৫১ বছর আগে ধর্ষণ করে কুকুরের চেন দিয়ে শ্বাসরোধ! মনে পড়ে নার্স অরুণা শানবাগকে?
Aruna Shanbaug Rape Case: হাসপাতালের তৎকালীন ডিন, ডঃ দেশপান্ডে ওই জুনিয়র ডাক্তারকে বাঁচতে 'পায়ুপথে ধর্ষণ' বা সোডোমি-র বিষয়টি উল্লেখ করেননি।
অরুণা শানবাগকে মনে পড়ে? হাসপাতালের মধ্যে ধর্ষিতা নার্স। শুধু ধর্ষিতা বললে ভুল হয়, বীভৎসভাবে ধর্ষিতা। গলা টিপে দেওয়ার পরেও মরে যাননি, এই ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভোগান্তি। ধর্ষণের পর ৪২ বছর ধরে তিনি ছিলেন জীবন্মৃত। ইংরেজিতে বলে 'ভেজিটেবল'। চলার ক্ষমতা নেই, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে না। শুধু মাথায় রক্তচলাচল হয়। মাথা মরেনি, তাই মৃত বলা যায় না। এ বেঁচে থাকা মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। স্বেচ্ছামৃত্যু চেয়েছিলেন তিনি। ওই পাশবিক যন্ত্রণার ৪২ বছর পর তিনি মারা যান। আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ ও খুনের পর, একটিই সত্য ফের স্পষ্ট হয়। হাসপাতাল নিরাপদ ছিল না আগেও, এখনও নয়।
১৯৭৩ সালে মুম্বই হাসপাতালে কর্মরত অরুণা শানবাগকে ধর্ষণ করে সেখানেরই একজন ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্ট। ধর্ষণের সময় আক্রমণের জেরে অরুণা শানবাগের মস্তিষ্কের গুরুতর ক্ষতি হয় এবং তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। দীর্ঘ বছর ধরে অরুণা শানবাগকে নাক দিয়েই খাবার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। অবশেষে নিউমোনিয়া হয়ে যায় তাঁর। মারাও যান, মুক্তি পান। তিনি চেয়েছিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। সুপ্রিম কোর্টে ইউথানেশিয়ার আবেদন করেন। দেশের শীর্ষ আদালত অরুণা শানবাগের স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি খারিজ করে দেয়।
যখন ধর্ষিতা হন অরুণা, তখন তাঁর বয়স ছিল ২৫। ওই কেইএম হাসপাতালেরই অ্যাটেন্ডান্ট অরুণাকে ধাতব চেইন দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে যায়। ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর ঘটেছিল ঘটনাটি। এমন বীভৎস অত্যাচারের পরেও প্রাণে বেঁচে যান অরুণা। কিন্তু অথর্ব হয়ে যান। বাকি জীবন কাটে হাসপাতালে। দিনে দু'বার জোর করে খাওয়ানো হতো তাঁকে।
আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ডে ধৃত সঞ্জয় কীভাবে সিভিক ভলান্টিয়ার হলো? কীভাবে নিয়োগ হয় এদের?
সাংবাদিক ও লেখিকা পিঙ্কি ভিরানি অরুণা শানবাগকে নিয়ে একটি বই লেখেন। তিনিই অরুণার হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন করেছিলেন। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট তা প্রত্যাখ্যান করে। পিঙ্কি ভিরানি যুক্তি দিয়েছিলেন, অরুণা শানবাগ 'কার্যত একজন মৃত ব্যক্তি'। তাই স্বেচ্ছামৃত্যু তাঁর অধিকার। অরুণা শানবাগের বাবা-মা অনেক বছর আগেই মারা গেছিলেন। অন্যান্য আত্মীয়রা তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগও রাখেননি। আত্মীয়হীন, স্বপ্নহীন, চলচ্ছক্তিহীন এক বিশ্বে বেঁচেছিলেন অরুণা।
পিঙ্কি এই অবস্থা থেকে অরুণাকে মুক্তি দিতে আদালতে জানিয়েছিলেন, আদালত অরুণা শানবাগকে খাওয়ানো বন্ধ করার জন্য হাসপাতালে নির্দেশ জারি করুক কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, অরুণা খাবার খান। মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমে সাড়াও দেন। সব মিলিয়ে আদালতে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন খারিজই হয়ে যায়।
আশ্চর্যের বিষয় যে, অরুণা শানবাগের ধর্ষণকারী সোহনলাল ভরতা বাল্মীকিকে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্তই করা হয়নি কারণ সেই সময়ে ভারতীয় আইনের অধীনে 'সোডোমি' অর্থাৎ পায়ুপথে ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে গণ্যই করা হয়নি। ডাকাতি ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে সাত বছরের সাজা ভোগ করার পর ১৯৮০ সালে সোহনলাল মুক্তি পায়।
মুম্বইয়ের কিংস এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল (কেইএম) হাসপাতালের প্রাক্তন নার্স অরুণা শানবাগ যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ৬৭৷ কুকুরের শিকল দিয়ে গলা টিপে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁকে। এই নৃশংস হামলায় অরুণার মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রক্ত এবং অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কেন অরুণাকে ধর্ষণ করে সোহনলাল? অরুণার উপর ক্ষুব্ধ ছিল সোহনলাল। অরুণা অভিযোগ করেছিলেন, চিকিৎসা পরীক্ষায় ব্যবহৃত কুকুরের খাবার চুরি করে সোহনলাল। কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে জানিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন অরুণা। সেই রাগেই অরুণাকে শাস্তি দিতে আক্রমণ করে সোহনলাল।
আরও পড়ুন- মৃত চিকিৎসকের দেহ যে বীভৎস অবস্থায় দেখেছেন, জানালেন প্রতিবেশী
তবে মজার বিষয় হলো, হাসপাতালের কর্মচারী হলেও সোহনলালের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। বুলন্দশহরের বাসিন্দা সোহনলাল এই ঘটনা ঘটানোর কিছুদিন আগেই বিয়ে করে। হাসপাতাল ও পুলিশের ফাইল বা আদালতের নথিতেও তার কোনও ছবি নেই! আরও মজার যে, সবাই জানে যে অরুণা শানবাগকে সেই রাতে একটি খালি অপারেশন থিয়েটারে ধর্ষণ করা হয়েছিল, অথচ পুলিশ রেকর্ড এবং এফআইআর কোথাওই ধর্ষণের উল্লেখ নেই। অরুণা শানবাগের বিয়ের কথা ছিল একজন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে। তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে ধর্ষণের অভিযোগ হলে তাঁর খ্যাতিতে প্রভাব পড়বে। হাসপাতালের তৎকালীন ডিন, ডঃ দেশপান্ডে ওই জুনিয়র ডাক্তারকে বাঁচতে 'পায়ুপথে ধর্ষণ' বা সোডোমি-র বিষয়টি উল্লেখ করেননি।
যানা যায় ওই মুহূর্তে অরুণা শানবাগের পিরিয়ডস চলছিল বলে তাঁকে যোনিপথে ধর্ষণ করার পরিবর্তে পশ্চাৎপথে যৌনক্রিয়া করে সোহনলাল। একজন তরুণীকে আজীবনের মতো অথর্ব করেও মাত্র সাত বছরের কারাদণ্ড পায় সোহনলাল। মুক্তি পেয়ে শোনা যায় অন্যত্র কাজও করেছে সে। অথচ অরুণা ভুগেছেন, ৪২ বছরের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছেন। তাঁর দেহও ভোরবেলা উদ্ধার হয়েছিল খালি অপারেশন থিয়েটার থেকে। আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ শুধু একটি বিষয়ই স্পষ্ট করে দিল। কোনও কর্মক্ষেত্রই মহিলাদের জন্য নিরাপদ ছিল না, নিরাপদ নয়। সিসি ক্যামেরা বসানোর আগেও নয়, পরেও নয়। অরুণা ধর্ষিত ও অত্যাচারিত হন দশ মিনিট সময় ধরে। অরুণা শানবাগের ধর্ষক মাত্র সাত বছরের কারাদণ্ড পায়। আর যাবজ্জীবন দণ্ড পেয়ে গেলেন অরুণা, বিচার পাওয়ার কথা ছিল যার।