খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে

Virat Kohli Masterclass Comeback: সময়ের সঙ্গে ক্রিকেটের রূপ গতি সবই বদলেছে। কিন্তু শিল্পীর নিজেকে প্রমাণের দায়? বদলায়নি। এখানে লড়াইটা যে একান্তই নিজের, ছায়ার সঙ্গে কুস্তি। কোহলির সাম্প্রতিক ইনিংসগুলি যেন সেভাবেই নিজের স...

AP

ক্রিকেটের ইতিহাসে বডিলাইন সিরিজের ক্ষত এখনও সবচেয়ে নৃশংস স্মৃতি। শরীর,মন ভেঙে পড়ার পরও ১৯৩৪-এর অ্যাশেজে ডন ব্র্যাডম্যান যখন ফিরে আসেন- শূন্য থেকে নতুন করে শুরু করেন; বোল্টন ট্রমার পর ১৯৬ রান করেন লেন হাটন বা পাকিস্তানের ইনিংস রক্ষা করতে হানিফ মোহাম্মদ যখন ব্রিজটাউনে ১৯৫৮ সালে ১৬ ঘণ্টার ইনিংস খেলেন, তখন ক্রিকেট ঈশ্বর নীরবেই তা দেখেছিলেন। সময়ের সঙ্গে ক্রিকেটের রূপ গতি সবই বদলেছে। কিন্তু শিল্পীর নিজেকে প্রমাণের দায়? বদলায়নি। এখানে লড়াইটা যে একান্তই নিজের, ছায়ার সঙ্গে কুস্তি। কোহলির সাম্প্রতিক ইনিংসগুলি যেন সেভাবেই নিজের সাথে নিজের কথোপকথন হয়ে উঠছিল। আর শেষে, মহারাজ এ কী সাজে...

তিনি শুরু করেছিলেন বেশ সতর্ক ভাবে। ইনিংসের প্রথম ২০টা বলে রান তুললেন মাত্র ১২। একটা চার, বাকি সব সিঙ্গল, ডট। আধুনিক ক্রিকেটে আড়ষ্টতা অমার্জনীয়; হঠকারিতাও আত্মঘাতী, তাই ধ্যানমগ্ন হওয়ার সংকল্পেই ওপ্রান্ত থেকে বলগুলি তিনি পরখ করছিলেন। প্রথম ত্রিশ বলে স্ট্রাইক রেট ছিল ৮২। কেউ মনে করবে মারভিন আটাপাট্টুকে, কারও মনে পড়বে স্টিভ ওয়ার অবিচল মন।

আরও পড়ুন-টেস্ট ক্রিকেটে আধুনিক ব্যাটিংয়ের জয়গান গেয়েছেন বিরাট কোহলি

পরিসংখ্যান বলছিল পন্টিং, সচিন, সাঙ্গাকারার মতোই কোহলির স্ট্রাইক রেট বেশ অনেকটা কমেছে। বাউন্ডারির হারও নিম্নমুখী। তবু বেলা যত গড়ায় মাঠ আঁকড়ে পড়ে থাকতে হয়, জানেন কোহলি।

এদিনের ইনিংস ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে করিয়ে দেবে ১৯৬৯ সালে মাদ্রাজে আঘাত থেকে ফিরে চাঁদু বোর্ডের ৬৭ রানের ইনিংসকে। কোহলি মাঠে নেমেছিলেন নিজের আজীবনের শিক্ষাকে আরেকবার পরখ করতে।

৩২তম বলে মারলেন কভারড্রাইভ। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। পরের ৫০ বলে করলেন ৭৮ রান,স্ট্রাইক রেট ১৫৬। ফুটওয়ার্ক তখনও পুরোপুরি সাবলীল না । হয়তো বয়সের ভারেই। কিন্তু দৃষ্টিটা যে একইরকম ধারালো তা স্পষ্ট বোঝা গেল যখন তিনি পেসারের ভুল লেংথের বলকে আলতো করে অফ সাইডে ঠেললেন।

স্পিনের বিরুদ্ধে বিরাটের সংগ্রহ ৪৪ বলে ৬২ রান। ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে ৩টি চার। একটা অন-ড্রাইভ, একটি বুদ্ধিদীপ্ত লেট-কাট আর একটি পুল। মাঠ শাসনের পুরোনো অভ্যেস বেশ টের পাওয়া গেল। কিন্তু এসবের থেকেও বড় বিষয় হল, কোহলি নিজেকে নতুনভাবে চিনতে চাইছেন, সাদা ক্যানভাসে যে ভাবে নিজেকে মেলে ধরতে চান কোনো বড় শিল্পী।

আরও পড়ুন- পোস্টার বয় থেকে ফ্যামিলি ম্যান— অন্দরের বিরাট, অন্তরের বিরাট

মার্কো ইয়ানসেনের বল থার্ড ম্যান দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে ১০২ বলে সেঞ্চুরি করলেন বিরাট। ২৯১ দিনের অপেক্ষা । আবার রেকর্ড। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব মিলিয়ে ৮৩তম সেঞ্চুরি তাঁর। সচিনের ১০০ টি। গুরুর থেকে এখন ১৭ ধাপ পিছনে তিনি। নান্দ্রে বার্গারের বলে সোজা ছক্কা হাঁকিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিকি পন্টিংকেও টেক্কা দিয়েছেন ছয়ের সংখ্যায়। ২০১১ সালে ইউসুফ পাঠানের আটটা ছয়ের পর কোহলির সাতটা ; একটা একদিনের ইনিংসে ভারতের জন্য যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ছয় হাঁকিয়েছেন তিনি। ওয়ানডে’তে ৫২তম সেঞ্চুরির পর তাই চেনা ভঙ্গিতে ভাসলেন উল্লাসে। সচিন আর ডেভিড ওয়ার্নরকে ছাপিয়ে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সর্বোচ্চ শতরানের মালিক এখন তিনি (৬টি)। চেনা কোহলি ধরা দিল এক লহমায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, মুঠিবদ্ধ হাত আঘাত করল বাতাসকে। এক সমর্থক তো নিরাপত্তার বেষ্টনীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাঠে ঢুকে পায়েই পড়লেন কোহলির। হাততালি দিলেন গম্ভীরও। ২০২০ সালের পর প্রথম কোহলি এবং রোহিতের মধ্যে ১৩৬ রানের পার্টনারশিপ। পিছনে সৌরভ-শচীন, তেণ্ডুলকর- সেওবাগ, কুমার সাঙ্গাকারা এবং তিলকরত্নে দিলশানের রেকর্ড। রোহিতের সাথে খেলে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই ৩৯১-এর বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এখানেও পিছনে ফেলেছেন সচিন-দ্রাবিড় জুটিকে। শেষ পর্যন্ত ১২০ বলে ১৩৫ রান। আউট হলেন। সাজঘরে ফিরলেন। ড্রেসিংরুমে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন গৌতম গম্ভীর।

আরও পড়ুন-বিরাট কোহলি: খুঁজে ফেরা এক অনন্য লড়াইক্ষ্যাপাকে

কোহলি বুঝছেন কেরিয়ারের এই পর্যায়ে আর শুধু স্কোরকার্ড নয়; তাঁকে বহন করতে হবে খেলার প্রতি অনুচ্চারিত আধ্যাত্মিক দায়। প্রতিটি বলের পর হয়তো তিনি ভিতরে ভিতরে হয়তো রিচি রিচার্ডস বা অ্যালান বর্ডারের মত বলছিলেন-আমি আছি,আমি লড়ব, আমি ফিরব।

প্রতিভারও বয়স হয়, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের?

কোহলি জানেন, সমালোচনা থাকবে, প্রত্যাশার বোঝাও থাকবে। কিন্তু তিনি তবু ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ভিভ রিচার্ডসের ১৮৯ বা ইনজামামের ব্যাঙ্গালোরের ১৮৪ করার স্মৃতি নিয়ে এগোবেন - একলা, নিজের গভীর বিশ্বাসে, অবিচল অনুশীলনে। পরিণত, পরিশীলিত হবেন। আর নীরবেই তাঁর ব্যাট গড়বে 'বিরাট ' কীর্তি।

More Articles