুর্ঘটনায়। প্রথমদিকের বগি থেকে ৫৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল। গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে তারপরে বের করতে হয়েছিল মৃতদেহগুলিকে। এসি কামরা তেমন ক্ষতির মুখে পড়েনি। বেশি ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল সাধারণ স্লিপার এবং অসংরক্ষিত কামরাগুলির। রেল কর্মী ও মৃত ব্যক্তিদের দেহ উদ্ধার করতেই প্রায় ২ দিন সময় লেগেছিল উদ্ধারকারী দলের। অনেকটা এই ঘটনার পুনরাবৃত্তিই ঘটেছে শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে। এখানেও সেই সিগনালের গোলমাল। রেলের গাফিলতি থাকলেও, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইতিহাস কোনওদিনই খুব একটা সুখকর ছিল না। ৪৬ বছরের ইতিহাসে এর আগেও ৫ বার এরকম বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস!

কাজ হোক বা ভেলোরের মতো হাসপাতালে চিকিৎসা, পশ্চিমবঙ্গবাসীর দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার অন্যতম লাইফ লাইন এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস। হাওড়ার শালিমারের সঙ্গে তামিলনাড়ুর এমজিআর চেন্নাই সেন্ট্রালকে জুড়ে দেয় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। কিন্তু এই ট্রেন অতীতে বারবার দুর্ঘটনার শিকারও হয়েছে। আসলে কি নামেই রয়েছে বিপত্তি? না হলে ৪৬ বছরে ৫ বার একই ট্রেনে দুর্ঘটনা! ভারতের সবথেকে বড় ট্রেন দুর্ঘটনাগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে এই বিপর্যয়। শুক্রবারের ওই বিভীষিকাময় রাতের ছবি অবাক করে দিয়েছে গোটা ভারতবাসীকে। যদিও ৪৬ বছরের পুরনো এই ট্রেনটির দুর্ঘটনার ইতিহাসের খতিয়ান অনেক লম্বা।

স্বাধীন ভারতে ১৯৭৭ সালে ভারতীয় রেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ২৬ ঘণ্টা সময় নিয়ে ১৪ টি স্টেশনে দাঁড়িয়ে শালিমার থেকে চেন্নাই পৌঁছায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে এই ট্রেন। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০২ সালের ১৫ মার্চ। সেদিন দুপুর ২:৪০নাগাদ তৎকালীন হাওড়া চেন্নাই করমণ্ডল এক্সপ্রেস অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরের কাছে একটি রেল ব্রিজে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সাতটি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। কোনও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও আহত হয়েছিলেন প্রায় ১০০ জন যাত্রী। লাইনের করুণ অবস্থার কারণেই সেবার দুর্ঘটনায় পড়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস।

আরও পড়ুন- ট্রেন তো নয়, নরক! ভারতীয় রেলের সবচেয়ে নোংরা ট্রেন কোনগুলি?

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের পরবর্তী দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিনটিও ছিল শুক্রবার। আর দুর্ঘটনার স্থান ছিল সেই ওড়িশা। ২০০৯ সালে করমণ্ডল এক্সপ্রেস যখন ভুবনেশ্বর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ওড়িশার জাজপুর রোড রেলওয়ে স্টেশনে বেশ ভালো গতিতে লাইন পরিবর্তন করছিল, সেই সময় একটা লাইনে উঠে যায় ইঞ্জিন আর অন্য লাইনে চলে যায় কামরাগুলি। ট্রেনটির গতি এতটাই বেশি ছিল যে কামরাগুলি আর সামলাতে পারেনি। একেবারে তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়েছিল মুহূর্তেই। সন্ধ্যা ৭ টা ৪০ মিনিট নাগাদ এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৬ জন যাত্রী।

২০১২ সালের ১৪ই জানুয়ারি করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রার মাঝেই আগুন লেগে গিয়েছিল ট্রেনে। সৌভাগ্যবশত সেই ঘটনায় হতাহতের কোনও ঘটনা না ঘটলেও, আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। ওড়িশার লিঙ্গরাজ স্টেশনের কাছে চেন্নাই হাওড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সাধারণ কামরায় আগুন লেগে গিয়েছিল। তবে সেই আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি।

২০১২ সালেরই ৩০ ডিসেম্বর ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ধাক্কায় মারা গিয়েছিল ৬টি পূর্ণবয়স্ক হাতি। কোনও যাত্রীর কোনও ক্ষতি না হলেও, হাতির মৃত্যুতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ভারতীয় রেলের সিগনালিং ব্যবস্থা নিয়ে। ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল অন্ধ্রপ্রদেশের নিদাদাভালু স্টেশনে ফের একবার আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেবারে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি কিন্তু ট্রেনের দু'টি বগি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

৪৬ বছরে ৫ বার, অথচ এখনও যাত্রীদের ভরসা, কিছুটা বাধতার জায়গাই হয়ে রয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। কোনও 'কবচ' করমণ্ডলের এই কুখ্যাতি ঘোচাতে পারেনি। কিন্তু এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা প্রমাণ করছে, দুর্ঘটনা সামান্য এক ঘটনাই। আম আদমির জীবনের মতোই সাধারণ, গুরুত্বহীন।

More Articles