বিজয়ের আড়ালে বঞ্চনার ইতিহাস: মহিলা ক্রীড়াবিদদের যন্ত্রণার আখ্যান
women athletes struggle: ভিনেশের প্রতি হওয়া বঞ্চনার দশ বছর আগে, দক্ষিণ কোরিয়ার এশিয়ান গেমসের আসরে, পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ব্রোঞ্জ পদক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মণিপুরী বক্সার সারিতা দেবী।
মেয়েদের ক্রিকেটে ভারতের বিশ্বকাপজয় নির্দ্বিধায় জাতীয় ক্রীড়ার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকার আধিপত্যকে চূর্ণ করে বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লড়াই করে ছিনিয়ে নেওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না হারমনপ্রীতদের কাছে। সেই অসাধ্য তাঁরা সাধন করে দেখিয়েছেন। ফলে হেমন্তের বিকেলগুলো এখন উৎসবমুখর রিচা, দীপ্তি, জেমিমা নিয়ে। উৎসবের এই আলোর মাঝে আমরা যেন ভুলে না যাই সেই সকল ভারতীয় মহিলা ক্রীড়াবিদদের, যাঁরা প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াই করে স্বপ্ন দেখেছিল বিশ্বকে জয় করার। সামাজিক ও প্রশাসনিক বঞ্চনার মাঝেও তাদের স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা ও লড়াই করে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছেগুলোকে যেন আমরা মনে রাখি। বিজয় উল্লাসের এই মাসে লড়েও ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার প্রতি আমাদের যেন সমবেদনা ও একই সঙ্গে কুর্নিশ থাকে।
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে কুস্তিগীর ভিনেশ ফোগটের মরণপণ লড়াইকে আমরা যেন ভুলে না যাই। অলিম্পিক ট্রায়ালে ওজন সংক্রান্ত জটিলতায় বাতিল না হলে তিনি হয়ত নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতেন। ট্রায়ালের আগের রাতে ওজন কমানোর জন্য তার মরণপণ চেষ্টার মুহূর্তগুলোকে আমরা যেন ভুলে না যাই। নিজেদেরকে 'বিশ্বগুরু' দাবি করে, ক্রমাগত ঢাক পিটিয়ে যাওয়া আমরা, ভিনেশকে ন্যায় দিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। উল্টে কিছু জনপ্রতিনিধির কটূক্তির শিকার হতে হয় ভিনেশকে। আজ বিশ্বক্রিকেটে ভারতীয় মেয়েদের সাফল্যের উপর ভাগ বসাতে ছুটে আসা পুরুষতন্ত্র সেদিন ভিনেশের প্রতি উদাসীন ছিল।

ক্রন্দনরত ভিনেশ ফোগট
ভিনেশের প্রতি হওয়া বঞ্চনার দশ বছর আগে, দক্ষিণ কোরিয়ার এশিয়ান গেমসের আসরে, পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ব্রোঞ্জ পদক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মণিপুরী বক্সার সারিতা দেবী। তিনি দাবি করেছিলেন, সেমিফাইনাল ম্যাচে পয়েন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। সেদিন তাঁর চোখের জলের পাশে কোনো নামী বা প্রভাবশালী পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। হেরে যাওয়ার পর, ক্রীড়াবিদদের মনে পরাজয়ের গ্লানি কাজ করে। সেই পরিস্থিতিটাকে সামাল দেওয়ার জন্য সাপোর্টিং স্টাফের বিশেষ ভূমিকা থাকে। কিন্তু সারিতা দেবীর ক্ষেত্রে গোটা পরিস্থিতিটাই প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। যদিও পরে নিজের কেরিয়ার বাঁচানোর জন্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনের দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন- মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে
নব্বইয়ের দশকে হওয়া অলিম্পিকগুলোতে ভারতের অবস্থান একেবারে তলানির দিকে ছিল। '৯২- এর খালি হাত। '৯৬-এর সহায় লিয়েন্ডার পেজের ব্রোঞ্জ। ভারোত্তোলক কর্ণম মালেশ্বরীর ব্রোঞ্জ পদকটা না থাকলে, ২০০০ সিডনি অলিম্পিক থেকে ভারতকে খালি হাতে আসতে হতো। বিশ্বমঞ্চে একার কাঁধে দেশের নাম উজ্জ্বল করেও পাদপ্রদীপের বাইরেই থেকে গিয়েছেন তিনি। সেই সময় দাঁড়িয়ে পুরুষ ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যর্থ হয়েও একটার পর একটা ব্র্যান্ড এনডোর্স করে গিয়েছেন। ক্রীড়া থেকে শুধুমাত্র ক্রিকেট সাংবাদিক-এ নিজেদের পরিবর্তন করে নেওয়া প্রচারযন্ত্রও কর্ণম মালেশ্বরীর প্রতি উদাসীন থেকে গিয়েছে। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে অভিনব বিন্দ্রার সোনা জয়কে এদেশের সিংহভাগ ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ মাইলফলক হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু, শুটিংয়ে সাফল্যের সলতে পাকানোর কাজ, অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর সেটা করে দেখিয়েছিলেন মহিলা শুটার অঞ্জলি ভাগবত। কিন্তু প্রচারের বৃত্ত থেকে তিনি বাইরেই রয়ে গেলেন। মহিলাদের ব্যাডমিন্টনের ডাবলস বিভাগে অশ্বিনী পোনাপ্পা ও জ্বালা গাট্টা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গড় সামলেছিলেন। নিজেদের সেরা সময়েও তাঁদের ওপর প্রচারের আলো পড়েনি। এই তালিকা হয়ত দীর্ঘ থেকে আরও বেশি দীর্ঘতর হবে। সেখানে বুলা চৌধুরী, আরতি সাহা, দীপা কর্মকার, অঞ্জুববি জর্জ ও বহু মহিলা ক্রীড়াবিদের নাম থাকবে। যাদেরকে সমাজ, প্রশাসন ও প্রচার মাধ্যম বঞ্চিত করে এসেছে। যাদের জীবনের রোজনামচার খবর কেউ রাখেনি। দুর্বল পরিকাঠামো, দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রীড়া পরিবেশ, অপর্যাপ্ত পুষ্টির মধ্যেও তাঁরা সংগ্রাম করে গিয়েছেন। সেই সংগ্রামকে যেন আমরা কোনোদিন ভুলে না যাই। আমার-আপনার পাড়ার যে মেয়েটি প্রত্যেকদিন সকালে উঠে জ্যাভলিন নিয়ে ছুটে চলে বা টেবিল টেনিস খেলে, তার পাশে যেন আমরা অন্তত গিয়ে দাঁড়াই। তার সাফল্যের প্রতি যেন আমাদের সমীহ থাকে।
দিল্লির রাজপথে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহরীরা যেভাবে অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগীর সাক্ষী মালিকের উপর এবং অন্যান্য কুস্তিগীরদের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল, সেসব যেন কোনোদিন আমাদের স্মৃতিপট থেকে মুছে না যায়। পুলিশি হেফাজতে পিঙ্কি প্রামাণিকের উপর হওয়া শারীরিক নির্যাতনের ছবি প্রকাশ্যে আসতেই গর্জে উঠেছিলেন কবীর সুমন। এ নিয়ে একটি কবিতাও তিনি লিখেছিলেন। আজ উৎসবের উল্লাসে সেগুলো যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা যেন প্রশ্ন করতে শিখি— পুরুষ ক্রিকেটের প্রাক্তন বাঙালি ভারত অধিনায়ককে নিয়ে যদি 'দাদাগিরি'র মতো রিয়েলিটি শো হতে পারে, তাহলে 'চাকদা এক্সপ্রেস'কে (ঝুলন গোস্বামী) নিয়ে কেন 'দিদিগিরি' হবে না? গণতন্ত্র ও লিঙ্গসাম্য তখনই রক্ষিত হবে যখন আমরা সচেতন হয়ে প্রশ্ন করতে শিখব। আর তখনই প্রশ্ন করতে শিখব যখন আমাদের স্মৃতিপট থেকে এসব ঘটনা মুছে যাবে না।

Whatsapp
