হাতে সময় দু'বছর— ছায়ার কাছেই ভারতের টেস্ট দলকে নতজানু হতে হবে

Gautam Gambhir: গম্ভীর ম্যাচ শেষে স্বীকার করেছেন যে দলকে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। ২০২৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত আর কোনও টেস্ট না থাকায় সময়ও যথেষ্ট।

MG

১৯৭৬ সালে টনি গ্রেগের কুখ্যাত ‘গ্রোভেল’ মন্তব্যে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটাররা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, সেই ক্ষোভই পরিণত হয়েছিল বিধ্বংসী প্রতিশোধে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আবারও সেই ইতিহাস ফিরে এল।এবার দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ শুকরি কনরাডের কণ্ঠে। কিন্তু তাতে কি ভারতের খেলায় কোনও পরিবর্তন হলো? না, বরং দৃশ্যপটে ফুটে উঠল এক বিভ্রান্ত, দুর্বল এবং জড়সড় ভারতীয় দল। গুয়াহাটির দ্বিতীয় টেস্টে ভারত পুরোপুরি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। মাত্র ১৪০ রানে অলআউট । ৪০৮ রানের বিশাল পরাজয়। দুই ইনিংস মিলিয়েও ছুঁতে পারল না রানের ব্যবধান! ২০০০ সালের পর প্রথমবার দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ঘরের মাঠে সিরিজ হারল ভারত। তার উপর পরপর দুই বছর ঘরের মাঠে দু’টি সিরিজ হার। এমন হতাশাজনক পরিসংখ্যান শেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৩-৮৪ মরসুমে।

ফলে গৌতম গম্ভীরের নামে জুড়ল আরও একটি রেকর্ড—ভারতের প্রথম কোচ যাঁর অধীনে টানা দুই হোম সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হতে হল ভারতকে।

কেন এই পতন?

গম্ভীর ম্যাচ শেষে স্বীকার করেছেন যে দলকে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। ২০২৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত আর কোনও টেস্ট না থাকায় সময়ও যথেষ্ট। কিন্তু সেই পুনর্গঠনের শুরু হতে হবে মূল থেকে। ওয়াশিংটন সুন্দরকে নিয়ে গম্ভীর সংবাদমাধ্যমকে উপদেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁকে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সঙ্গে তুলনা না করা হয়। কিন্তু তাঁকেই দলের ব্যবস্থাপনা নানা ভূমিকায় ঠেলে দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। প্রথম টেস্টে ইডেনে তাঁকে হঠাৎ তিন নম্বরে নামানো হয়—অভিজ্ঞতা ও প্রস্তুতি ছাড়াই। পরিসংখ্যান বলে, ভারত সে ম্যাচে দুই ইনিংসে ২৮২ রান করলেও সুন্দর একাই করেন ৬০; সর্বাধিক ১৭৪ বল খেলেন। অথচ গুয়াহাটিতে তাঁর ব্যাটিং পজিশন নেমে গেল আটে। একইভাবে নীতিশ কুমার রেড্ডিকে ‘সিম-বোলিং অলরাউন্ডার’ হিসেবে তুলে ধরা হলেও তাঁর দশ টেস্টে মোট ওভার সংখ্যা মাত্র ৮৬। কলকাতায় দলে রাখা, পরে তাঁকে রাজকটে ভারত ‘এ’-তে পাঠানো, আবার ফিরিয়ে আনা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। গুয়াহাটিতে ২৩০ ওভারের মধ্যে তাঁর ভাগে এল মাত্র ১০ ওভার!
সাই সুদর্শনের ক্ষেত্রেও একই গোলমাল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দিল্লিতে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস (৮৭ ও ৩৯) খেলার পর তিন নম্বরে তাঁকেই রেখে দেওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু কলকাতায় তিনিই বাদ! গিল চোট না পেলে গুয়াহাটিতে হয়তো থাকাও হতো না তাঁর। কমেন্ট্রিতে রবি শাস্ত্রীও ক্ষোভ লুকোতে পারেননি, “এটা বোঝা দুষ্কর। এক টেস্টে সুন্দর ৩ নম্বরে, পরের টেস্টে ৮ নম্বরে! চার স্পিনার নিয়ে নামলেও এক জনকে মাত্র এক ওভার বল করানো কেন, যুক্তির অভাব স্পষ্ট।”

আরও পড়ুন- শুধু ক্রিকেট নয়, খেলা ঘুরছে ফুটবল মাঠেও, নেপথ্যে অভীষ্টারা

প্রাক্তন নির্বাচক কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্তও একই সুরে বলেছেন “প্রতি ম্যাচে নতুন নতুন ডেবিউ। এটা কোনও স্থায়িত্বের চিহ্ন নয়।”
ইংল্যান্ড সফরে কুলদীপ যাদবকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তিনিই দেখালেন কেন তাঁকে ‘শুধু স্পিনার’ ভাবা ভুল। তবু ভারত দলের অলরাউন্ডার-মোহ বাড়তেই থেকেছে—কখনও সুন্দরকে ৩ নম্বরে পাঠানো, কখনও রেড্ডিকে ব্যাটিং-অলরাউন্ডার হিসেবে রাখা, অথচ বলই না করানো। আরও গুরুতর সমস্যা হলো আইপিএল-নির্ভর প্রতিভা মূল্যায়ন। রঞ্জি বা দিলীপ ট্রফিতে ধারাবাহিক সফলতার উপর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সুদর্শন, রেড্ডি, জুরেলের মতো খেলোয়াড়ের ফার্স্ট-ক্লাস ম্যাচের অভিজ্ঞতা ৪০ কোটাও পেরোয়নি।

ভেঙ্কটেশ প্রসাদ স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, “অলরাউন্ডারদের পিছনে ছোটা পুরো ব্রেনফেড। যশ রাঠোর, শুভম শর্মা, বাবা ইন্দ্রজিৎ যারা আইপিএল-এ নেই কিন্তু রঞ্জিতে সফল,তাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।”

গম্ভীর সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “সমালোচকরা ভুলে যাচ্ছেন যে আমিই ইংল্যান্ডে তরুণ দল নিয়ে জিতে এসেছিলাম। আমিই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ও এশিয়া কাপে সাফল্য পেয়েছি।” কিন্তু সেসব সাফল্য সাদা বলের ক্রিকেটে। যে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারত ড্র করেছে, সেই দলই আজ বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ষষ্ঠ স্থানে। গম্ভীর সময়সূচিকেও কারণ ঠাওরেছেন। অনভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দল নির্বাচনের দায় কার? নতুনদের সুযোগ দেওয়াই সঠিক, কিন্তু এলোমেলো পজিশন ও অসংগত ভূমিকায় তাদের ঠেলে দিলে ক্ষতি আরও বাড়বে। ভারতীয় ক্রিকেটে প্রতিভার অভাব নেই, অর্থসংস্থানও প্রচুর। অভাব কেবল দূরদৃষ্টি, স্থির পরিকল্পনা আর জবাবদিহির। দলের ভিতরে যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, অস্থির ব্যাটিং অর্ডার, ভুল দল নির্বাচন, পরীক্ষানিরীক্ষা আসন্ন ভবিষ্যৎকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।
আগামী টেস্টের আগে ভারতীয় দলের হাতে সময় আছে প্রায় দু'বছর। সেই সময়কে ব্যবহার করতে হবে আত্মসমালোচনায়, পুনর্গঠনে। নইলে ‘গ্রোভেল’ বিতর্ক নয়,নিজেদেরই ছায়ার কাছে ভারতীয় ক্রিকেটকে নতজানু হতে হব।

More Articles