ঠাট্টা চিরকাল টেকে না, টিকে যান বাভুমারা
Temba Bavuma: দ্বিতীয় ইনিংসের পিচ, যেন বেহিসেবি জন্তু। লাফায়, কামড়ায়, আঁচড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন একটার পর একটা ভেঙে পড়ল। সিনেমার মতো ধস। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন। সেই ছোট শরীর। সেই অকল্পনীয় ধৈর্য।
ক্রিকেট ভোলে না। এটাই তার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। আর সবচেয়ে বড় নিষ্ঠুরতাও। ইডেন গার্ডেনে তিন দিন। নভেম্বরের হালকা শীতের উত্তপ্ত গ্যালারি। পিচে ধুলো, আর স্টাম্প-মাইকের দুষ্টু ফিসফাস। যেখানে সকল দর্শকের মনের উপর হালকা আঁচড় কেটেছিল একটি মন্তব্য। একটু হাসি। একটু তাচ্ছিল্য। একটি শব্দ—বাউনা।
ভারতীয় ক্রিকেট সংস্কৃতির গায়ে জ্বালা ধরানোর মতোই যথেষ্ট। জসপ্রীত বুমরাহ বলে ফেলেছিলেন। মুহূর্তের আবেগে, অথবা মাঠের উত্তেজনায়। যদিও বাকিরাও সঙ্গ দিয়েছিলেন। কিন্তু শব্দের এই ব্য়বহার ভারতীয় দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট সংস্কৃতি প্রতিপক্ষকে ছোট করা শেখায় না। শিখিয়েছে লড়াই। শিখিয়েছে সম্মান।
শব্দটি প্রক্ষেপণের পরেই ইডেনে নেমে এসেছিল বুমরাহ-ঝড়। ৫/২৭। দক্ষিণ আফ্রিকা ঠেকল ১৫৯-এ। ইডেন যেন তাঁর তালুর রেখা। দক্ষিণ আফ্রিকা ধসে পড়ল। ভারত এগিয়ে গেল। সব ঠিক ছিল। কিন্তু ক্রিকেট এমনই খেলা, কখন, কোথায়, কীভাবে উত্তর দিতে হবে— ক্রিকেট জানে। আর অবিশ্বাস্যভাবে, সেই উত্তরের নাম টেম্বা বাভুমা। এই মানুষটির উচ্চতা নিয়ে যতখানি কথা হয়, তার অর্ধেকও হয় না তাঁর চরিত্র নিয়ে। কেপটাউনের ল্যাঙ্গা এলাকায় বড় হওয়া ছেলেটি কখনও বিলাসিতা দেখেনি। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবিদ্বেষের দাগ তখনও সমাজে টাটকা। ক্রিকেট সেই সমাজে নীল-রক্তদের খেলা। বাভুমা, তাই ছিলেন এক ব্যতিক্রম। এক প্রশ্নচিহ্ন। এক উদাহরণও। তিনি যখন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার, তখন তা শুধু ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত ছিল না—ছিল রাজনৈতিক স্ফুলিঙ্গ। সমাজের বিবর্তনের এক প্রতীক। কথা চলত—“তিনি এত ছোট! তিনি কি টেস্ট অ্যাভারেজ টানতে পারবেন? তিনি কি বড় দলের বিরুদ্ধে টিকে থাকবেন?” হাসাহাসি চলত। মিম বানানো হতো। বিদেশি পত্রিকার এক অংশ বলেছিল— “বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য বাভুমা অত্যন্তই ক্ষুদ্র।” ছোট? শরীরে? অবশ্যই। কিন্তু মেরুদণ্ডে?
আরও পড়ুন- মাঠে জয়, সমাজে লড়াই; খেলাধুলোর মেয়েরা যে লড়াই লড়ছে
দ্বিতীয় ইনিংসের পিচ, যেন বেহিসেবি জন্তু। লাফায়, কামড়ায়, আঁচড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন একটার পর একটা ভেঙে পড়ল। সিনেমার মতো ধস। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন। সেই ছোট শরীর। সেই অকল্পনীয় ধৈর্য। বাভুমা। ক্রিকেট যাঁকে ‘মাইনর’ ভাবতে শিখেছিল, সেই মুহূর্তে বাভুমা ব্যাট হাতে হয়ে উঠলেন একা দ্বীপ। নীরব দৃঢ়তা। সংযম।
বাভুমার সংগ্রহ ৫৫। পুরো খেলার একমাত্র হাফ-সেঞ্চুরি। একটা দেশের সম্মান যেন একাই কাঁধে তুলে নিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে টেনে নিয়ে গেলেন ১৫৩-এ। ভারতের সামনে ১২৪। দেখতে সহজ। বাস্তবে দুঃস্বপ্ন। ইডেনের সেই তিন দিনের পিচে প্রায় অতিক্রম্য। বাভুমা থামলেন না। মাঠে যখন শেষ লড়াই। ভারতের শেষ আশা উঠল আকাশে। আর ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা বাভুমার কাছে গিয়ে বলল, “স্কিপার, এই জয় তোমার।” আর মাঝমাঠে এক উড়ন্ত ক্যাচ নিয়ে, তিনি ম্যাচের নিয়তি নিজেই রচনা করলেন। এক লাফ। দুই হাতে বাভুমা তাঁর মতো কতশত ঠাট্টায় হারিয়ে যাওয়া মানুষকে জিতিয়ে দিলেন।
ভারত ৯৩। ১২৪ নেই। এবার গল্প পাল্টে গেল। ক্রিকেট তার নৈতিক বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। বাভুমার দিকে হাত বাড়িয়ে বুমরাহ স্বীকার করে নিলেন, ক্রিকেটে ভুল হয়, উত্তেজনা থাকে, বেহিসেবি শব্দ খরচ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ শব্দ নয় সেটা, কত হাসিকান্না চুনিপান্না জমে থাকে ২২ গজের জমিতে।
আরও পড়ুন- সংকল্প জয়, প্রতিটি রান ধ্যান, ক্রিকেট ধর্মের সন্ন্যাসিনী জেমাইমা
বাভুমার টেস্ট লিডারশিপ? ১১ টা খেলা। ১০ টা জয়। ১ টা ড্র। হার শূন্য। এককথায় অপরাজেয়। বিশ্বে এরকম রেকর্ড আর তেমন নেই। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক ধ্বংসস্তূপের মাঝে। কিন্তু তাঁর কেরিয়ারে সবচেয়ে বড় সাফল্য এ সব নয়। সবচেয়ে বড় সাফল্য—সমালোচনাকে চ্যালেঞ্জে বদলে দেওয়া। ২০১৬ সালে তিনি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ব্যাট হাতে লড়াই শুরু দেশের মাটিতেই। সেটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেট ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট। সেই সেঞ্চুরি নিয়ে হাসাহাসিও হয়েছিল, “কেপটাউনের সমুদ্রের হাওয়া ছাড়া সে পারে না।” ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, “তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত নন।” কিন্তু বাভুমা মাঠে ফিরলেন। তিনি যে শুধু ব্যাটার নন, একজন মনস্তত্ত্বে পটু ক্রীড়াবিদ। বাউন্সার খেয়ে উঠে দাঁড়ান। বল ছুটে আসলে দম নেন। দল ভেঙে পড়লে নিজের নোটবুক থেকে বলেন—“লড়াই করে যাও।” বাভুমার কৃতিত্বের শেষ নেই। আবার তাঁর লড়াইয়েরও শেষ নেই। বাভুমা উত্তর দেন না। তাঁর হয়ে উত্তর দেয় ক্রিকেট।
রবিবারের ইডেনের ম্যাচ তাই শুধু স্কোরকার্ড নয়। এটা চরিত্রের লড়াই। দুই দলের অহংকার। এবং একজন মানুষের নীরব প্রতিশোধ। বুমরাহ ৫ উইকেট নিলেন। অসাধারণ বোলিং করলেন। কিন্তু শেষ লাইনে গল্পটা চলে গেল এক মানুষের দিকে, যাঁর উচ্চতা নিয়ে গতকাল ঠাট্টা হয়েছিল, আর আজ ইতিহাস তাঁকেই মাথায় তুলেছে। টেম্বা বাভুমা। এক দেশের সামাজিক যন্ত্রণার উত্তর। এক ক্রিকেটারের মাঝে লুকিয়ে থাকা জেদ। এই খেলা তাই আবার শেখাল, ঠাট্টা চিরকাল টিকে থাকে না। থাকে চরিত্র।
Whatsapp
