শেফালি-দীপ্তি যেন জয় আর বীরু, বন্ধুত্বের দর্পে ভেঙে খান খান প্রোটিয়া প্রতিরোধ
ICC Women's World cup India 2025: ভারতের ইনিংসের প্রথমার্ধের তারকা যদি হন ওপেনার শেফালি, তাহলে দ্বিতীয়ার্ধের তারকা অবশ্যই দীপ্তি শর্মা। তাঁর ব্যাটিংয়ে তারকাসুলভ দেখনদারির চেয়ে অচঞ্চল পরিণামদর্শিতার ছাপই বেশি স্পষ্ট।
ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল এর আগে খেলেছে দুটো বিশ্বকাপ ফাইনাল। দু'বারই টস হেরে তাদের আগে বল করতে হয়েছিল। এবারের ফাইনালেও ভারতের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা টস জেতে, কিন্তু বৃষ্টির ভ্রুকুটি দেখে আর পিচের থেকে খানিকটা অতিরিক্ত সুবিধে আদায় করার আশায় প্রোটিয়া অধিনায়ক উলভার্ড সিদ্ধান্ত নেন ভারতকে ব্যাট করতে পাঠানোর। সেই শাপে যে বর হবে, এটা অনেক ভক্তই হয়তো ম্যারিজেন ক্যাপের প্রথম ওভারটা মেডেন হবার পর ভাবেনি। কিন্তু ভারতের হয়ে ওপেনিং জুটিতে স্মৃতি মন্ধানা আর শেফালি বর্মা বল পিছু এক রানের গতি ধরে রেখে একশো রানের পার্টনারশিপ গড়ায় চাপের বোঝাটা প্রথম থেকেই বেশি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কাঁধে। কমেন্ট্রি বক্সে আলোচনা চলছিল ভারতের গভীর ব্যাটিং লাইনআপ সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি রান তুলতে পারবে কিনা সেই নিয়ে। যে কাট শটে স্মৃতি মন্ধানা সাংঘাতিক পটু, সেই কাট মারতে গিয়েই তিনি কট বিহাইন্ড হওয়ার পর নভি মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়াম বেশ নিস্তব্ধ হয়ে এসেছিল। কিন্তু শেফালি বর্মা ওভার শেষ হওয়ার আগেই সম্পন্ন করলেন তাঁর অর্ধশতরান। তিন বছরের প্রতীক্ষার পর একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে তিনি করলেন হাফ সেঞ্চুরি।
শেফালি বর্মার কাহিনিটা অনেকটা সিনেমার মতো। রোহতাকের কোনো ক্রিকেট অ্যাকাডেমিই একজন মেয়েকে সুযোগ দিতে রাজি হয়নি। দাদা সাহিলের মত ছোট চুল রেখে অ্যাকাডেমির কর্মকর্তাদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি যোগ দেন অ্যাকাডেমিতে। ছেলেদের অনূর্ধ্ব বারো একটা টুর্নামেন্টে যখন অসুস্থতার জন্য সাহিল খেলতে পারেননি, তখন শেফালিই 'সাহিল' হয়ে খেলেন গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে। একের পর এক দারুন ইনিংস খেলে জিতে নেন প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। বারো বছর বয়সে শেফালি প্র্যাকটিস করতেন অনূর্ধ্ব ষোলো বিভাগের ছেলেদের সঙ্গে। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় শেফালির। আর্ন্তজাতিক কেরিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই একটা টেস্ট ম্যাচে করেছিলেন তিনি। মাত্র ১৯৭ বলে ২০৫ রান তুলে, মহিলাদের টেস্টে দ্রুততম ডবল সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়ে, তিনি ভারতের দ্বিতীয় মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে সম্পন্ন করেন টেস্ট দ্বিশতক।

সিনেমার মতো কাহিনি শেফালি বর্মার।
একদিনের ক্রিকেটে শেফালির গড় তেমন চমকপ্রদ নয়। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর ব্যাটিং দেখে বোঝার জো ছিল না যে তিনি এই বিশ্বকাপে সবে তাঁর দ্বিতীয় ম্যাচ খেলেছেন। সাড়ে তিন বছর আগে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপেও তাঁর একমাত্র হাফসেঞ্চুরিটা এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই, তবে সেই ম্যাচে পৌনে তিনশো রানের লক্ষ্য সফল ভাবে তাড়া করে দক্ষিণ আফ্রিকা ভারতকে ছিটকে দিয়েছিল বিশ্বকাপ থেকে। শেফালির এবারের ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এই বিশ্বকাপ ফাইনালের মহামঞ্চেই আগেরবারের হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা ধুয়ে-মুছে সাফ করতে বদ্ধপরিকর। একাত্তর রান করে ফেলার পর যখন তাঁকে বাঁপায়ে ক্র্যাম্পের জন্যে খেলা থামিয়ে শুশ্রূষা গ্রহণ করতে হলো, তখনও তাঁর শরীরী ভাষায় স্পষ্ট লেখা ছিল আরো রান করার খিদে। শীঘ্রই তিনি ফের ব্যাট হাতে স্টান্স তো নিলেনই, পাশাপাশি আবার ওভার শেষের আগেই সুন লুসের মাথার উপর দিয়ে একটা দেখবার মত ছক্কা মেরে যেন জানিয়ে দিলেন ভারতের চিন্তা নেই। দুর্দান্ত ফুটওয়ার্ক শেফালির ব্যাটিংয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা কিঞ্চিৎ ব্যহত হয়েছিলই। রান নেবার ব্যাপারেও তাঁর তৎপরতা বাধাপ্রাপ্ত হয় ক্র্যাম্পের পরে। একদিনের ম্যাচে তাঁর প্রথম শতরানটা বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চে আমাদের দেখা হলো না ঠিকই, কিন্তু ৭৮ বলে ৮৭ রানের এই ইনিংসটা ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে। শুধু চোখধাঁধানো শটের ঝলকের জন্য নয়, এই ইনিংসের আসল মহার্ঘ্যতা স্থিতধী প্রত্যয়ে ম্যাচের গতিপথ নির্ধারণ।

শেফালির ব্যাটিং ঝড়ে কুপোকাত প্রোটিয়ারা।
প্রথম স্পেলে খরুচে বোলিং সত্ত্বেও, আয়াবঙ্গা খাকাকে আক্রমণে ফিরিয়েছিলেন অধিনায়ক উলভার্ড। তাঁর দ্বিতীয় স্পেলের দ্বিতীয় আর তৃতীয় ওভারে থাকা সাজঘরে ফেরান শেফালি আর জেমিমাকে। অন্তত সোয়া তিনশোর যে প্রথম ইনিংস স্কোর প্রায় স্বতঃসিদ্ধ লাগছিল, সেটা অনেকটাই কঠিন বলে মনে হতে লাগল। সাতাশ থেকে বত্রিশ ওভারের মধ্যে এল মাত্র তেরো রান। দুজন নবাগত ব্যাটারের একটু সময় লেগেছিল খেলাটা ধরতে। পঞ্চাশ রানের উপর চলল দীপ্তি শর্মা আর হারমনপ্রীত কৌরের জুটি। ভারতের অধিনায়ককে ম্লাবা বোল্ড করার পর অমনজ্যোতও বেশিক্ষণ টেকেননি। ভারতের রানরেট বাড়ানো যখন একান্ত দরকার, তখন শিলিগুড়ির মেয়ে রিচা ঘোষ নেমেই দ্বিতীয় বলে একটা ছক্কা মেরে ঘোষণা করে দেন তাঁর উদ্দেশ্য। শেষপর্যন্ত তিনটে চার আর দুটো ছয় সমেত ২৪ বলে ৩৪ করে তিনি যখন শেষের আগের ওভারের শেষ বলে আউটফিল্ডে ক্যাচ আউট হয়ে ফিরলেন, তখন দলের রান ২৯২। রানের বিরাট পাহাড় খাড়া করার আশায় খানিকটা ঠান্ডা জল ঢালা হলেও, ভারত শেষপর্যন্ত ২৯৮ রান তুলে প্যাভিলিয়নে ফিরল।
আরও পড়ুন- ম্যাচ জেতানো ওভার, বাজিগরের নাম দীপ্তি শর্মা
ভারতের ইনিংসের প্রথমার্ধের তারকা যদি হন ওপেনার শেফালি, তাহলে দ্বিতীয়ার্ধের তারকা অবশ্যই দীপ্তি শর্মা। যদিও তাঁর ব্যাটিংয়ে তারকাসুলভ দেখনদারির চেয়ে অচঞ্চল পরিণামদর্শিতার ছাপই বেশি স্পষ্ট। আর কে না জানে বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো খেলায় বড় রান তুলতে হলে এমন একজন 'অ্যাংকর' করার মতো ব্যাটারের ভীষণ প্রয়োজন। অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দেওয়ার বিলাসিতা এই ম্যাচে দীপ্তি দেখাতে পারেননি। তাঁর উপর অনেকখানি দায়িত্ব ছিল। তবুও বল প্রতি এক রান তিনি ঠিকই করে গেছেন। একবার এলবিডব্লিউতে তাঁকে আউট দিয়েছিলেন আম্পায়ার, সেই ভুল সিদ্ধান্ত রিভিউয়ের পর তাঁকে নট আউট ঘোষণা করা হয়। আরেকবার তাঁর ক্যাচ মিস করেন ক্যাপ। বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা দীপ্তি তবুও অস্থির হননি। ৫৮ রান করে শেষ অব্দি তিনি টিকে না থাকলে এই ম্যাচের গতিপ্রকৃতি অন্যরকম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল পুরোমাত্রায়।
মহিলাদের বিশ্বকাপ ফাইনালে ১৬৭ রানের বেশি কখনও সফলভাবে তাড়া করা হয়নি। এই দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনশোর উপর রান তুললেও, ঘরের মাঠে ভারতের দিকেই পাল্লাটা বেশ খানিকটা ভারী বলে মনে হচ্ছিল। তবু দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনাররা একটা পোক্ত ভিত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তবে প্রথম পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে অমনজ্যোৎ দেখিয়ে দিলেন যে ব্যাট হাতে রান না পেলেও, এই ক্রিকেট ম্যাচে তাঁর একটা বড়সড় ভূমিকা তিনি ঠিকই প্রমাণ করে ছাড়বেন। মিডঅন থেকে তাঁর দুর্ধর্ষ থ্রো ডাইরেক্ট হিটে তাজমিন ব্রিটসকে সাজঘরে ফিরতে বাধ্য করে। পরের উইকেটটা ভারত পেল দ্বাদশ ওভারে। শ্রী চরণি বারবার ব্যাটারদের বিপাকে ফেলেছেন এই ম্যাচে। তাঁর প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই ফর্মে না থাকা বশ শূন্য রানে এলবিডব্লিউর শিকার হন।
আরও পড়ুন- লরার ক্যাচ হাতের মুঠোয়, ২০২৫-এর কপিল অমনজ্যোৎ
দুটো উইকেট পড়লেও, দক্ষিণ আফ্রিকা ঠিকই প্রয়োজনীয় রানরেট মোটের উপর বজায় রাখছিল। ভারত একশো পার করছিল ১৭.২ ওভারে। দক্ষিণ আফ্রিকার একশো পার করতে লাগল ভারতের থেকে মাত্র চারটে বল বেশি। অধিনায়ক এবং অটল ওপেনার উলভার্ডের সাথে সুন লুসের পার্টনারশিপ যখন বেশ জমে উঠেছে, তখন শেফালির হাতে বল তুলে দেন হারমনপ্রীত। সারা কেরিয়ারে শেফালি মাত্র চোদ্দো ওভার বল করেছেন একদিনের ম্যাচে। একটিমাত্র উইকেট পেয়েছিলেন ২০২২ সালে। তবে তাঁর ধীরগতির অফব্রেক বোলিং দক্ষিণ আফ্রিকার রানের গতি কমাতে সাহায্য করতে পারে ভেবেই বোধহয় তাঁকে আনা হয়েছিল আক্রমণে। শেফালি কিন্তু চমকে দিলেন। ব্যাট হাতে অসাধারণ প্রদর্শনের পর নিজের দ্বিতীয় বলেই ঝুঁকে বসে একটা ক্যাচ লুফে শেফালি লুসকে ফিরিয়ে দিলেন।
নামলেন ভেটেরান ক্যাপ। দক্ষিণ আফ্রিকার মহিলাদের ক্রিকেটে তিনি ভীষণ বড় এক প্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্ব। কেরিয়ারের সবচেয়ে বড় ওয়ানডে ম্যাচ, যা খুব সম্ভবত ক্যাপের শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচও বটে, খুব একটা সুখের হলো না অবশ্য তাঁর। বল হাতে শুরুটা ভাল করলেও উইকেট পাননি তিনি। রানও সেভাবে আটকাতে পারেননি। ব্যাট হাতে তিনি ফিরলেন মাত্র চার রানে। তাঁকে যিনি ফেরালেন, সেই শেফালির হাতে অবশ্য কাল ব্যাটে-বলে সোনা ফলছিল। ওই ডাউন দ্য লেগ বলে উইকেট পড়বে, অতি বড় ভক্তও এমন আশা করবেনা, কিন্তু দিনটা শেফালিরই ছিল। তাঁর দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বল ক্যাপের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ঠিকই আশ্রয় নিয়ে নিল রিচা ঘোষের দস্তানায়। তীক্ষ্ম রিফ্লেক্স না থাকলে এই ক্যাচটা ধরা বেশ কঠিন।

দীপ্তি-শেফালিদের বোঝাপড়া, বন্ধুত্বের কাছে হেরে গেলেন লরা উলভার্টরা।
এগারো বলের ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকা ১১৪/২ এর আপাতবিশ্বাস থেকে ১২৩/৪এর দুর্ভাবনায় পৌঁছে গেল। সত্যি বলতে, এরপরও অনেকবার স্কোরকার্ড দেখে বা রানরেট দেখে দক্ষিণ আফ্রিকার বেশ কাছাকাছি যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলেও, খেলা দেখে সেটা বোঝার জো ছিল না। ভারত খানিকটা ঢিলেই দিয়েছিল। তবুও দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মপ্রত্যয় বেশ তলানিতেই থেকে যায়। শেফালির স্পেলের ম্যাজিক শুধু দুটো উইকেটে সীমিত নয়, মানসিক ভাবে প্রতিপক্ষকে একরকম দুমড়ে দেওয়ার প্রভাবটাও অনস্বীকার্য।
প্রোটিয়া উইকেটরক্ষক জাফটাকে প্রথম থেকেই বেশ নড়বড়ে লাগছিল। দীপ্তি শর্মা আগেই পাঁচ ওভার বল করে ফেলেছিলেন। এতক্ষণ বিশেষ চমকপ্রদ লাগেনি তাঁর বোলিং। কিন্তু ইনিংসের শেষার্ধে দীপ্তি একাই মোটামুটি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়ের মহড়া নিয়ে নিলেন। তাঁর প্রথম শিকার হলেন জাফটা। কিন্তু পরের দশ ওভার ভারত সমর্থকদের বুকের ধুকপুকুনি বাড়িয়ে, অবিচল উলভার্ডের সাথে একটা পঞ্চাশ রানের পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছিলেন ডার্কসেন। বত্রিশ নম্বর ওভারে পরপর দুটো ছয়ও মেরেছিলেন তিনি রাধা যাদবকে। তবুও প্রয়োজনীয় রানরেট টুক টুক করে বেড়ে যাচ্ছিল। ভারতের ব্যাটারদের থেকে প্রায় চার ওভার বেশি খেলে ২০০ পার করল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবুও, ঊনত্রিশ ওভারের পর হাতে পাঁচ উইকেট নিয়ে ৬৬ বলে ৯২ রান বাকি থাকতে মনে হচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা আরেকটু আক্রমনাত্মক ব্যাটিং করলেই উত্তেজক সমাপ্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবেনা। তবে দীপ্তি শর্মা ভারতের ভক্তদের চিন্তার লেশটুকুও মোটামুটি মোচন করে দিলেন। ডার্কসেন ফিরলেন চাঁদমারি খসানো ইয়র্কারে।

বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার রাত দুর্বিষহ করে দিয়েছেন দীপ্তি শর্মা।
উলভার্ডের অসম লড়াই শেষ হলো বিয়াল্লিশতম ওভারে। সেমিফাইনালে দুর্দান্ত শতরানের পর ফাইনালেও তিনি সেঞ্চুরি করলেন। আগাগোড়া একশোর উপর স্ট্রাইক রেট বজায় রেখে তিনি একটা দিক ধরে রেখেছিলেন। তিনি একা এই ম্যাচটা জেতাতে পারতেন না। তবে তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে কেউ যদি আরেকটু টিকে যেতে পারত, তাহলে তাঁর এই নিয়ন্ত্রিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত নাছোড় ইনিংস মহিলাদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে একটা অবিস্মরণীয় কীর্তি হতো। কিন্তু দিনের শেষে তাঁকে ট্র্যাজিক নায়িকা হয়েই থাকতে হলো। একশো পেরোনোর পর বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস প্রকাশও করেননি তিনি। তারপর আর দুটো বল টিকেছিলেন উনি। বড় শট মারার বাধ্যবাধকতা যখন প্রায় জাঁকিয়ে বসেছে, তখন আউটফিল্ডে উলভার্ডকে ক্যাচআউট করেন অমনজ্যোৎ। যে ম্যাচে বেশ কয়েকটা ক্যাচ পড়েছে, তাতে এটাও ফস্কাবে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু শেষে অমনজ্যোৎ বলটা তালুবন্দি করলেন খানিক জাগলিংয়ের পর। এক ওপেনারকে রানআউট করার পর, তাঁর পার্টনার এবং সেঞ্চুরিয়ান উলভার্ডের ক্যাচ ধরে অমনজ্যোৎ মোটামুটি ম্যাচ এবং বিশ্বকাপ ভারতের ঝুলিতে ভরে ফেললেন। দুশো কুড়ি রানে পড়ল সপ্তম উইকেট। আর দুশো একুশে পড়ল আট নম্বরটা। দীপ্তি একই ওভারে দুখানা উইকেট নিয়ে প্রোটিয়াদের রাতটা আরও দুর্বিষহ করে দিলেন।।
ডে ক্লার্ক খানিকটা লড়াই করেছিলেন। কিন্তু প্রতি ওভার শেষে সিঙ্গেল নিয়ে তাঁর টেলএন্ডার পার্টনারকে বাঁচানোর চেষ্টা শেষপর্যন্ত বিশেষ ফলপ্রসূ হলো না। খাকা কিপার্স এন্ডে রানআউট হলেন পঁয়তাল্লিশতম ওভারের শেষ বলে। রানআউটের জন্য বলটা রিচা ঘোষের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সেই দীপ্তি শর্মাই। ছোটবেলায় যখন দাদার প্র্যাকটিস দেখতে যেতেন দীপ্তি, তখন একবার মাঠের বাইরে গড়িয়ে আসা বল তিনি থ্রো করে পঞ্চাশ মিটার দূরে স্থিত স্টাম্পে নিখুঁত ভাবে হিট করেন। বায়না করে দাদার প্র্যাকটিস দেখাতেই ভাগ্যিস আর সীমিত থাকেনি দীপ্তির ক্রিকেট-অভিযান।
পরের ওভারে সেই তিনিই বল করতে এসে বিশ্বকাপ জয়ে শিলমোহর দিয়ে দিলেন। অধিনায়ক হারমনপ্রীত ক্যাচটা সুন্দর ধরলেন এক্সট্রা কভারে। প্রোটিয়া ইনিংসের শেষ ছটা উইকেটের পাঁচটা এল দীপ্তির বলে, আরেকটা এল দীপ্তির থ্রোয়ে। ব্যাট হাতে অর্ধশতকের পাশাপাশি বল হাতে এই প্রদর্শন মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে দুটো ফাইনাল হারবার পর অবশেষে এবার ভারত জিতে নিল প্রথম বিশ্বকাপ। ২০০৩-এর মতোই ২০১৭-এ লেগে ছিল শেষ পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হওয়ার যন্ত্রণা। আবারও আট বছরের ব্যবধানে নিরাময় হলো সেই ক্ষত। মুম্বইয়ের একটা দোসরা এপ্রিল আমরা দেখেছিলাম। মুম্বইয়ে একটা দোসরা নভেম্বরও আমরা দেখলাম।

Whatsapp
