হারমনপ্রীতরা দূত, স্বপ্নটা দেখেছিলেন ঝুলন-মিতালীরা
ICC Women's World Cup India 2025: ঝুলন গোস্বামী, মিতালী রাজেরা যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন সেটা আজ পূরণ হলো হারমনপ্রীতদের হাত ধরে। এই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের দেখে আগামী প্রজন্মের মেয়েরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে।
রবিবার, ২ নভেম্বর মায়ানগরীর ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে বিশ্বজয় করল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। হারমনপ্রীত কৌরের নেতৃত্বে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল ৫২ রানে পরাজিত করল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তবে, ভারতের ২০২৫ সালের নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় শুধু বর্তমান দলের সাফল্য নয়— এটি আসলে দীর্ঘ দশকের পরিশ্রম, অধ্যবসায়, এবং নারী ক্রিকেটের পথিকৃৎদের আত্মত্যাগের এক গৌরবোজ্জ্বল পরিণতি। আজ যে ভারত বিশ্বমঞ্চে নারী ক্রিকেটে শীর্ষে পৌঁছেছে, তার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন কয়েকজন কিংবদন্তি। তাঁদের হাত ধরেই ভারতীয় নারী ক্রিকেট আজ এই উচ্চতায়।
১৯৭৮ সালে যখন ভারত প্রথমবার মহিলাদের ক্রিকেট আয়োজন করেছিল, তখন ভারতের অধিকাংশ মানুষ জানতেনই না ভারতের একটা মহিলা ক্রিকেট দল রয়েছে। লোকাল ট্রেনে ঠেসাঠেসি করে যাত্রা করে, নিজের টাকায় ইউনিফর্ম, ব্যাট বল কিনে প্র্যাকটিস করে সেই বছর বিশ্বকাপে পৌঁছেছিল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। তবুও, তাদের খেলা দেখতে মাঠে আসেনি দর্শক, সংবাদপত্রের খেলার পাতায় স্থান পায়নি মেয়েদের সেই লড়াই। তবু, ডায়ানা এডুলজি, নিতু ডেভিড, সন্ধ্যা আগরওয়ালের মতো খেলোয়াড়রা সেদিন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এই বিশ্বকাপে কোনো অর্থ ছিলনা, নাম, যশ, খ্যাতি ছিল না। না ছিল কোনো সম্প্রচার, কেউ শুনতে চায়নি তাদের কাহিনি। তবে তাদের মধ্যে ছিল একটা ভালোবাসা— খেলার প্রতি একটা অদম্য ভালোবাসা।
আসলে ১৯৭৮ থেকে ২০২৫, এই গল্পটা শুধু ক্রিকেটের গল্প নয়— এটা এন শ্রীনিবাসনের মতো মানুষদেরকেও চ্যালেঞ্জ করার গল্প যারা বলেন, "নেহাত আইসিসি বলেছে তাই, নাহলে হাতে থাকলে মেয়েদের ক্রিকেট খেলাটাই তুলে দিতাম।" ২০২২ সালে যখন বিসিসিআই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল এবং পুরুষ ক্রিকেট দলের পারিশ্রমিক সমান করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন স্পনসররা প্রশ্ন তুলেছিলেন, মহিলা ক্রিকেটে কি আদৌ লাভ হয়? সেই প্রশ্নেরও আজ যোগ্য জবাব দিল ভারতের মেয়েরা।
আরও পড়ুন- ক্রিকেট শুধু ক্রিকেট নয়, জয়ের অন্তরালে আছে মেয়েদের পঞ্চাশ বছরের লড়াই
১৯৭৮ সালে যখন ডায়ানা এডুলজির নেতৃত্বে ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে, সে'সময় ক্রিকেট খেলাটা ভারতের মেয়েদের জন্য একেবারেই সহজ ছিল না। শহরের খুব প্রগতিশীল বাড়ির মেয়েরাই খেলার অনুমতি পেতেন। না ছিল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, আর না ছিলেন সেরকম ভালো প্রশিক্ষক। তবে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই দল রচনা করেছিল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ভিত। আর সেই ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে ২০২৫-এ যখন ভারতের কন্যারা বিশ্বজয় করল তখন ডায়ানা এডুলজির চোখের কোনায় দেখা গেল জল। বললেন, "আমি ভাষাহীন। এটা আমার জীবনের গর্বের মুহূর্ত। খেলোয়াড় এবং প্রশাসক হিসেবে পঞ্চাশ বছর ধরে এই মাঠে আছি— আজ মনে হচ্ছে সেই তারাটা অবশেষে জার্সিতে এসে জুড়েছে।”

ভারতের মেয়েদের বিশ্বজয়
২০০৫ সালে ভারতীয় মহিলা দল প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে। ঝুলন গোস্বামী, অঞ্জুম চোপড়ার সেই দলের হাজার প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে হয়ে উঠেছিল এক দৃঢ় প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু, ট্রফিটা অধরাই থেকে যায় অঞ্জুম ঝুলনের। তবুও সেই টুর্নামেন্টে বীজ পুঁতেছিলেন তাঁরা। প্রতি ম্যাচে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাওয়ার পরেও তাদের খেলার উদ্যম প্রমাণ করেছিল ভারতীয় দল কিছু না কিছু করে দেখাবেই।
তারপর ২০১৭। লর্ডসের ময়দানে ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও ইংল্যান্ড। পুনম রাওয়াত, মিতালী রাজের ব্যাটিং ঝুলন গোস্বামীর বোলিং সবকিছুই ঠিকঠাক এগোলেও, শেষ রক্ষা হয়নি সেদিনও। লর্ডসের মাঠ ভর্তি দর্শকের সামনে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল ঝুলন-মিতালীদের। তবে ইংল্যান্ডের কাছে ৯ রানের সেই হার ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে মহিলা ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর সেই ২০১৭-এর ব্যথার সিঁড়ি পেরিয়েই আজ ২০২৫ সালে বিশ্বজয় করল ভারতের মেয়েরা।
আরও পড়ুন- লাইমলাইট থেকে শত হস্ত দূরে দীপ্তি-রিচাদের যেভাবে গড়েছেন অমল মুজুমদার
ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের এই লড়াইয়ে একজনের নাম নিতেই হয়। তিনি চাকদহ এক্সপ্রেস, ঝুলন গোস্বামী। প্রায় দুই দশক ধরে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের হয়ে বোলিং করেছেন ঝুলন গোস্বামী। তবে কোনোদিন বিশ্বকাপ হাতে পাননি। ২০২২ সালে বিশ্বকাপে পরাজিত হওয়ার পর যখন তিনি অবসর ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছেন মনে মনে, তখন হারমনপ্রীত, স্মৃতি ও জেমিমা তাঁর ঘরে এসে বলেন। "২০২৫ সালে তুমি খেলবে কিনা জানিনা, তবে ২০২৫ সালে আমরা বিশ্বকাপ জিতব, তোমার জন্য জিতব!"

বিশ্বকাপ জয়ের পর ঝুলন গোস্বামীর সঙ্গে সেলিব্রেশন ভারতের ক্রিকেট টিমের মেয়েদের
২০২৫ এ পূর্ণ হয়েছে সেই প্রতিশ্রুতি। জিতেছে ভারত। ঝুলনের চোখে জল, ভারী গলায় ঝুলন বললেন, " বলেছিল আমার জন্য ট্রফি জিতবে—সত্যিই কথা রেখেছে!" তাই এই সাফল্য শুধুমাত্র স্কোরলাইনের জয় না — এটা ভারতের মহিলা ক্রিকেটের প্রতিটা প্রজন্মকে এক সূত্রে বেঁধে দেওয়ার সাফল্য। ট্রফি জিতে হরমন অ্যান্ড কোং প্রমাণ করে দিয়েছে, "Cricket is everyone's Game"। জয়ের পরেও সেই চিরাচরিত লড়াইয়ের সুরে হরমনপ্রীত বলছেন, "আমরা এত বছর ধরে বলছি, বড় টুর্নামেন্ট না জিতলে কোনো পরিবর্তন আসবে না।"

বিশ্বকাপ হাতে মিতালী রাজ
এত বছরের অপেক্ষার পর আজ ভারতের ঝুলিতে এসেছে বিশ্বকাপ। পরিবর্তন এসেছে ভারতের মহিলা ক্রিকেটের পরিকাঠামোতে। শুধু মহিলারাই আজ মহিলা ক্রিকেটারদের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন না, তাদের সঙ্গ দিতে রয়েছেন পুরুষরাও। ২০২৩ সালে শুরু হয়ে উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগ ভারতের মহিলা ক্রিকেটকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের প্রতিভাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে প্রতি ম্যাচে। আজ দেশের ছোট থেকে বড় সব শহরে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের সেন্টার রয়েছে। সবাই আজ মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে গর্ব করেন। শেফালি বর্মার মতো এখন আর ছেলেদের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে গিয়ে ক্রিকেট শিখতে হয়না মেয়েদের। হরিয়ানা থেকে বিশাখাপত্ত্নম, পঞ্জাবের মোগা থেকে বাংলার শিলিগুড়ি সব জায়গায় চলছে সেলিব্রেশন। মহিলা ক্রিকেটের এই উত্থান একদিনে হয়নি, বহু বছর ধরে বীজ বপন হয়েছিল এই সাফল্যের। ঝুলন গোস্বামী, মিতালী রাজেরা যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন সেটা আজ পূরণ হলো হারমনপ্রীত, স্মৃতি, দীপ্তি, শেফালিদের হাত ধরে। এই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের দেখে আগামী প্রজন্মের মেয়েরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে। আর হয়তো তাদের কাঁধে ভর করে ২০২৬ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ ঘরে তুলবে ভারতের মহিলা দল।

Whatsapp
